রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলো আসলে কারা, কী তাদের উদ্দেশ্য?

প্রকাশিতঃ ৩ অক্টোবর ২০২১ | ২:৩৬ অপরাহ্ন

জসিম উদ্দীন, কক্সবাজার : কক্সবাজারের উখিয়ায় কুতুপালং ক্যাম্পের ভেতরে আততায়ীদের গুলিতে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ নিহত হওয়ার পর আবার আলোচনায় এসেছে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা) নামে একটি সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্ঠী। মুহিবুল্লাহর ভাই হাবিবুল্লাহ এই হত্যাকাণ্ডের জন্য আরসার সন্ত্রাসীদের দায়ী করেছেন। যদিও মুহিবুল্লাহকে হত্যার দায় অস্বীকার করেছে আরসা।

সশস্ত্র এ গোষ্ঠীর মুখপাত্র মৌলভী সোয়েব দাবি করেছেন, ‘এ হত্যাকাণ্ডের সাথে আরসা কোনোভাবে জড়িত নয়। মিয়ানমার সরকারের এজেন্টরাই মুহিবুল্লাহ হত্যায় জড়িত।’

আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, আরসা মূলত গড়ে উঠেছে সৌদি আরবে চলে যাওয়া রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে। আতাউল্লাহ ‘আবু আমর জুনুনি’ নামেও পরিচিত। রাখাইনের রোহিঙ্গারা যে ভাষায় কথা বলে সেই ভাষা এবং আরবিতে অনর্গল বলতে পারেন তিনি। ২০১২ সালে আতাউল্লাহ সৌদি আরব থেকে অদৃশ্য হয়ে যান। ২০১৬ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে আরসার প্রধানের ১৮ মিনিটের এক ভিডিওবার্তা প্রকাশ হয়। সেখানে তিনি মিয়ানমারের পুলিশ ক্যাম্পে হামলাকে ‘সমর্থন’ জানান। তার সেকেন্ড ইন কমান্ড হলেন মৌলভী হামিদ।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ আরও বলছে, মূলত রোহিঙ্গা যুবকদের দিয়েই গঠিত হয়েছে আরসা। তারা আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। চরম দারিদ্র্য, নিজ দেশে স্বীকৃতি না পাওয়া ও চলাচলের ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণের কারণেই রোহিঙ্গারা এ পথ বেছে নিয়েছে বলে মনে করে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ।

এদিকে আরেক সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্ঠী আল ইয়াকিনকে আরসার ছায়া সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, বাংলাদেশিদের অপহরণ করে নিয়ে কক্সবাজারের নির্জন পাহাড়ে নিয়ে যায় তারা। সেখানে হাত-পা ও চোখ বেঁধে চলে নির্মম নির্যাতন চালায়। এরপর টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। সময় মতো টাকা না দিলে পাহাড়ে গর্ত করে পুঁতে ফেলার নজিরও স্থাপন করেছে এ সশস্ত্র গোষ্ঠী। বর্তমানে রোহিঙ্গাসহ স্থানীয় বাংলাদেশিদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করেছে এ সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা।

স্থানীয়রা বলছেন, কক্সবাজার ও টেকনাফের প্রতিটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন আল-ইয়াকিনের সদস্যরা। নিজ দেশ মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল দেশটির সেনাবাহিনীর ওপর হামলা। ওই হামলার সঙ্গেও জড়িত ছিল আল-ইয়াকিন। এখন তারা বাংলাদেশেও আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে। এছাড়াও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে মাদক বিক্রি, মানবপাচার, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, ডাকাতি ও মাদকের টাকায় আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহের কথাও শোনা যায়।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি মোহাম্মদ ওমর ফারুককে (৩০) গুলি করে হত্যা করা হয়। প্রথমে জানা যায়, স্থানীয় এক ডাকাত দল এ হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত। তবে কক্সবাজারের লোকজন বলছেন, ওই হত্যাকা-ের পেছনে ছিল আল-ইয়াকিনের সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় দুই সদস্য পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।

ইউটিউবে প্রকাশিত এক ভিডিওতে আল ইয়াকিনের নেতাদের দাবি, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার আরাকানের অংশ। তারা এতদিন মিয়ানমারের রাখাইনে ছিলেন। এখন তাদের আরেক রাজ্য কক্সবাজারে এসেছেন। তারা এখানেই থাকবেন।

