কোনো কোনো মৃত্যু আনন্দের, উল্লাসের!

:: শান্তনু চৌধুরী ::

nazamiশরীফকে কর্নেল বলেছিলেন, রুমী একদিন পর ফিরে আসবে। কথাটা কি বিশ্বাসযোগ্য? আমি কি বিশ্বাস করেছিলাম? শরীফ ফিরে আসার খবর পেয়ে পরশু বিকেল থেকে বাসায় আত্মীয়, বন্ধুর ঢল নেমেছে। সবাই রুমীর জন্য হায় হায় করছে। হায় হায় করছে কেন? তবে কি রুমীর ছাড়া পাবার কোনো আশা নেই? গতকাল এগারোটায় আমি মঞ্জুরের সঙ্গে আবার এমপিএ হোস্টেলে গিয়েছিলাম। …কিন্তু যাওয়ায় সার। কোনোখানে কোনো সুরাহা করতে পারলাম না। কেউ রুমীর সম্বন্ধে কোনো হদিস দিতে পারলেন না। …এমপিএ হোস্টেলটা দেখে বোঝাই যাচ্ছে না যে এরই অভ্যন্তরে দিবারাত্রি ঐসব নারকীয় অত্যাচার হয়ে চলছে (২ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার, ১৯৭১, একাত্তরের দিনগুলি, জাহানারা ইমাম)।

রুমীকে ফিরে পেতে মা জাহানারা ইমাম এর দুদিন পর ছুটে গিয়েছিলেন ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের ওয়ারলেস কলোনির পাগলাপীরের কাছে। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন রুমী বেঁচে আছেন। একজন মা হিসেবে তিনি ছুটেছেন এখানে-সেখানে, না তার রুমী ফিরে আসেননি। ফিরবে না আর কোনোদিন। একাত্তরের ভয়ংকর খুনী আলবদর বাহিনীর নেতা কুখ্যাত রাজাকার মতিউর রহমান নিজামীর প্ররোচনায় তাকে হত্যা করা হয়েছে। তাই জাহানার ইমাম বেঁচে থাকলে হয়তো মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ছুটে যেতেন কারাগারের সামনে বা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের দিকে। ছেলের হত্যাকারীর পরাজয়ের বিচার যে রাষ্ট্র করেছে তা ভেবে হয়তো উল্লাস করতেন। কারণ ইতিহাসের ঘৃণিত একজন রাজাকারকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়েছে জল্লাদ। স্বাভাবিকভাবে মনে হতে পারে খুব সহজেই বিষয়টি শেষ হয়েছে, কিন্তু আদৌ তা নয়।

দীর্ঘ ৪৫ বছর পর বাংলাদেশের ইতিহাস কলঙ্কমুক্ত হলেও ট্রাইব্যুন্যালের হিসেবে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলে এই বিচারকাজ। এরপরও হয়তো নিজামীর বিরুদ্ধে মামলার সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা আবু সামা উল্লাস করবেন। কারণ তিনি দেখেছেন, ’৭১ সালের ১০ মে পাবনার সাঁথিয়ার বাউশগাড়ি গ্রামের রূপসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে স্থানীয় শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের যে সভা হয় তার পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৪ মে পাশের ২ গ্রামের প্রায় আটশ জনকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। ধর্ষণ করা হয় অর্ধশতাধিক নারীকে। তিনি দেখেছেন পাবনা জেলা স্কুলের শিক্ষক মাওলানা কসিম উদ্দিনকে নির্মম নির্যাতন এবং হত্যার পর শহরের ইছামতি নদীর পাড়ে লাশ ফেলে রাখা। মামলার আরেক সাক্ষী জামাল উদ্দিন দেখেছেন, নিজামীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সাঁথিয়ার ধূলাউরি গ্রামে ৩০ জনকে হত্যার দৃশ্য।

মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জল হোসেন মাস্টার জানেন নিজামীর নেতৃত্বে ৩ ডিসেম্বর বেড়া উপজেলার হিন্দু অধ্যুষিত বৃশালিখা গ্রামে প্রায় ৭০ জনকে হত্যা করা হয়। ধূলাউরি গ্রামের আব্দুর রউফ মন্টুও নিজামীর মৃত্যুতে উল্লাস করবেন। কারণ তার বাবা আবুল কাশেম ফকিরকে হত্যায় সরাসরি জড়িত ছিল নিজামী। একই গ্রামের লিয়াকত আলীর বাবাকেও হত্যা করে এই কুখ্যাত রাজাকার। এই তালিকা হয়তো আরো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে আর উল্লাসের মাত্রাও ছাড়িয়ে যাবে। যেমনটি নিজামীর ফাঁসির পর মিষ্টি বিতরণ হয়েছে সাঁথিয়ায়। কারাগারের সামনে থাকা মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষ প্রদর্শন করেছেন জুতা। অথচ এই রাজাকারের গাড়িতে এক সময় উড়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। যেটিকে ট্রাইব্যুনাল বলছেন, ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ নারীর প্রতি চপেটাঘাত। নিজামীর ফাঁসি হয়তো সেসব ভুলিয়ে দেবেন স্বজনহারাদের।

২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর জামায়াতের আমির নিজামীকে ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ৮টি প্রমাণ হওয়ায় ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। পরে রায়ের বিরুদ্ধে খালাস চেয়ে নিজামী আপিল করেন। উভয়পক্ষের দীর্ঘ শুনানি শেষে, বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা ও উস্কানি, পাবনার বাউসগাড়িসহ ৩টি গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪শ জনকে হত্যা এবং পাবনার ধূলাউড়ির ৩০ জনকে হত্যার ৩টি অপরাধে ফাঁসি এবং পুরনো এমপি হোস্টেলে আটক রেখে রুমী, বদি, জুয়েল, আজাদকে হত্যার প্ররোচনা ও পাবনার বৃশালিখা গ্রামের সোহরাব আলীকে হত্যার দুইটি অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদ- বহাল রেখে সংক্ষিপ্ত রায় দেন দেশের সবোর্চ্চ আদালত। মতিউর রহমান নিজামী ১৯৭১ সালে নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের (জামায়াতের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন, বর্তমান নাম ইসলামী ছাত্রশিবির) সভাপতি ছিলেন। কুখ্যাত গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন নিজামী। ফাঁসির আগে প্রাণভিক্ষা চাননি নিজামী, ছিলেন নির্বিকারও। কিন্তু সে সময়কার সাক্ষী আর ইতিহাসের পাতা বলছে কতোটা নৃশংসতা ছিল তার মধ্যে।

‘কালো সোয়েটার আর খাকি প্যান্ট পরা একদল লোক। সবাই তাদের আলবদর নামে চেনে। যুদ্ধের (মুক্তিযুদ্ধ) শেষ তিন রাত ধরে তারা শিকার খুঁজে ফিরছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল, যেসব বাঙালি বুদ্ধিজীবী পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে, তাঁদের খুঁজে বের করে নিশ্চিহ্ন করা।’ ‘অ্যা জার্নালিস্ট ইজ লিঙ্কড টু মার্ডার অব বেঙ্গলিজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে মার্কিন সাংবাদিক ফক্স বাটারফিল্ড এভাবেই একাত্তরের নরঘাতক আলবদর বাহিনীকে চিত্রায়িত করেছিলেন।

১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বাটারফিল্ড আরও লেখেন, অনেকে মনে করেন, যদি যুদ্ধ ওই সময় (১৬ ডিসেম্বর) শেষ না হতো, তবে আলবদরের লক্ষ্য সফল হতো। ইটভাটায় দেড়শ’ লাশ পড়ে ছিল; আঙুল কাটা, নখ উপড়ে ফেলা হয়েছে। আশপাশের আরও অন্তত ২০টি গণকবরে পুঁতে ফেলা হয়েছে শতাধিক লাশ।

মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়ে আলবদর বাহিনীর নৃশংসতা বোঝাতে বাটারফিল্ডের এই বিবরণকেই বেছে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। একই সঙ্গে রায়ের পর্যবেক্ষণগুলোও ছিল নৃশংসতার চরম উদাহরণ। পাকিস্তানি রাজনৈতিক বিশ্লেষক মুসা খান জালাজাইয়ের ‘সেকটারিয়ানিজম অ্যান্ড পলিটিকো-রিলিজিয়াস টেররিজম ইন পাকিস্তান’ শীর্ষক বই উদ্ধৃত করে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ১৯৭১ সালের মে মাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি নিধনযজ্ঞে যোগ দেয় জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিহত করার জন্য ছাত্রসংঘ দুটি আধা সামরিক জঙ্গি বাহিনী গঠন করে- আলবদর ও আলশামস। এ দুটি বাহিনী, বিশেষত আলবদরে যোগ দেয় জমিয়তের বিপুলসংখ্যক সদস্য। এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মতিউর রহমান নিজামী, কারণ তিনি ছিলেন জমিয়তের নাজিম-এ-আলা (প্রধান)।

১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামে নিজামীর লেখা একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়। ‘বদর দিবস : পাকিস্তান ও আলবদর’ শীর্ষক প্রবন্ধে নিজামী লেখেন, ‘…পাক সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় এ দেশের ইসলামপ্রিয় তরুণ ছাত্রসমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আলবদর বাহিনী গঠন করেছে।’ ওই লেখায় মুক্তিযোদ্ধাদের নিশ্চিহ্ন করে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ানোর জন্য আলবদরদের উৎসাহ দেয়া হয়। নিজামী সে সময় পাকিস্তানের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায় বইটিতে রয়েছে, একাত্তরের ২ আগস্ট চট্টগ্রাম ইসলামী ছাত্রসংঘের উদ্যোগে স্থানীয় মুসলিম ইনস্টিটিউটে ছাত্রসমাবেশে আলবদর প্রধান নিজামী বলেন, ‘দেশপ্রেমিক জনগণ যদি ১ মার্চ থেকে দুষ্কৃতকারীদের মোকাবিলায় এগিয়ে আসত তবে দেশে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। …মুসলমানরা যখন ব্যর্থ হলো তখন আল্লাহ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে দেশকে রক্ষা করেছেন।’

শুরুতে বলেছিলাম, একাত্তরের স্বজন হারানোদের জন্য এই মৃত্যু উল্লাসের। এই মৃত্যু উল্লাসের নব জাগরিত তরুণদের জন্য, যারা একটি রাজাকারমুক্ত উন্নত ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন। যারা চান, ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু। তবে সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, মানবতাবিরোধী মৃত্যুদ- প্রাপ্তদের স্বজনরা কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে যে ‘ভি’ চিহ্ন দেখান তা তাদের ধৃষ্টতা। পরিবারের সদস্যরা যে একই আদর্শে বেড়ে উঠেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।