জেসমিন কাউছার : ১৯৯৪ সালে উচ্চমাধ্যমিক টেস্ট পরীক্ষার সময়ই আমার বিয়ে হয়ে যায়। তখন বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর। যেহেতু বিয়ের কারণে পরীক্ষা দেওয়া হয়নি, ইচ্ছে ছিল পরের বছরই পরীক্ষাটা দিয়ে দিবো। কিন্তু প্রথম সন্তানের জন্মের কারণে সেই আশার প্রদীপ আবারও নিভে যায়। যদিও নানা বাধাবিপত্তি পার করে শেষমেশ ১৯৯৭ সালে আমি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি, উত্তীর্ণ হয়েছি দ্বিতীয় বিভাগে। দেড় বছরের বাচ্চা নিয়ে হারিকেনের আলোয় পড়ালেখা করে এমন সাফল্যের পর যেভাবে খুশি হয়েছিলাম, বোধহয় ওই সময় মিলিয়ন ডলার প্রাপ্তিতেও এমন আনন্দ পেতাম না।
পড়ালেখার এই বন্ধুর পথে আমি ভাগ্যক্রমেই পাশে পেয়েছিলাম আমার শ্বশুর-শাশুড়িকে। তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা থাকবে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অবধি। তারা ছিলেন নিভৃতচারী মানুষ, বরাবরই প্রাপ্য স্বীকৃতি থেকে হয়েছেন বঞ্চিত। আমার জীবনে অনস্বীকার্য অবদান রাখা এই দুজন মানুষের পরিচয় খানিকটা তুলে ধরে কিছুটা স্মৃতিচারণ না করলে ঠিক তৃপ্তি পাচ্ছি না। অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ মানুষ দুটিকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে চাই, বলতে পারেন ট্রিবিউট।
আমার শ্বশুর আব্বা মরহুম আলহাজ্ব খায়ের আহমদ তালুকদার ছিলেন সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগী। নিজেও ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। আজ থেকে ৭০ বছর আগে অত্যন্ত প্রত্যন্ত এলাকায় লেখাপড়া করা তো দূরের কথা এর চিন্তা করাও ছিল বিলাসিতা। ঠিক সেই সময়টায় মেট্রিকুলেশন (১৯৪৯) ও ইন্টারমিডিয়েট (১৯৫১) পাশ করা খায়ের আহমেদ তালুকদারকে উচ্চশিক্ষিতই ধরে নিতেন অঞ্চলবাসী। ইংরেজি ভাষায় তাঁর ছিল অসাধারণ পাণ্ডিত্য।
অন্যদিকে শাশুড়ি মা মরহুমা জাহানারা বেগম ছিলেন ‘আয়রন লেডি’। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এলাকার সর্বস্তরের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন সৌন্দর্যের-শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক। ছিলেন স্থানীয় নারীসমাজের আদর্শ। নারীসমাজের অবরুদ্ধতার বৃত্ত ভেঙে দিয়ে চার দেয়ালের গণ্ডি ভেদ করে তিনি বেরিয়ে পড়েছিলেন ঘরের বাইরে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এক নাগাড়ে ১৫ বছর জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব (ইউপি মেম্বার) নিষ্ঠায় সঙ্গে পালন করেছিলেন। গ্রাম্য সালিশ-বিচারে যুক্ত হয়ে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায়ও রাখেন অনস্বীকার্য ভূমিকা।
পড়ালেখায় আমার অদম্য আগ্রহ দেখে তারাও চেয়েছিলেন আমি যেন পড়ি। শ্বশুর আব্বা কদর বুঝেছিলেন লেখাপড়ার আর শাশুড়ি মা বিশ্বাসী ছিলেন নারীর অধিকার বাস্তবায়নে। দুজনের ভিন্ন বিশ্বাসের যুগলবন্দী আমার জন্য হয়ে ওঠেছিল সাপের মনির মত। ১৯৯৭ সালে শ্বশুর আব্বা আমাকে দুবছর মেয়াদি কোর্সে ভর্তি করিয়ে দেন দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া পদুয়া ডিগ্রী কলেজে। বলেছিলেন, তুমি ডিগ্রী (বিএ) পরীক্ষা দাও, আমি তোমাকে পড়াবো। শ্বশুর আব্বার সাহচর্যে সহজেই পড়াশোনা আয়ত্ত করে ফেলেছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের কারণে সেই সাধের পরীক্ষা দেওয়া হলো না।
পরবর্তীতে সেই পরীক্ষা দিতে পেরেছি ২০০১ সালে। স্বামী-সন্তান, সংসার সামলানোর পর দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়াটাও আমার কাছে ছিল অনেক বেশি মূল্যবান। ইচ্ছে ছিল মাস্টার্সে ভর্তি হওয়ার। আমার এই ইচ্ছে দেখে শ্বশুর আব্বা বলতেন- তুমি মাস্টার্স পাশ না করলে আমার কলিজা পঁচবে না (আত্মার শান্তি)। যদিও সেসময় নিজের সাধ আর শ্বশুর আব্বার সেই ইচ্ছে পূরণ করা হয়নি, আসলে করতে পারিনি। কারণ স্বামীর চাকরির জন্য সন্তানদের নিয়ে কখনও ঢাকা আবার কখনও চট্টগ্রাম শহরে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে।
২০০৮ সালে শাশুড়ি আম্মা বললেন, আমার খুব ইচ্ছে তুমি এই গ্রামের (উত্তর পদুয়া) ছেলে-মেয়েদের শিক্ষায় সহযোগিতা করো। তাঁর ইচ্ছাতেই ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে উত্তর পদুয়া বহুমুখী বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করি। এসময় আমার প্রয়োজন পড়ে বিএড-এর। ২০০৯-২০১০ শিক্ষাবর্ষে বিএড পাশ করি। মজার বিষয় হলো, আমি এবারও উত্তীর্ণ হয়েছিলাম দ্বিতীয় বিভাগে। শাশুড়ি আম্মা বলতেন- ধারাবাহিকতায় যে সাফল্য আসে তার রেশ রয়ে যায় যুগের পর যুগ। তাহলে কি সেইটাই হচ্ছিল?
