শান্তনু চৌধুরী : সফলতা আসলে কী? গানে গানে নচিকেতা বলছেন, দেশে যতো সিস্টেম চলছে সব মেনে নাও! ‘যদি চাও সফলতা, মেনে নাও এই সিস্টেম, ফেলে দাও স্রোতের মুখে, আদর্শ, বিবেক ও প্রেম।
এ সমাজ মানবে তোমায়, গাইবে তোমারই জয়গান’। আসলে কি তাই? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া একটা গল্প বলি। এক মৃত ব্যক্তির পকেট থেকে পাওয়া অসাধারণ একটি চিঠি- যখন জন্মালাম বাবা-মা ভাবল এটা তাদের ‘সাকসেস’! যখন হাঁটতে শিখলাম মনে হল এটাই ‘সাকসেস’! যখন কথা বলতে শিখলাম মনে হল এটাই ‘সাকসেস’! এরপর স্কুলে গেলাম, শিখলাম ‘সাকসেস’ হওয়াটা বা সবার চেয়ে বেশি নম্বর পাওয়াই ‘সাকসেস’! এরপর বুঝলাম, না, আসলে মাধ্যমিকে স্টার পাওয়াটাই ‘সাকসেস’! ভুল ভাঙল, বুঝলাম উচ্চমাধ্যমিকে এই রেজাল্টটা ধরে রাখাই ‘সাকসেস’!
এখানেই শেষ নয়, এরপর বুঝলাম ভালো সাবজেক্ট নিয়ে ভালো কোনো জায়গায় চান্স পাওয়াটাই ‘সাকসেস’, যেটা পড়লে একটা ভালো চাকরি পাওয়া যাবে। আরো পরে বুঝলাম যে, পড়া শেষে ভালো চাকরি পাওয়া এবং অনেক রোজগার করাটাই ‘সাকসেস’।
এরপর বুঝলাম, নিজের টাকায় একটি ছোট বাড়ি করাই ‘সাকসেস’। পরে বুঝলাম, সেটাও নয়, নিজের টাকায় এরপর গাড়ি কেনাটাই আসল ‘সাকসেস’! আবার ভুল ভাঙল, এরপর দেখলাম ভাল দেখে বিয়ে করে সুখে সংসার করাটাই আসল ‘সাকসেস’। বছর ঘুরলো, দেখলাম আসলে বিয়ে করে বংশধর এনে তাকে ভালোভাবে বড় করাটাই ‘সাকসেস’, ছেলে হলে তাকে প্রতিষ্ঠিত করাটাই ‘সাকসেস’, মেয়ে হলে একটা ভালো ফ্যামেলির ভালো চাকুরে ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়াটাই ‘সাকসেস’।
এরপর এলো আমার রিটায়ারমেন্ট, সারা জীবনের জমানো টাকার সঠিক বিনিয়োগ করে করে লাভ করতে পারাটাই ‘সাকসেস’! এরপর যখন সবাই মিলে একাকি কবরে রেখে মাটি চাপার প্রস্তুতি নিল, মরার একটু আগেই বুঝলাম, পৃথিবীতে ‘সাকসেস’ বলে কোনও কিছুই স্থায়ী লক্ষ্য নেই! পুরোটাই এগিয়ে যাওয়ার জন্য নিজের তৈরি করা একটা প্রতিযোগিতা। যার মূলে আছে আকাশছোঁয়া আকাক্সক্ষা, যা কখনো পূর্ণ হবার নয়। তখন বুঝতে পারলাম এর থেকে জীবনের প্রতিদিন বা প্রতি মুহূর্ত আনন্দের সঙ্গে সুস্থ থাকা ও অন্যের জন্য কাজ করতে পারাই ‘সাকসেস’ এর মূল লক্ষ্য হলে অনেক ভালো হতো! কিন্তু এটা বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলেছি। তাই মনে হয়, জীবনকে খুঁজুন, জীবনকে বুঝুন! নিজেকে ভালবাসুন। অন্যদের সম্মান দিন, ভালোবাসুন। বিশেষ করে যাদের ভালবাসার খুবই প্রয়োজন। শেষ অবধি ভালবাসাপূর্ণ, আনন্দঘন আর সুস্থ একটি জীবনযাত্রা সম্পন্ন করতে পারাই সফলতা!
আসলে সফল হতে গেলে কী করতে হয় এটার কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। হয়তো আমরা মাঝে মাঝে পড়ি, সফল যারা কেমন তারা। কেউ হয়তো স্কুল পালিয়ে রবীন্দ্রনাথ হতে পারেন, আবার কেউ বখে যাওয়া ছেলে। কেউবা ১০ টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করে একদিন ১০ হাজার কোটি টাকার মালিক হন। আবার কেউ ঠিকমতো উঠেই দাঁড়াতে পারেন না। এই যে, আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনের কথাই যদি বলি। কতো কতো ছাড় দেওয়া বা মানিয়ে চলার মানসিকতা তাদের।
আবারো সামাজিক ফেসবুক থেকে পাওয়া গল্প বলি। মিডলক্লাস ফ্যামিলির ছেলে-মেয়েগুলো খুব ছোটবেলা থেকে যে জিনিসটা শিখে…সেটা হলো কম্প্রোমাইজ। তাদের বাথরুমে শেষ হয়ে যাওয়া একটি শ্যাম্পুর বোতল সবার অলক্ষে দিনের পর দিন পড়ে থাকে। সেই বোতলে সুযোগমতো কেউ না কেউ পানি ঢুকিয়ে রাখে। টুথপেস্ট শেষ হয়ে গেলে সেই টিউবের গলা কেটে টিপে টিপে পেস্ট বের করাটাও নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। বড় ভাইয়ের শখের জ্যাকেট অথবা বড় বোনের পছন্দের কামিজ এখানে বাতিল বলে ফেলে দেওয়া হয় না। ছোটরা নিশ্চিন্ত মনে সেগুলো বছরের পর বছর পরে যেতে পারে। এখানে হরলিক্স বা মালটোবার বোতলে আচার শোভা পায়। আগের কেনা পুরোনো বিস্কুটের টিনে মুড়ি। এদের বাসার শোকেসে শুধুমাত্র শো-পিস ছাড়াও ডিনার সেট এবং নতুন থালা-বাসন গ্লাসও রাখা হয়। যেগুলো শুধু অতিথিদের জন্যে বরাদ্দ। এখানে মা সন্তানের গৃহশিক্ষক একদিন পড়াতে না এলে চিন্তায় অধীর হন। এই ছেলেমেয়েগুলো জন্মদিনে খুব পাংশুমুখে ঘুরে বেড়ায়, সারাদিন বাসায় কাটায়। রেস্টুরেন্টে বসে কেট কেটে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে খাওয়াটা অনেকটা ড্রিম কাম ট্রুর মতো।
ঈদের বাজারে কোনও পাঞ্জাবি বা জামা খুব বেশি পছন্দ হলেও বাবার অসহায় মুখ দেখে হাসিমুখে বলতে পারে, ‘এটার রঙটা তেমন সুন্দর না…অন্যটা দেখি…’। এরা হাফ কেজি আইসক্রিম সব ভাইবোন মিলে খেতে জানে। পুরোনো কোনো প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে হঠাৎ একশ’ টাকার কোনো নোট পাওয়া গেলে বন্ধুদের সঙ্গে সেই গল্প করতে করতে এরা সারাদিন আনন্দ নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারে। বাসা থেকে বাইরে যাবার সময় লুকিয়ে লুকিয়ে বড় ভাইয়ের বডি-স্প্রেটা একটু লাগিয়ে নিতে ভুল করে না সদ্য কলেজ শুরু করা ছোট ভাইটা। প্রেমিকার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে ছেলেগুলো প্রেমিকার কাঁধে হাত রেখে বলতে পারে না, ‘তুমি শুধু আমার হবে’। এরা নিচু স্বরে বলে, ‘আচ্ছা…আমি ব্যাপারটা দেখবো’। মেয়েরা কারো ভালোবাসায় দিন-রাত অন্তরে কষ্ট পুষে রাখলেও সেই ভালোবাসার প্রকাশ এখানে বালিশের কভারে চোখের জল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। বাবা-মার কান পর্যন্ত সেই ভালোবাসার কথা পৌঁছায় না। মিডলক্লাস মানুষরা আছে বলেই শহরের সমস্ত রিকশাগুলো…প্রায়ই একই ছাতার নিচে দেখা যায় মা-ছেলে বা বাবা-মেয়েকে’।
আমাদের দেশে এখন কর দেওয়ার মওসুম চলছে। কিন্তু সেই করদাতার শীর্ষ তালিকায় পাওয়া যাবে না কোনো শীর্ষ ব্যবসায়ীকে। যাদের আমরা সাকসেস বলি। যাদের নাম সবার মুখে মুখে। কারণ তাদের দখলে মিডিয়া। কেন তারা শীর্ষ হন না। কারণ তারা শিখে গেছে ফাঁকি দেওয়ার ফাঁক-ফোকর। তাই শীর্ষ করদাতা হন জর্দা ব্যবসায়ী কাউছ মিয়া।
এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি লেখার অংশবিশেষ তুলে ধরছি। ‘দুনিয়াজুড়েই এখন শীর্ষ ধনীদের তালিকা তৈরির একটি রেওয়াজ আছে। বিল গেটসের সম্পদ বাড়া বা কমার খবরের পাঠক কম নেই। এখন তো প্রতিদিনই ইলন মাস্ক বা জেফ বেজোসের সম্পদের ওঠানামার নানা তথ্য প্রকাশ হচ্ছে। অনায়াসেই আমরা জানতে পারি পাশের দেশ ভারতের শীর্ষ ধনী কারা। কিন্তু বাংলাদেশে সবকিছুই গোপন। আয় বা সম্পদের প্রকৃত হিসাব দেওয়ার অর্থই হচ্ছে এর বিপরীতে কর দেওয়া হয়েছে। আর আমাদের এখানে সব চেষ্টাই যেখানে কর ফাঁকি দেওয়া, সেখানে সম্পদের হিসাব পাওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই। তাই প্রতিষ্ঠিত অনেক বড় ব্যবসায়ী কোনো অভিজাত তালিকাতেই স্থান পান না, পেতে সম্ভবত চানও না। যদিও অভিজাত জীবনযাপন তাঁদের খুবই পছন্দের। রবীন্দ্রনাথ যেমনটা বলেছিলেন, ‘ধন জিনিসটাকে আমাদের দেশ সচেতনভাবে অনুভব করিতেই পারিল না, এই জন্য আমাদের দেশের কৃপণতাও কুশ্রী, বিলাসও বীভৎস (বোম্বাই শহর, পথের সঞ্চয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)’।
শান্তনু চৌধুরী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক