বিজয় স্মরণী কলেজের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ


জোবায়েদ ইবনে শাহাদত : বিজয় স্মরণী কলেজ নিয়ে বিতর্ক যেন থামছেই না। এবার অভিযোগ উঠেছে কলেজ অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ আবু জাফর সিদ্দিকীকে নিয়ে। অভিযোগ, ব্যক্তি স্বার্থ সিদ্ধির জন্য নিয়ম লঙ্ঘন করে নিজের কাছের লোকজনের সমন্বয়ে কলেজের এডহক কমিটির গঠনের পাঁয়তারা করছিলেন কলেজ অধ্যক্ষ। এক্ষেত্রে তিনি কলেজের বিভিন্ন কার্যক্রমে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত মোহাম্মদ আজমকে এডহক কমিটি সভাপতি করতে চেয়েছিলেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

যদিও অভিযুক্ত কলেজ অধ্যক্ষ আবু জাফর সিদ্দিকীর দাবি, এডহক কমিটি সংক্রান্ত কোনো কর্মকাণ্ডের সাথে তিনি জড়িত নন, তাকে ফাঁসানোর জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে সংঘবদ্ধ একটি মহল। তবে একুশে পত্রিকার হাতে আসা এ সংক্রান্ত বেশ কিছু নথি থেকে মিলেছে অভিযোগের সত্যতা।

নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এডহক কমিটি অনুমােদনের জন্য আবেদন করে বিজয় স্মরণী কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) মােহাম্মদ আবু জাফর সিদ্দিকী স্বাক্ষরিত ও কলেজ অধ্যক্ষের সীল সম্বলিত একটি চিঠি (স্মারক- ৬৮০২/২০২১) গত ১৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক বরাবর পাঠানো হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছকে (ফরম) সভাপতি হিসেবে মোহাম্মদ আজম এবং বিদ্যোৎসাহী সদস্যের জন্য শাহ মোহাম্মদ ইমরান চৌধুরীর নামের প্রস্তাবনার পাশাপাশি তাদের জীবনবৃত্তান্ত ও সনদের কপি সংযুক্ত করা হয় সেই চিঠির সাথে।

চিঠিতে কোভিড-১৯ মহামারি ও বিভিন্ন কারণে নিয়মিত গভর্নিং বডি গঠন করা সম্ভব হয়নি উল্লেখ করে কলেজ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে অব্যাহত রাখতে প্রস্তাবিত এডহক কমিটি অনুমোদনের অনুরোধ জানানো হয়। যদিও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজ/শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহের গভর্নিং বডি (সংশোধিত) সংবিধি ২০১৯ অনুযায়ী, কোন কলেজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গভর্নিং বডি পুনর্গঠনে ব্যর্থ হলে এর এডহক কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সভাপতি ও বিদ্যোৎসাহী সদস্যের মনোনয়ন দেওয়ার এখতিয়ার রাখেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সংবিধির নির্দেশনা তোয়াক্কা না করে বিজয় স্মরণী কলেজ অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) আবু জাফর সিদ্দিকীর স্বপ্রণোদিত অবৈধ কর্মকাণ্ডে সমালোচনার ঝড় বইছে সংশ্লিষ্ট মহলে। এ ঘটনা জানাজানির পর এমনটাও শোনা যাচ্ছে, মোটা অংকের অর্থ লেনদেনের বিনিময়ে এমন নিয়ম লঙ্ঘনের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন কলেজ অধ্যক্ষ আবু জাফর সিদ্দিকী।

এদিকে, কলেজ অধ্যক্ষের এসব কার্যকলাপের পর নতুন করে সামনে চলে এসেছে তার পূর্বের অনিয়ম অসংগতির অভিযোগের বিষয়গুলো। এর আগে নিয়োগবিধি লঙ্ঘন করে কলেজের সহকারী অধ্যাপক কামাল উদ্দিনের প্রভাষকের চাকরির বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষণ বিভাগের তদন্ত প্রতিবেদন গোপনের অভিযোগ ওঠে কলেজ অধ্যক্ষ আবু জাফর সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে। এমনকি রক্ষাকবচের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে কামাল উদ্দিনকে নির্বাচন ছাড়াই নিয়মবহির্ভূতভাবে গভর্নিং এডহক কমিটির শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচিত করার অভিযোগও ওঠে কলেজ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে।

শুধু তাই নয়, বিজয় স্মরণী কলেজের গত এডহক কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আজমের (কলেজ অধ্যক্ষ কর্তৃক প্রস্তাবিত এডহক কমিটির সভাপতি হিসেবে মনোনীত) আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় কলেজের বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমে নিজের ইচ্ছেমতো কলকাঠি নাড়াসহ অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও আছে আবু জাফর সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে।

কলেজ সংশ্লিষ্টদের মতে, ফেনী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও কলেজটির এডহক কমিটির সভাপতি প্রফেসর ড. ফশিউল আলমকে বাদ দিয়ে মোহাম্মদ আজমকে সভাপতির করার প্রস্তাবের পেছনে শুধু তাদের এই জোটকে শক্তিশালী ও পাকাপোক্ত ছাড়াও রয়েছে আরও কিছু কারণ। শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনে নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগ পেয়ে এই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য লিখিত প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানতে চাওয়া ও পুনরায় নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার নির্দেশ দেওয়ার কারণেই অধ্যক্ষ আবু জাফর সিদ্দিকীর চক্ষুশূল হয়েছিলেন ড. ফশিউল আলম।

যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিজয় স্মরণী কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) আবু জাফর সিদ্দিকী। একুশে পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘অধ্যক্ষ তো এডহক কমিটি করতে পারে না, করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর। কমিটির অনুমোদন আমি কীভাবে চাইবো? পূর্বের এবং বর্তমান এডহক কমিটি করেছিলেন ভাইস-চ্যান্সেলর। এগুলো সত্য নয়। এডহক কমিটির জন্য নাম প্রস্তাব করে কোন চিঠি পাঠানো হয়নি। এমন কোনো আবেদন আমরা করতে পারিনি।’

স্বাক্ষর জাল করার অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, ‘যে স্বাক্ষরের কথা বলছেন সেটা আমার স্বাক্ষর না, আর সীলটাও আমাদের কলেজের নয়। স্বাক্ষর কিংবা সীল আমি দেখিনি। তবে আমি শুনেছি সীল এবং স্বাক্ষর আমার না। আর আজকাল স্বাক্ষর তো স্ক্যান করেও নেওয়া যায়। স্বাক্ষর জালিয়াতি করে এটা কেউ করতে পারে। আমি এরকম কিছু করিনি, এ বিষয়ে কিছুই জানি না।’

যদিও নামের প্রস্তাবনাসহ এডহক কমিটির অনুমােদনের জন্য আবেদন করে বিজয় স্মরণী কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) মােহাম্মদ আবু জাফর সিদ্দিকী স্বাক্ষরিত ও কলেজ অধ্যক্ষের সীল সম্বলিত চিঠি পাওয়ার বিষয়টি একুশে পত্রিকাকে নিশ্চিত করেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কলেজ পরিদর্শক ফাহিমা সুলতানা।

এর আগে গত ৩ সেপ্টেম্বর ‘নিয়োগবিধি লঙ্ঘন করে প্রভাষকের চাকরি, ২৮ বছর পর ধরা’ এই শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে একুশে পত্রিকা। প্রতিবেদনে নিয়োগবিধি লঙ্ঘন করে কলেজের সহকারী অধ্যাপক কামাল উদ্দিনের প্রভাষকের চাকরি ও এডহক কমিটিতে নির্বাচন ছাড়াই অবৈধভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোনিত প্রতিনিধি হিসেবে তার নিয়োগের পাশাপাশি এডহক কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আজমের সংশ্লিষ্টতায় কলেজের বিভিন্ন কার্যক্রমে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের বিষয় তুলে ধরা হয়।

একুশে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর বিষয়টি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। যার প্রেক্ষিতে গত ২৮ সেপ্টেম্বর বিজয় স্মরণী কলেজের বিতর্কিত এডহক কমিটি বাতিল করে নতুন কমিটি ঘোষণা করতে নির্দেশ দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এক্ষেত্রে বাদ দেওয়া হয় পূর্বের এডহক কমিটিতে বিধি লঙ্ঘনে অভিযুক্ত সেই শিক্ষক প্রতিনিধি কামাল উদ্দিন এবং অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত সদস্য মোহাম্মদ আজমকে।

নতুন এডহক কমিটিতে ফেনী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ফসিউল আলমকে সভাপতি ও কাজী জাহাঙ্গীর খালেদকে বিদ্যোৎসাহী সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর। এডহক কমিটিতে পদাধিকারবলে অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) আবু জাফর সিদ্দিকীকে সদস্য সচিব করা হয়।