সে-যাই হোক, শ্বশুর আব্বা যে বলেছিলেন- ‘তুমি মাস্টার্স পাশ না করলে আমার কলিজা পঁচবে না’, এদিকে আমারও শেষ স্বপ্ন আমি মাস্টার্স পাশ করবো। সবমিলিয়ে মন বলছিল এবার নয় তো আর কখনোই নয়। দুচোখ বন্ধ করে সিদ্ধান্ত নিলাম ভর্তি হবো মাস্টার্সে। ২০১০ সালে চট্টগ্রাম কলেজে রাস্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে ভর্তি হই মাস্টার্স (এম.এস.এস) কোর্সে। আমার ভাগ্যে বোধহয় পড়ালেখা সহ্য হয় না। ভর্তি হওয়ার পর কোনো না কোনো সমস্যায় পিছিয়ে যায় আমার স্বপ্নের পড়াশোনা। যদিও এবার বাধ সেধেছিলেন আমার স্বামী। বলেছিলেন, অনেক হয়েছে, আর দরকার নেই লেখাপড়ার।
স্বামী চাননি, দেননি অনুমতি। সম্মান করেছি তাঁকে। শ্বশুর আব্বার ইচ্ছে আর আমার সাধ দুটোই অতৃপ্ত রয়ে গেলো। এরপর পার হয়েছে দীর্ঘ ১১ বছর। অতিক্রান্ত হয়েছে প্রায় এক যুগ। এই সময়ে এমন একটি দিন যায়নি, যেদিন আমার আফসোস হয়নি। স্বামীকে প্রতি বছরই বলতাম মাস্টার্সে ভর্তির কথা। কিন্তু তাকে রাজি করাতে পারিনি। এর দোষ অবশ্য আমি নিজেকেই দেই। এখন মনে হয়, হয়তো আমি ঠিকমত বোঝাতে পারিনি। শেষমেশ বুঝতে পারলাম আমি আসলেই তাকে ঠিকঠাক মত বোঝাতে পারিনি। কারণ ২০২১ সালে এসে, তিনি আমাকে ভর্তি হওয়ার অনুমতি দেন।
আমি আমার সন্তানদের প্রায়শই বলতাম, আমি মাস্টার্স তোদের সাথে হলেও পড়বো। হাল ছাড়বো না। কাকতালীয়ভাবে আমার বড় ছেলে এখন মাস্টার্সে পড়ছে। হয়তো আমার সেই চাওয়াটা সত্য হতে পারতো, কিন্তু এবারও হচ্ছে না। প্রতিবারের মত এবারও আমার সামনে আসলো বিরাট বাধা। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মের বেড়াজালে নিয়মিত কিংবা অনিয়মিত কোনো ভাবেই আমি ভর্তি হতে পারছি না মাস্টার্সে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ আছে, সেই খরচের ভার যে আমার জন্য বড্ড বেশি।
প্রবাদে আছে ‘শিক্ষার কোনো বয়স নেই। কিন্তু আমি আটকে গেলাম বয়সের (শিক্ষাবর্ষ) বেড়াজালে। আজকের ডিজিটাল যুগে এসেও কেন এই অসংগতি? বয়সের এই নিয়মনীতি কতটা যৌক্তিক? কেন আমার মত স্বপ্নবাজরা দেখতে পারবে না উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন? ৪৫ বছর বয়সে আমি তো আর সরকারি চাকরি করবো না! তাহলে কেন শিক্ষা নামের মৌলিক অধিকার থেকে আমাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে?
আমি শুধু নিজের কথা বলছি না, বলছি আমার মত শত শত নর-নারীর কথা। দেশের নাগরিকদের শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়া যেখানে সরকারের দায়িত্ব, সেখানে এই অযৌক্তিক নিয়ম করা আসলে কতটুকু যুক্তিযুক্ত? সরকারের কাছে আমার আর্জি, উচ্চশিক্ষা নেয়ার সুযোগ যেন সবাইকে দেওয়া হয়। তুলে দেওয়া হোক সেশন নামক বয়সের বেড়াজাল। আমি বিশ্বাস করি, আমার সোনার বাংলায় উচ্চশিক্ষা লাভ করতে এতটুকু সুযোগ আমরা পেতেই পারি, এতে সরকারের ক্ষতি হবে না নিশ্চয়ই, বরং বাড়বে গৌরব।
লেখক : সাবেক শিক্ষিকা, উত্তর পদুয়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।