স্থানীয়রা জানান, শালবন ও কুতুপালং ক্যাম্পে আল ইয়াকিনের অধিকাংশ সদস্যের স্থায়ী অবস্থান। তবে বর্তমানে রোহিঙ্গাদের প্রতিটি ক্যাম্পে আল-ইয়াকিনের সদস্যরা আছে। চলতি বছরের মার্চে উখিয়ার বালুখালি ক্যাম্পে ভয়াবহ যে আগুনের ঘটনা ঘটে তা ছিল আল-ইয়াকিনের কাজ। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তারা রোহিঙ্গাদের ঘর পুড়িয়ে দেয়।

রোহিঙ্গারা জানান, ক্যাম্পে ত্রাস সৃষ্টি করা সশস্ত্র সংগঠন আল-ইয়াকিন সম্পর্কে মুখ খুলতে চান না কেউই। যদি তারা খুন করে ফেলে এ ভয়ে কেউ কিছু বলার সাহস দেখান না। প্রতিনিয়ত তাদের হাতে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় ক্যাম্পের আশপাশের পল্লীচিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তারা। অনেকে বাধ্য হয়ে গর্ভবতী হয়েছেন, অনেকে আবার গর্ভপাতও করিয়েছেন।

এদিকে বান্দরবান-কক্সবাজার সীমান্তে সত্তরের দশক থেকে সক্রিয় জঙ্গি সংগঠন পরিচালনা করছে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)। অভিযোগ রয়েছে, এই গ্রুপটিকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন। বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তে একটি ‘স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠাই আরএস’র একমাত্র লক্ষ্য। এছাড়াও ফিলিপাইন, পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে রয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদী এ সংগঠনের নেটওয়ার্ক।

জানা গেছে, ঐতিহাসিকভাবেই আল-কায়েদা ও আফগানিস্তানের তালেবান জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করছে আরএসও। ২০১২ সালের জুলাই মাসে উইকিলিকসের ফাঁস করা এক তথ্যে জানা যায়, মায়ানমারের যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের তারবার্তায় বলা হয়, আরএসওর সঙ্গে আল-কায়েদাসহ আরো কয়েকটি জঙ্গি গোষ্ঠীর যোগাযোগ রয়েছে।

নিজেদের পরিকল্পনা পূরণের জন্য কৌশলপত্র নির্ধারণ, মানচিত্র পতাকা তৈরিসহ সংবিধানও রয়েছে তাদের। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি, হিযবুত তাহরীর, হিযবুত তাওহীদ এবং পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই- তৈয়্যবা, হরকাতুল জিহাদ, জয়ইশ-ই মোহাম্মদ, মায়ানমারের বিদ্রোহী জঙ্গি রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), আরাকান মুভমেন্ট, আরাকান পিপলস ফ্রিডম পার্টি, আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (এআরএনও), আরাকান রোহিঙ্গা ইউনিয়ন নামের বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের কর্মীরা এক সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। এদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা জড়িত রয়েছে। কক্সবাজারে পুলিশের হাতে আটক চার জঙ্গির মধ্যে জঙ্গি নেতা আবদুল্লাহ হেল কাফির দেওয়া স্বীকারোক্তিতে এসব তথ্য বের হয়ে আসে।

গোয়েন্দা সূত্র মতে, আরএসও সংগঠনে রয়েছে, আফগান যুদ্ধফেরৎ প্রশিক্ষিত দুর্ধর্ষ গেরিলা থেকে শুরু করে আত্মঘাতি বোমা হামলার জন্য প্রশিক্ষিত জঙ্গি সদস্য। বান্দরবান-কক্সবাজার সীমান্তে সক্রিয় ডজনখানেক বিদেশি উগ্রপন্থি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে আরএসও-ই সবচেয়ে শক্তিশালী। আরএসও’র প্রশিক্ষিত জঙ্গিদের অনেকেই অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায় জড়িত।

এদিকে ইসলামি মাহাত নামে আরও একটি সংগঠনও শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে তৎপর রয়েছে। তারাও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনবিরোধী। যদিও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দাবি, আল-ইয়াকিন, আরসা, ইসলামি মাহাত, আরএসও- এর কোনো অস্তিত্ব রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নেই। কেউ কেউ তাদের নাম ব্যবহার করে আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা করে মাত্র।

তবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বলছে, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশ প্রতিনিয়ত খুন, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, অস্ত্র ও মাদকপাচার, চোরাচালান, ডাকাতি, বনদখল এবং অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
যদিও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এনজিকর্মীদের দাবি, আল-ইয়াকিন, আরসা, ইসলামি মাহাত, আরএসও’র পাশাপাশি ছোট-বড় অন্তত ১৫ থেকে ২০টি সক্রিয় সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে। অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন নামে যেসব বাহিনী রয়েছে তার মধ্যে রয়েছে রকি বাহিনী, শুক্কুর বাহিনী, আবদুল হাকিম বাহিনী, সাদ্দাম গ্রুপ, জাকির বাহিনী, মুন্না, নবী হোসেন ও জকির বাহিনী। ক্যাম্পে প্রায় নিয়মিত হানা দিচ্ছে তারা, গুলিও চালাচ্ছে। সাধারণ রোহিঙ্গারা তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে দেশি-বিদেশি এনজিওকর্মীরাও শঙ্কিত। প্রত্যেক বাহিনীতে ৩০ থেকে ১০০ জন পর্যন্ত সদস্য রয়েছে। এর ফলে দিনের বেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর নজরদারির মধ্যে থাকলেও সন্ধ্যার পর থেকেই ক্যাম্পগুলো হয়ে উঠে অপরাধের অভয়ারণ্য। তারা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোলাগুলি ও খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ে।

কুতুপালং এলাকার ইউপি সদস্য ইঞ্জিনিয়ার হেলাল উদ্দিন বলেন, দেশের সমস্ত ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে। রোহিঙ্গারা যে সীমান্ত পার হয়ে মিয়ানমারে যাওয়া আসা করতে পারছে এ কারণে ইয়াবা ও স্বর্ণ চোরাচালান বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এসব ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ক্যাম্পকেন্দ্রিক গড়ে উঠেছে অনেক সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী। এতে করে খুনোখুনি ও অপরাধের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সদ্য কারামুক্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক একজন শীর্ষ কারবারি বলেন, ক্যাম্পে প্রতিদিন শত কোটি টাকার বেশি ইয়াবার লেনদেন হয়। প্রতিদিন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অন্তত ৩০ থেকে ৪০ লাখ ইয়াবা হাতবদল হচ্ছে। লেনদেনের একটা অংশ কতিপয় আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য ও স্থানীয় গডফাদার এবং নেতাদের পকেটে যাচ্ছে বলেও দাবি তার।

খুব কম সংখ্যক ইয়াবার চালান আটক হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, মূলত ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভিতরে-বাইরে অন্তত অর্ধশতাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে। এ কারণে খুন ও অপরাধের মাত্রা বেড়ে চলছে।

রোহিঙ্গা অধ্যুষিত উখিয়া রাজাপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক মাদক কারবার, স্বর্ণ চোরাচালান, ডাকাতি ও অপহরণ ও খুন দিন দিন বেড়েই চলছে। এসব নিয়ন্ত্রণে ১২ থেকে ১৪টি অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে বলে শুনতে পাচ্ছি। তাদেরকে দ্রত নিশ্চিহ্ন করতে না পারলে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয়দের পরিণতিও ভয়াবহ হতে পারে।

ক্যাম্পের একাধিক বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপে যারা রয়েছে, তাদের অনেকের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলো- মো. আব্দুল্লাহ ওরফে দাদা ভাই, বুলু, সুলতান, নবী হোসেন, সফিক, রফিক, মুর্তজা, হামিদুল্লাহ, আবদুস শুকুর, শরীফ হোসেন, মো. রহমান, সবেদ উল্লাহ, আব্দুল্লাহ, ফয়সাল, মো. সোলাম, হামিদ হোসেন, মুহিবু রহমান, দিলদার, আবু সাইদ, তাহের, ফারুক, মুক্কুস, জুবায়ের, মুস্তফা, আব্দুল্লাহ আইদি, হাসন শরীফ, আব্দুল জলিল, হাফেজ উল্লাহ, আরমান খান, আইয়ুব, আমির হোসেন, নুর ইসলাম, আলী আকবর, কামাল, জাইবু রহমান, নাজিমুদ্দিন, সোনা উল্লাহ ও আরাফাত। একটি তালিকায় বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপে জড়িত এমন দেড় শতাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীর নাম রয়েছে।

