জসিম উদ্দিন, কক্সবাজার : কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে মোবাইল নেটওয়ার্কের পরিবর্তে ওয়াকিটকি ব্যবহার করছে রোহিঙ্গা দুর্বৃত্তরা। এসব কারণে অপরাধ সংগঠিত হলেও অপরাধীদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
সম্প্রতি রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ ও ৬ ছাত্র-শিক্ষক হত্যার পর ক্যাম্পে দুর্বৃত্তদের অপরাধকাণ্ড আলোচনায় এসেছে। দেশের ঊর্ধ্বতন মহল ছাড়াও বিশ্বজুড়ে আলোচনার প্রসঙ্গ হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নৃশংসতা। বিশ্বের প্রধান প্রধান গণমাধ্যমে এ বিষয়ে ফলাও করে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
প্রশ্ন উঠছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এত কঠোর অবস্থানের মাঝেও, বিপথগামী রোহিঙ্গারা কীভাবে একের পর এক হত্যাকান্ড ঘটাচ্ছে? তবে ক্যাম্পে অপরাধ সংগঠনের বিষয়ে যোগাযোগ সংক্রান্ত আলোচনাগুলো গণমাধ্যমে সেভাবে আলোচিত হয়নি।
এ বিষয়ে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, প্রথমত অপরাধের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের মোবাইল নেটওয়ার্ক নিয়ে সেদেশের সিমকার্ড ব্যবহার করছে। আর ক্যাম্পে অপরাধকান্ডে রোহিঙ্গা অপরাধীরা ব্যবহার করছে নিজস্ব ওয়াকিটকি।
মোবাইলের পরিবর্তে নির্দিষ্ট দূরত্বের জন্য অপরাধীরা শক্তিশালী ওয়াকিটকি ব্যবহার করার ফলে, অনেক সময় অপরাধীদের পরিকল্পনা ও হামলার বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের অগোচরে থাকছে।
রোহিঙ্গা নেতা হামিদ উল্লাহ জানান, অসংখ্য রোহিঙ্গা দুর্বৃত্তদের হাতে ওয়াকিটকি রয়েছে। যেকোন অপরাধ কর্মকাণ্ডের আগে যোগাযোগ রক্ষায় এসব ওয়াকিটকির ব্যবহার বাড়িয়ে দেয় অপরাধীরা। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মোবাইল সেবাদাতাদের সিম নেটওয়ার্ক সিগন্যাল অনেক সময় ক্যাম্পের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যায় না। সেসব এলাকায় ওয়াকিটকি-ই যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এসব ওয়াকিটকি ও মিয়ানমারের নেটওয়ার্ক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা গেলে, ক্যাম্পে অপরাধীদের তৎপরতা অনেকাংশে কমে আসবে বলে মনে করেন রোহিঙ্গা এ নেতা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সর্বশেষ রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ ও ছয় ছাত্র-শিক্ষক খুনের ঘটনায় ওয়াকিটকির মাধ্যমে নিজেদের মাঝে যোগাযোগ রক্ষা করেছে হত্যাকারীরা। এ কারণে ঘটনার পর অপরাধী শনাক্তে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ব্যবহৃত নেটওয়ার্ক ট্র্যাকিংয়ের আওতায় আনা হলেও, কাউকে শনাক্ত করা যায়নি। তবে কারা এসব ওয়াকিটকি অপরাধীদের সরবরাহ করছে- তা অনুসন্ধানে তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছেন ক্যাম্প সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, কক্সবাজার র্যাব-১৫ এর একটি দলের হাতে গত ৪ জুলাই কক্সবাজার লিংক রোড এলাকায় থেকে ৮টি ওয়াকিটকি-সহ দুই রোহিঙ্গা গ্রেফতার হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা এসব ওয়াকিটকি ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছিল বলে স্বীকারোক্তি দেয়।
আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র জানিয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অভিযানে বেশ কিছু ওয়াকিটকি উদ্ধার হয়েছে। তবে এসব যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে রোহিঙ্গা অপরাধীদের অপরাধ ও অবস্থান নিশ্চিত করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
প্রতিবেদকের হাতে আসা রোহিঙ্গা অপরাধীদের কিছু চিত্রে দেখা যায়, অস্ত্রধারী প্রতিজনের কাছে আধুনিক ওয়াকিটকি রয়েছে। গত ৪ জুলাই ৮টি ওয়াকিটকি-সহ র্যাবের হাতে আটক কক্সবাজার পৌরসভার সমিতি পাড়ার হাসিম মাঝির বাড়ির ভাড়াটিয়া রোহিঙ্গা যুবক মোহাম্মদ আব্বাস (৩২) এবং টেকনাফ ২৪ নম্বর ক্যাম্পের ব্লক-বি-১-এর বাসিন্দা নূর মোহাম্মদের ছেলে ইমাম হোসাইন (২০); তারা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ক্যাম্পে অপরাধমূলক কাজে শক্তিশালী ওয়াকিটকি ব্যবহারের কথা স্বীকার করেছিলেন।
এসময় আইনশৃংখলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, তাদের পেছনে আর কারা কারা রয়েছে, তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে।
মিয়ানমারে জাতিগত সংঘাতের পর প্রাণে বাঁচতে বিভিন্ন সময় পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন সোয়া ১১ লাখ রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার সহযোগিতায় সরকার কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি শিবিরে আশ্রয় দেয় বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের। আশ্রয় পাবার চার বছরে নিজেরা নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়া থেকে শুরু করে মাদক ব্যবসা, চুরি, ডাকাতি, খুন, অপহরণ, মানব পাচার এবং ধর্ষণসহ ১২ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের একটি অংশ।
ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানের পরও অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
জেলা পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, গেল ৪৯ মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘর্ষের ঘটনায় ২৩৪ জন নিহত হয়েছে। ১২ ধরনের অপরাধে মামলা হয়েছে প্রায় এক হাজার ৩০১টি। এতে আসামি হয়েছে ২ হাজার ৯৪৫ রোহিঙ্গা। সর্বশেষ রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ ও ৬ ছাত্র-শিক্ষক হত্যার ঘটনা সবাইকে বিচলিত করেছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে রোহিঙ্গাদের অনেক নেতা জানিয়েছেন, বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অবস্থা এমন যে, দিনে বাংলাদেশ সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করলেও, রাতে অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় পুরো ক্যাম্প। কথিত ‘আরসা’ সংগঠনের সশস্ত্র ক্যাডারাই অস্ত্রের মহড়া দিয়ে আতংক সৃষ্টি করে। সেনাবাহিনীর আদলে তৈরি করা পোষাক পড়ে থাকা এসব ক্যাডারদের হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্র এবং তারা নিজেদের যোগাযোগ রক্ষা করতে ব্যবহার করে শক্তিশালী ওয়াকিটকি।
ক্যাম্প সূত্রমতে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কথিত ‘আরসা’, ‘আল ইয়াকিন’ ছাড়াও ১৪টি অপরাধী দল সক্রিয় রয়েছে। এসব অপরাধী দলের নেতৃত্বে চলে মাদক ব্যবসা, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, আধিপত্য বিস্তারে সশস্ত্র মহড়া, অপহরণ, মানবপাচার ও ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধ। তাদের ভয়ে মুখ খুলতে পারেন না সাধারণ রোহিঙ্গারা। অপরাধ সংগঠিত করার আগে পুরো পরিকল্পনা সদস্যদের কাছে ওয়াকিটকির মাধ্যমে চলে যায়। ফলে অপরাধ সংগঠিত করার পরও নিরাপদে গা ঢাকা দিতে পড়তে পারে অপরাধীরা।
ক্যাম্পে রোহিঙ্গা অপরাধীদের ওয়াকিটকি ব্যবহার বিষয়ে ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন-১৪) এর অধিনায়ক (এসপি) মো. নাইমুল হক বলেন, অপরাধীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিতে বাংলাদেশী নেটওয়ার্কের পরিবর্তে ভিন্ন নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে থাকে। এ কারণে তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া কষ্টসাধ্য।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, দুর্বৃত্তরা অপরাধ কর্মকাণ্ড ঘটানোর ক্ষেত্রে ওয়াকিটকি ও মিয়ানমারের নেটওয়ার্কের এমপিটি সিম ব্যবহার করছে বলে জানা যাচ্ছে। এসব কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তা নিয়ে কাজ চলছে। এরই মধ্যে ক্যাম্পে নিয়োজিত আইনশৃংখলা বাহিনী ও বিভিন্ন সংস্থাকে এনিয়ে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে।
ক্যাম্পের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, সামনে যেকোন ধরনের অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে ক্যাম্পে কর্মরত সকল সংস্থার সমন্বয় বাড়ানো হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি।