‘টিনুকে চকবাজারের মানুষের জন্য উৎসর্গ করে দিলাম’

জোবায়েদ ইবনে শাহাদত : সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে গত ৭ অক্টোবর ১৬ নং চকবাজার ওয়ার্ডের উপনির্বাচনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন যুবলীগ নেতা নুর মোস্তফা টিনু। কারো কাছে তিনি ছিলেন সন্ত্রাসী আবার কখনো কিশোরগ্যাং লিডার। যে যাই বলুক না কেন, সবাইকে চমকে দিয়ে ২০ প্রতিদ্বন্দ্বীকে পেছনে ফেলে নিকতটম প্রতিদ্বন্দ্বী আবদুর রউফ থেকে ১৩ ভোট বেশি পেয়ে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন; তাও আবার কারাগারে বসেই। কারাগারে বসে কাউন্সিলর বা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার উদাহরণ সমাজে খুব বেশি নেই। সেই কম উদাহরনের একজন নুর মোস্তফা টিনু।

আরও অবাক করা বিষয় হলো- ঘামঝরানো প্রচারণা চালিয়ে যারা তার কাছে হেরেছেন তারা কেউ ফেলনা নন, বরং ভারি ওজনের। নগর আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা এনামুল হক দানুর ছেলে কাজী মুহাম্মদ রাজেশ ইমরান, ৭ বারের জনপ্রিয় কাউন্সিলর সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টুর স্ত্রী মেহেরুন্নিছা, সংরক্ষিত আসনের প্রাক্তন কাউন্সিলর ও মহানগর মহিলা লীগের সহ সভাপতি মমতাজ খান, বিত্তবৈভবের মালিক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসাইন, প্রভাবশালী আব্দুর রউফের মতো প্রার্থীদের হারিয়েছেন তিনি। টিনু জিতেছেন ৭৮৯ ভোট পেয়ে। ফলে দীর্ঘ ৩৫ বছর পর নতুন কাউন্সিলর পেল চকবাজারবাসী। এর আগে টানা ৩৫ বছর এখানকার কাউন্সিলর ছিলেন চকবাজারের রাখালরাজা খ্যাত সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টু।

গত মার্চে অকস্মাৎ মৃত্যুর পর বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে টিনু নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সিএমপির তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী মো. আব্দুর রউফ থেকে মাত্র ১৬ ভোট বেশি পেয়েছেন।

টিনুর বিস্ময়কর জয়ের নেপথ্যে ক্যারিশমা কী? খুঁজতে গিয়ে জানা গেলো, টিনুর স্ত্রীর অনবদ্য ভূমিকা। টিনুর কর্মীবাহিনীর পাশাপাশি ‘ওয়ানম্যান আর্মি’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন তার স্ত্রী শাহানাজ আকতার। গণসংযোগ থেকে শুরু করে প্রচার-প্রচারণায় চষে বেড়িয়েছেন সমগ্র চকবাজার। নির্বাচনী কার্যক্রম সামলেছেন একাই। এমনকি ভোটের দিন একাই দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ১৫টি নির্বাচনী কেন্দ্র। টিনুর বিরুদ্ধে অস্ত্রবাজি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, কিশোরগ্যাং লালনসহ ইত্যকার অভিযোগ, তার উপর দীর্ঘদিন ধরেই জেলই যার ঠিকানা- সেই টিনুই শেষপর্যন্ত বাজিমাত করলেন- কী তার রহস্য, সেই কথাই একুশে পত্রিকাকে শোনালেন তার স্ত্রী শাহনাজ আকতার।

একুশে পত্রিকা : কারাগারে থেকে কাউন্সিলর হয়েছেন টিনু। এই অসাধ্য সাধনের পেছনের গল্পটা বলুন?
শাহানাজ আকতার : জনগণের ভালোবাসা না থাকলে আজকে সে এই জায়গায় আসতে পারতো না। যেহেতু নির্বাচনের আগে থেকেই আমি গণসংযোগ করেছি, মানুষের ঘরে ঘরে গিয়েছি, মানুষের মন-মানসিকতা বোঝার চেষ্টা করেছি। তার প্রতি মানুষের ভালোবাসাটা আমি দেখেছি। মানুষের কাছে তার কতটা গ্রহণযোগ্যতা সেটা আমি উপলব্ধি করেছি। এই কারণে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমাদের আলাদা কোনো পরিকল্পনাও ছিল না। আমরা সিদ্ধান্তটা ভোটারদের হাতেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভালোবাসাটাই ছিল আমাদের আসল পুঁজি।

একুশে পত্রিকা : প্রায়শই ‘কিশোরগ্যাং লিডার’ হিসেবে টিনুর নাম শোনা যায়। এবিষয়ে আপনি কী বলবেন?