অভিযোগ আছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্প ভিত্তিক বেশিরভাগ সন্ত্রাসী গ্রুপের সাথে এখন মিয়ানমার সরকারের সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিরা যোগাযোগ রাখছে রোহিঙ্গা প্রতিনিধির মাধ্যমে শরণার্থী শিবির অশান্ত করার জন্য সন্ত্রাসী গ্রুপকে কোটি কোটি টাকার ইয়াবা ফ্রিতে দিচ্ছে মিয়ানমার সরকার। এতে করে এসব সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো মিয়ানমার সরকারের ইশারায় সংঘর্ষে জড়িয়ে ক্যাম্প অশান্ত করে তুলছে।

পুলিশ বলছে, গত চার বছরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ১২ ধরনের অপরাধে ১ হাজার ২৯৮টি মামলা হয়েছে। এতে আসামি হয়েছে ২ হাজার ৮৫০ রোহিঙ্গা। এসব অপরাধের মধ্যে রয়েছে হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি, অস্ত্র ও মাদকপাচার, মানবপাচার, পুলিশ আক্রান্ত ইত্যাদি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৭০টি খুনের মামলা হয়েছে গত চার বছরে। এ সময় ৭৬২টি মাদক, ২৮টি মানবপাচার, ৮৭টি অস্ত্র, ৬৫টি ধর্ষণ ও ১০টি ডাকাতির ঘটনায় মামলা হয়েছে। ৩৪টি মামলা হয়েছে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের অপরাধে। অন্যান্য অপরাধে হয়েছে ৮৯টি মামলা। গত ৪৮ মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘর্ষের ঘটনায় ২২৬ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরও ৩৫৪ জন। ২০১৮ সালে ২০৮ মামলায় আসামি ৪১৪ জন। ২০১৯ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৬৩টি। যার আসামি ৬৪৯ জন। ২০২০ সালে ১৮৪ মামলায় হয়েছে ৪৪৯ আসামি।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা ১৪ এপিবিএনের পুলিশ সুপার নাঈমুল বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী থাকতে পারে। তবে চরমপন্থী কোনো সংগঠন নেই। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এপিবিএনের পাশাপাশি অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থার বিপুল সংখ্যক সদস্য কাজ করছে বলে জানান তিনি।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন শত কোটি টাকার বেশি ইয়াবার লেনদেনের বিষয়ে তিনি বলেন, এই ধরনের কোনো তথ্য আমাদের জানা নেই।

র‌্যাব-১৫ এর উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভিতরে ও বাইরে র‌্যাব অভিযান অব্যাহত রেখেছে। এর মধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রিক অনেক বড় বড় সন্ত্রাসী র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে। যেসব সন্ত্রাসী এখনো ধরাছোয়ার বাইরে রয়েছে তাদের ধরতে কাজ করছে র‌্যাব।

এদিকে মুহিবুল্লার মতো জনপ্রিয় নেতাকে হত্যার পর সাধারণ রোহিঙ্গারা এক ধরনের চাপা আতঙ্কে রয়েছেন। নিজ দেশে প্রত্যাবাসন নিয়েও অনেকে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। আবার অনেকে এই হত্যার জের ধরে আগামীতে অপ্রীতিকর পরিস্থিতিরও আশঙ্কা করছেন।

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়াসহ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মুহিবুল্লাহ আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের কাছে তিনি ‘মাস্টার মুহিবুল্লাহ’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন।

মানবাধিকারকর্মী নুর খান লিটন বলেন, মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের একটি পতাকাতলে আনতে সমর্থ হন। রোহিঙ্গাদের নিজ মাটিতে ফেরানোর স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিলেন। সর্বশেষ মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক গ্রুপগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের সমস্যার কথা তাদের বোঝাতে সক্ষম হন। তার মতো ক্যারিশম্যাটিক নেতার কারণে ক্যাম্প ঘিরে আরসাসহ বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ আতঙ্কিত ছিল। তার হত্যার মধ্য দিয়ে সশস্ত্র গ্রুপগুলো তাদের কর্মকাণ্ড বিস্তৃতি ঘটাতে পারবে।