বাঙালির পরকীয়া!

শান্তনু চৌধুরী : বাঙালির পরকীয়া নানা রূপে ভোল বদলেছে। তার রূপ, রস, গন্ধ পাল্টে গিয়েছে কালে কালে। কখনও ধর্মপালনে, কখনও আভিজাত্য এবং অর্থের অহমিকার প্রকাশে, কখনও বা কামুকের কামড়ে় ক্ষতবিক্ষত হয়ে কোনওক্রমে কোমরের কাপড় গুটিয়ে বিছানা ছেড়ে়ছে এই পরকীয়া।

এভাবেই বুকের কাছে কোঁচকানো কাপড় জড়িয়ে সে চলে এসেছে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের মাঝপর্বে। এখন সে বারবণিতা নয়। আবার ‘রক্ষিতা’র স্ট্যাটাসও পায়নি। এক অদ্ভুত আলো-আঁধারিতে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে এ যুগের পরকীয়া। যার পোশাকি নাম ‘বেবি’। জমিদার-বঙ্গে বারমহলে যারা অপেক্ষা করত রাতের, হোটেলের ঘরে একসময়ে যারা সাদা চাদরে অ্যাশট্রে টেনে রাখত, তারাই আজ ঢুকে পড়ে়ছে বেডরুমে। কার ঘরে কে রাত কাটাচ্ছে, এহেন খোঁজ রাখার সময় বাঙালির আর নেই। যার ঘরে বেবি, তার রাত কাটে ব্যস্ততায়। যার ঘরে নেই, তার রাত কাটে ঘুমে আধো-ঘুমে, ল্যাপটপে, ডেস্কটপে। সে-ও ব্যস্ততা। এখন তাই নাটক সিনেমায় এসব দেখানো হয় বেশি করে। পরকীয়া করতে গিয়ে খুনের দায়, অবিশ্বাস আর নানা কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী গ্রেফতার করেছে এমন ঘটনা প্রায় প্রতিদিন ঘটছে। সবচেয়ে বেশি ঘটছে হোটেলে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে রুম ভাড়া নেওয়ার পর খুন করে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা।

স্ত্রী নয়। সে স্ত্রী হতে পারবে না। সে জানে সংসার-সুখ সে পাবে না এখানে। তা হলে কীসের টানে সে ছুটে আসে? নিছকই সময় কাটানো? নেহাতই শরীরী খিদে? বোধহয় তাতেও পুরোটা ব্যাখ্যা করা গেল না। যৌনতায় মাত হয়ে যাওয়া, কিন্তু মা সে হবে না। কোনও দায় তার নেই, দায়িত্বও নেই। আনন্দ তার কীসে, সে-ই জানে। কিন্তু ভয় তার নেই। ঘরে ফেরে ক্লান্ত শরীর। কাঁধ থেকে নেমে যায় বাদামি রঙের ব্যাগ। আলো আঁধারিতে আকাশ ভরেছে।

এভাবেই বুকের কাছে কোঁচকানো কাপড় জড়িয়ে সে চলে এসেছে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের মাঝপর্বে। এখন সে বারবণিতা নয়। আবার ‘রক্ষিতা’র স্ট্যাটাসও পায়নি। এক অদ্ভুত আলো-আঁধারিতে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে এ যুগের পরকীয়া। যার পোশাকি নাম ‘বেবি’। জমিদার-বঙ্গে বারমহলে যারা অপেক্ষা করত রাতের, হোটেলের ঘরে একসময়ে যারা সাদা চাদরে অ্যাশট্রে টেনে রাখত, তারাই আজ ঢুকে পড়ে়ছে বেডরুমে। কার ঘরে কে রাত কাটাচ্ছে, এহেন খোঁজ রাখার সময় বাঙালির আর নেই। যার ঘরে বেবি, তার রাত কাটে ব্যস্ততায়। যার ঘরে নেই, তার রাত কাটে ঘুমে আধো-ঘুমে, ল্যাপটপে, ডেস্কটপে। সে-ও ব্যস্ততা। এখন তাই নাটক সিনেমায় এসব দেখানো হয় বেশি করে। পরকীয়া করতে গিয়ে খুনের দায়, অবিশ্বাস আর নানা কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী গ্রেফতার করেছে এমন ঘটনা প্রায় প্রতিদিন ঘটছে। সবচেয়ে বেশি ঘটছে হোটেলে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে রুম ভাড়া নেওয়ার পর খুন করে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা।

এই প্রসঙ্গে ইংরেজি সাহিত্যিক ডিকেন্সের জীবনের একটা ঘটনা বলি। ইংরেজ সাহিত্যিক তখন ব্যস্ত ‘দ্য ফ্রোজেন ডিপ’ নাটকের আয়োজন নিয়ে। সেটা ১৮৫৭ সাল। নাটকের একটি চরিত্রের জন্য বাছা হলো বুদ্ধিদীপ্ত অভিনেত্রী নেলি ওরফে এলেন ললেস টারনানকে। বয়সে ডিকেন্সের বড়় মেয়ে মেরি-র চেয়েও বছর খানেকের ছোট। দিন কয়েকের মধ্যেই বাজিমাত করলেন ঝকঝকে সুন্দরী নেলি। অষ্টাদশীর প্রেমে ঘায়েল হলেন পঁয়তাল্লিশ-উত্তীর্ণ ডিকেন্স। গোপনে ফুল ফোটাতে থাকল পরকীয়া প্রেম। সে ফুল সুগন্ধী না বিষময়, তা বোঝার আগেই এক দিন চোখে সরষে ফুল দেখলেন ডিকেন্স। লন্ডনের এক গয়নার দোকান থেকে পাঠানো ছোট একটি মোড়়ক ঘটনাচক্রে এসে পড়ল তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিনের হাতে। ভেতরে একটি সুদৃশ্য সোনার ব্রেসলেট। সঙ্গে নেলির উদ্দেশ্যে চিরকুট। ক্রোধে ফেটে পড়লেন ক্যাথরিন। কিন্তু তীব্র ঝাঁজ দেখিয়ে নেলির সঙ্গে সম্পর্কের কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করলেন ডিকেন্স। বললেন, নেলি তাঁর ‘মেয়ের মতো’; থিয়েটারের অন্যতম মুখ্য অভিনেত্রীকে ছোট্ট একটি স্মারক পাঠানো কী এমন গর্হিত কাজ!
ক্যাথরিন এসব কথায় ভুললেন না। অতএব, বিচ্ছেদ। পথের কাঁটা সরানোর এমন মওকা চট করে মেলে না। কিন্তু ডিকেন্সের মতো নামীদামি লোকের বিচ্ছেদের কথা পাঁচকান হওয়ায় চারদিকে তখন নানা রটনা।

স্ত্রী নয়। সে স্ত্রী হতে পারবে না। সে জানে সংসার-সুখ সে পাবে না এখানে। তা হলে কীসের টানে সে ছুটে আসে? নিছকই সময় কাটানো? নেহাতই শরীরী খিদে? বোধহয় তাতেও পুরোটা ব্যাখ্যা করা গেল না। যৌনতায় মাত হয়ে যাওয়া, কিন্তু মা সে হবে না। কোনও দায় তার নেই, দায়িত্বও নেই। আনন্দ তার কীসে, সে-ই জানে। কিন্তু ভয় তার নেই। ঘরে ফেরে ক্লান্ত শরীর। কাঁধ থেকে নেমে যায় বাদামি রঙের ব্যাগ। আলো আঁধারিতে আকাশ ভরেছে।

ভিক্টোরীয় সমাজের ক্রমবর্ধমান ছ্যা ছ্যা আটকাতে ফের ভুল করলেন ডিকেন্স। যাঁরা তাঁকে নিয়ে নানা সন্দেহ বয়ে বেড়াচ্ছেন বা তিনি বিপথে চালিত হচ্ছেন বলে মনে করছেন, তাঁদের জ্ঞাতার্থে ১৮৫৮-র ২৫ মে একটি বিবৃতি লিখে ডিকেন্স তুলে দিলেন তাঁর ম্যানেজারের হাতে। ম্যানেজার বেছে বেছে নানা জনকে সেই চিঠি পড়ালেনও, কিন্তু অচিরেই তা প্রকাশিত হয়ে গেল ইংল্যান্ড ও আমেরিকার নানা পত্রপত্রিকায়। আরও ছড়ি়য়ে পড়ল ডিকেন্সের কেচ্ছা। স্ত্রীর সঙ্গে যে তাঁর দীর্ঘদিন বনিবনা হচ্ছিল না, তা এক রকম সত্যিই। কিন্তু বিচ্ছেদ-সংক্রান্ত সাফাই গেয়ে সে বিবৃতিতে ডিকেন্স প্রমাণ করতে চাইলেন, স্বামী-স্ত্রীর বোঝাপড়ার অভাবই তাঁদের আলাদা থাকার যৌথ সিদ্ধান্তের একমাত্র কারণ। নেলি-র নাম না করে বোঝাতে চাইলেন, যাঁকে নিয়ে এত রটনা, সেই তরুণী তাঁর মেয়েদের মতোই নিষ্পাপ। আরও বড় ভুলটা ডিকেন্স। এবার নিজ উদ্যোগেই পত্রপত্রিকায় ছাপলেন আর একটি ‘পারসোনাল’ বিবৃতি। আরও জোর দিয়ে বোঝাতে চাইলেন, নতুন কোনও প্রেম-টেম নয়, মিল না হওয়াই বিচ্ছেদের কারণ।