শাহানাজ আকতার : আমি যতটুকু জানি টিনু এসবের সাথে জড়িত না। আমি খুব কাছ থেকে তাকে দেখেছি। সে ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত সাদা মনের মানুষ। কিন্তু আমি যেটা খেয়াল করেছি, কোনো খারাপ কাজ কিংবা অপরাধ কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত না থাকা সত্ত্বেও তার নাম বারবার চলে আসে। চকবাজারে কিশোরগ্যাং থাকুক কিংবা না থাকুক ষড়যন্ত্রকারীরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তার নাম এর সাথে জুড়ে দেয়। চকবাজারে তার জনপ্রিয়তা আছে, সকল বয়সের মানুষ তাকে ভালোবাসে। কিন্তু একটি মহল তার এই জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে এসকল বিষয়ে তাকে জড়িয়ে ফেলে।

একুশে পত্রিকা : র‌্যাবের শুদ্ধি অভিযানে টিনু অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়েছিলেন। আপনাদের বাসায় তল্লাশি চালানো হয়েছিল। আসলে কী হয়েছিল সেদিন?

শাহানাজ আকতার : অভিযানের পর র‌্যাব জানিয়েছিল তারা আমার বাসা থেকে অস্ত্র উদ্ধার করেছে। নিয়ম অনুযায়ী আমার বাসায় তল্লাশি চালানোর সময় আমাকে রাখার কথা, কিন্তু অভিযানের সময় আমাদের কাউকেই বাসায় থাকতে দেওয়া হয়নি। অভিযানের আগে থাকেই র‌্যাব আমার কাছ থেকে জোর করে চাবি নিয়ে বাচ্চাসহ আমাকে অন্য একটি বাসায় আটকে রেখেছিল। আমার পরিবারের কাউকেই বাসায় তারা থাকতে দেয়নি। এমনকি সিসিটিভি ক্যামেরাও তারা গায়েব করে ফেলেছে।

‘তারা যা করেছে তাদের ইচ্ছেমতো করেছে। এখন তারা অস্ত্র কীভাবে পেল, আসলেই কি আমাদের বাসায় পেয়েছে নাকি উনারা রেখেছেন তা আমরা কেউই জানি না। আমাদের সামনে তল্লাশি চালিয়ে যদি তারা এমন কিছু পেত তাহলে আমরা তা মেনে নিতাম। যেহেতু অভিযান পরিচালনার সময় আমাদের কাউকে রাখা হয়নি তাই এর স্বচ্ছতা নিয়েও আমাদের প্রশ্ন রয়েছে।’

একুশে পত্রিকা : কাউন্সিলর হিসেবে স্বামীর নাম শুনে অনুভূতিটা কেমন ছিল?

শাহানাজ আকতার : নির্বাচন কমিশন থেকে যখন ঘোষণা দেওয়া হলো ‘নুর মোস্তফা টিনু জয়ী’ তখন আনন্দের পাশাপাশি টিনুর শূন্যতা অনুভব করছিলাম। কারণ নির্বাচনের কাজে হয়তো আমার থাকার কথা ছিল টিনুর পাশে। যেখানে বসে আমি ফলাফলের অপেক্ষা করছিলাম সেখানে তার থাকার কথা ছিল। জয়ের মালা থাকার কথা ছিল তার গলায়। ওই মুহূর্তে আমার অনেক খারাপ লাগছিলো। কিন্তু নিচে নেমে টিনুর শত শত কর্মী ও ভক্তের মুখে যখন আনন্দের উল্লাসটা দেখেছি, তখন আমি তাদের মধ্যেই টিনুকে খুঁজে পেয়েছিলাম।

একুশে পত্রিকা : যাদের জন্য আজ টিনু কাউন্সিলর তাদের উদ্দেশ্যে কী বলবেন?

শাহানাজ আকতার : জনগণকে আমার আর কিছু বলার নেই। তবে আমার স্বামী নুর মোস্তফা টিনুকে আমি কিছু কথা বলতে চাই। জনগণ যোগ্য বিবেচনা করে, ভালোবেসে তাদের মূল্যবান ভোটটা দিয়েছে। তাদের নিশ্চয়ই কিছু চাওয়া-পাওয়া আছে, অধিকার আছে, আশা আছে। আমি চাই টিনু তাদের এই ভালোবাসার যথাযথ মূল্য দিক। এজন্য টিনুকে জনগণের জন্য আবারও উৎসর্গ করে দিলাম।

খুব শিগগির যাতে টিনু কারাগার থেকে বের হয়ে জনগণের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে সেই আশাই আমি করবো। বলেন টিনুর সহধর্মিণী।