শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ৫ মাঘ ১৪৩১

পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্কের আর কতদূর!

| প্রকাশিতঃ ২৯ মে ২০১৬ | ৪:১১ অপরাহ্ন

:: সুরেশ কুমার দাশ ::

Bangladesh-Pakistan1বাংলাদেশ নিয়ে সম্পূর্ণ অনধিকার চর্চা করছে পাকিস্তান। বার বার যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে কথা বলছে-যাতে তাদের কোনো অধিকার নেই। পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াটা এমন যেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বা এমন কোনো ব্যক্তিবিশেষকে ফাঁসি (আদালতের রায়ে দেওয়া শাস্তি) দিচ্ছে বাংলাদেশ। মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসি দেওয়ার পর পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে আবার প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ ঢাকায় জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদ- কার্যকরের পর এর নিন্দা জানিয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে- বাংলাদেশের জামায়াত আমিরের একমাত্র অপরাধ ছিল, তিনি ‘পাকিস্তানের সংবিধান ও আইন সমুন্নত’ রাখতে চেয়েছিলেন।

এদিকে তুরস্ক তো আরও এক কাঠি সরস। তারা তাদের দূতকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। নিজামীর আগে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মো. মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা ও মো. কামারুজ্জামানের সাজা কার্যকরের সময়ও এমন প্রতিক্রিয়া এসেছিল পাকিস্তান থেকে। এ কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি করে বিভিন্ন সংগঠন।

নিজামী ছিলেন একাত্তরে আলবদর বাহিনীর নেতা, যে বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের নকশা বাস্তবায়ন করেছিল। আদালতের বিচারে বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের পরিকল্পনা, নির্দেশদাতা হিসেবে দোষী সাব্যস্ত হন নিজামী।

তার মৃত্যুদ- কার্যকরের নিন্দা জানিয়ে বুধবার পাকিস্তানের পার্লামেন্ট একটি নিন্দা প্রস্তাব পাস করে এবং বাংলাদেশের এই ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাটির’ প্রতি দৃষ্টি দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। পরবর্তীতে তলব করা হয় ইসলামাবাদে বাংলাদেশের হাই কমিশনারকে।

তার প্রতিক্রিয়ায় ঢাকায় পাকিস্তানের হাই কমিশনারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে বলা হয়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার মতো অপরাধে দ-িতদের পক্ষ নিয়ে পাকিস্তান সেইসব অপরাধে তাদের সম্পৃক্ততারই প্রমাণ দিচ্ছে।

পাকিস্তানের সিনেটের নেতা রাজা জাফারুল হক বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ দাবি করে তা ঠেকাতে মুসলিম দেশগুলোর যৌথ পরিকল্পনা চান।

এর আগে সিনেট সদস্যরা বাংলাদেশ থেকে রাষ্ট্রদূত ফিরিয়ে নেওয়ায় তুরস্কের প্রশংসা করেন। বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তানেরও ‘শক্ত অবস্থান’ চান তারা।

তবে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহারের বিষয়ে আঙ্কারা আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি বলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানিয়েছেন।

বাংলাদেশে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসি কার্যকরের পর উদ্বেগ জানিয়ে আসা পাকিস্তান এবার বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক

উপদেষ্টা সারতাজ আজিজ পার্লামেন্টে বলেন, বিষয়টি জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল ও অন্যান্য দেশের কাছে তুলে ধরবে পাকিস্তান।

বাংলাদেশ সরকার ‘রাজনৈতিক বিরোধীদের ফাঁসি দিচ্ছে’ দাবি করে তা নিয়ে অধিবেশেনে দুঃখ প্রকাশ করেন সারতাজ। বিষয়টি নিয়ে মুসলিম বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বেগ জানিয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

ডেইলি পাকিস্তানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এভাবে মৃত্যুদ- কার্যকর মানবাধিকার লংঘন এবং বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির লংঘন দাবি করে এ বিষয়ে দৃষ্টি দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান সারতাজ আজিজ।

ইসলামাবাদের এ ধরনের প্রতিক্রিয়াকে ‘অযাচিত হস্তক্ষেপ’ বলে আসছে ঢাকা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিশ্বসম্প্রদায় এসময় পাকিস্তানকে সাপোর্ট করলে পাকিস্তান আবার বাংলাদেশের উপর হামলে পড়ত। যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায় তারা মানতে পারছে না। এটা থেকে প্রমাণিত হচ্ছে পাকিস্তানের যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের বিয়টিও।

এই অবস্থায় পাকিস্তান বাংলাদেশের সম্পর্ক আর টিকবে কিনা- সেটাই বড় প্রশ্নবোধক হয়ে দেখা দিয়েছে। এর আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয় নিয়ে বেশ উত্তপ্ত পরিস্থিতি দেখা গেছে।

ঢাকায় পাকিস্তানের এক কর্মীকে সন্দেহজনক গতিবিধির কারণে আটক করার পর ছেড়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ। আর তারপরই ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাই কমিশনের এক কর্মী নিখোঁজ হন। তিনি নিখোঁজ হওয়ার ছয় ঘণ্টা পর বাসায় ফেরেন। তার নিখোঁজের বিষয়টি বাংলাদেশ থেকেও পাকিস্তান কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছিল।

এই আটক ও নিখোঁজ ঘটনার মধ্যে পাল্টাপাল্টি অনেক কিছু হয়েছে। পাকিস্তানের আটক কর্মীর কাছ থেকে বেশ কিছু ভারতীয় রুপিও উদ্ধার করা হয়েছে।

কথা হচ্ছে, তখন কেমন সন্দেহজনক পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের নাগরিককে আটক করেছিল বাংলাদেশ। এটা আর বেশি জানাজানিও হয়নি। যদিও পাকিস্তানের লোকটি আটক হওয়ার পরপরই বাংলাদেশের নাগরিকের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি বেশ রহস্যজনক। এবং সঙ্গতকারণেই বাংলাদেশ পাকিস্তান দূতাবাসের ওই কর্মিকে আটক করেছিল।

কিন্তু পাকিস্তান ওই ব্যক্তির আটক হওয়ার কোনো কারণই জানতে না চেয়ে তাদের দেশের মধ্যে একজন বাংলাদেশি কর্মীর নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি ছিল বেশ রহস্যজনক। অর্থাৎ পাল্টা ব্যবস্থা নিতে দেরি করেনি তারা। কিন্তু আসল কারণ তলিয়ে দেখতে তাদের কোনো ইচ্ছা ছিল না। তাহলে এসব বিষয়গুলো কি বেশ ইচ্ছাকৃত ঘটনা! দূতাবাসের কর্মীদের

হেনস্থা করে কূটনৈতিক প্রতিশোধ নেয়া হচ্ছে এভাবে। এর আগে আমরা গত কয়েক বছর আগে দেখেছি দুটি দেশের মধ্যে মতের অমিল বা সম্পর্কের মধ্যে গোঁজামিল প্রবেশ করলে দুই দেশের কূটনৈতিক অফিসের কর্মীদের নিয়ে টানা হেচড়া করা হয়েছে। সেখানে ভারতের দেবযানিকে জেলে পর্যন্ত নিয়ে গেছে আমেরিকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের সম্পর্ক জোড়াও লেগেছে।

এখানে আমেরিকা ও ভারতের সম্পর্ক জোড়া লাগার ক্ষেত্রে একটি বড় কারণ আছে। এ সম্পর্ক জোড়া না লাগানো ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। কারণ বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর যে মেরুকরণ আছে তার মধ্যে এই দুই দেশের নিজেদের স্বার্থে মিলে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। তাদের সম্পর্কের মধ্যে অনেকগুলো সমীকরণ ছিল।

এক্ষেত্রে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের বৃহৎ স্বার্থের কোনো সম্পর্ক নেই। যে কারণে এই সম্পর্ক টিকে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু! যেসব ঘটনাগুলো দেখা যাচ্ছে- তা মূলত বৃহৎ কোনো কিছু ঘটার আলামত। যেমন পাকিস্তান জাতিসংঘে যাওয়ার কথা বলছে।

মূলত সাম্প্রতিক সময়ে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে পাকিস্তানের অতিরিক্ত মাথাব্যথার বিষয়টি সকলেই লক্ষ করেছে।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সাকা-মুজাহিদের ফাঁসি হওয়ায় উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। তখন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র কাজী এম খলিলুল্লাহ এক বিবৃতিতে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদেও চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদ- নিয়ে বলেছেন, আমরা গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের সঙ্গে সাকা-মুজাহিদের দুর্ভাগ্যজনক ফাঁসির রায় কার্যকরের ঘটনা লক্ষ করেছি। এ ঘটনায় আমরা গভীরভাবে অসন্তুষ্ট। আমরা এর আগেও দেখেছি, বাংলাদেশে ১৯৭১-এর ঘটনাবলী নিয়ে ত্রুটিপূর্ণ বিচার প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এ বিষয়েও আগের মতো আবারো গুরুত্ব দিচ্ছি। পাকিস্তানের মুখপাত্র বলেন, ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির মূলনীতি অনুসারে বাংলাদেশে আপস-রফা হওয়া উচিত। ওই চুক্তিতে ১৯৭১ প্রশ্নে ভবিষ্যৎমুখী দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলা হয়েছে, যা সদিচ্ছা ও সংহতি জোরদার করবে।’

যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদ- কার্যকরের পরও উদ্বেগ জানিয়েছিল পাকিস্তান। পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সমর্থন করায় কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে দাবি করে সে সময় দেশটির পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাবও গৃহীত হয়।

এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে গণজাগরণমঞ্চসহ বিভিন্ন সংগঠন দাবি তুলে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার। কিন্তু সম্পর্ক ছিন্ন করতে গেলে এটা তিক্ততার একটা পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে।

আর পাকিস্তানের এমন বর্বর প্রতিক্রিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ শুধু কড়া প্রতিবাদ জানিয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের মর্যাদা রক্ষা সম্ভব হবে না। কারণ আমরা জানি না প্রতিবাদ কোন পর্যায়ের হলে সেটা কড়া প্রতিবাদ হয়। আর সেই পর্যায় অতিক্রম করার পর নিশ্চয়ই পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া যায়। কারণ তাদের বার বার একই ধরনের ঘটনায় বার বার কড়া প্রতিবাদ জানালেই চলবে না। তাদের প্রতিক্রিয়ার যথোপযুক্ত পাল্টা প্রতিক্রিয়া থাকতে হবে। সেটা নিশ্চয়ই দেশবাসী আশা করে।

এবং পাকিস্তান বলেছে- তারা জাতিসংঘে যাবে। তারা আগাম একটি হুমকিও দিয়ে রেখেছে। তারপর তারা মুসলিমবিশ্বকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়ার কথা বলেছে। তারা কিন্তু বাংলাদেশকে থ্রেট করছে অব্যাহতভাবে।

এবং আরও মনে রাখতে হবে- আরও কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এখনও বাকি আছে। তারা কিন্তু তখনও নতুন করে বাংলাদেশের নিজস্ব ব্যাপার নিয়ে কথা বলবে। তখন পরিস্থিতি অন্যরকম খারাপ হতে পারে।

নিজামীর ফাঁসির পর শুধু পাকিস্তান নয়, তুরস্কের প্রতিক্রিয়া পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। পাকিস্তান যতটা তাদের আত্মার আত্মীয়কে হারায়নি ততটা হারিয়েছে তুরস্ক। বিচারের মাঝামাঝি সময়েও তুরস্কের সরকার প্রধান বাংলাদেশের এই বিচার নিয়ে নানা টালবাহানা করেছিল। হয়তো পাকিস্তানের কারণে নয়- তুরস্ক বাংলাদেশের কতটা ক্ষতি করছে সেটা দেখা এখন অত্যন্ত জরুরি। কারণ পাকিস্তানের বক্তব্য বিশ্বের কাছে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।

সুরেশ কুমার দাশ বার্তা প্রযোজক, বাংলাদেশ টেলিভিশন