এতে আরও শোরগোল পড়ে় গেল, ডিকেন্সের অবৈধ সম্পর্কের ব্যাপারে যাঁরা বিন্দুমাত্র জানতেন না, তাঁরাও রসালো কেচ্ছার ছিটেফোঁটা চেখে নিলেন।

এমনও শোনা গেল, ডিকেন্সের প্রেম আসলে তাঁর বাড়ির দেখভালের দায়িত্বে থাকা, নিজেরই শ্যালিকা জর্জিনা হগার্থের সঙ্গে। কেউ বলল, ডিকেন্সের অবৈধ বাচ্চার জন্ম দিয়েছেন নেলি। ডিকেন্স কিন্তু চিরকাল চেপে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন নেলির সঙ্গে সম্পর্কের কথা। তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত এ সব ঘটনা, রটনা আর সন্দেহের স্তরেই থেকে গিয়েছে। পরে তাঁর জীবনীকার ও গবেষকরা এই অবৈধ প্রণয়কে সত্য বলেই মনে করেছেন। বিভিন্ন নামে বাড়ি ভাড়া নিয়ে তিনি যে নেলিকে রেখেছিলেন, তার প্রমাণও মিলেছে। ডিকেন্সের পরবর্তী কালের উপন্যাসেও বেশকিছু চরিত্রে স্পষ্ট হয়েছে নেলির ছায়া। শেষ দিন পর্যন্ত নেলির সঙ্গে সম্পর্ক ছিল ডিকেন্সের। কিন্তু বিচ্ছেদের পর আর কখনও স্ত্রী ক্যাথরিনের মুখোমুখি হননি তিনি। মৃত্যুশয্যায় ক্যাথরিন মেয়ে কেট-এর হাতে তুলে দিয়েছিলেন তাঁকে লেখা ডিকেন্সের চিঠিগুলো। বলেছিলেন, ‘এগুলো ব্রিটিশ মিউজিয়ামে দিও, যাতে পৃথিবী জানতে পারে একদিন তিনি আমায় ভালোবাসতেন।’

এবার আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন এর কথা বলি। আইনস্টাইনকে নিয়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক একটা সিরিজ দেখাচ্ছে। আইনস্টাইন কতোটা জিনিয়াস ছিলেন সেটা জানতে এই সিরিজ দেখা যেতেই পারে। কিন্তু ব্যক্তি আইনস্টাইন কেমন ছিলেন সেটা জানতে এই সিরিজ দেখা উচিত হবে না। অলস লোক খুব ভালো চিঠি লিখতে পারে বলে একটা প্রবাদ আছে। কাজেই প্রেমপত্রও লিখেছিলেন তাঁর প্রথম স্ত্রী মিলেভা মেরিককে। সেই চিঠি পড়ে সার্বিয়ান মেয়ে মিলেভা হাবুডুবু খেলেন। দেখা গেলো মিলেভা প্রেগন্যান্টও হয়ে গেছেন। এরপর তাঁদের মেয়ে হলো-লেজেরাল আইনস্টাইন। লেজেরাল মারা যাওয়ার পর থেকেই হলো সমস্যা। আইনস্টাইনের ছাত্রীর সাথে প্রেম, গোপন সম্পর্ক, সংসারে অশান্তি-সবমিলিয়ে একজন অবিশ্বস্ত স্বামী এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন বাবা ছিলেন তিনি।

একই কথা খাটে সম্রাট শাহজাহানের বেলাতেও। সবাই বলে বেড়ায় শাহজাহান কতবড় প্রেমিক ছিলেন, কী পরিমাণ ভালোবাসতেন মমতাজকে-ইত্যাদি। অথচ বাস্তবতা ভিন্ন। তিনি রাতের পর রাত মেতে থাকতেন বাইজী আর মদের আসরে। মমতাজই একমাত্র নন, আরও অসংখ্য পতœী উপপতœী ছিল তাঁর। তাজমহল প্রাঙ্গণেই মমতাজসহ আরও প্রায় ৫ জনের কবর আছে। অথচ মমতাজ মরার পর একটা মার্বেলের সমাধিতে তাকে তোলার পর যেন শাহজাহানেরর সাত খুন মাফ হয়ে গেলো! লোকের মুখে শোভা পেতে লাগলো- কী চমৎকার তাজমহল! কি অসম্ভব সুন্দর কবর!
শান্তনু চৌধুরী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক