বিভাগীয় শহরে চাকরির পরীক্ষা নিতে বাধা কোথায়?


আবছার রাফি : করোনাভাইরাসের কারণে সারা দেশের সাত বিভাগীয় শহরে গত ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। এতে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিচ্ছু ছাত্র-ছাত্রীদের সময় এবং অর্থ দুটোই সাশ্রয় হয়েছে বলে জানিয়েছে ছাত্র-ছাত্রীরা। ঢাকা পাড়ি দেওয়ার ভোগান্তির বিপরীতে নিজ নিজ বিভাগে পরীক্ষা দিতে পেরে যারপরনাই খুশি তারা। এভাবেই ঢাবির ভর্তি পরীক্ষার মতো বিভাগীয় শহর বা জেলায় চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়ার আহ্বান চাকরিপ্রত্যাশীদের।

দেশের বেশিরভাগ সরকারি-বেসরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা কেন্দ্রীক। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল বা শহরাঞ্চল থেকে সারারাত বাস-ট্রেনে কাটিয়ে পরের দিন সকালে ঢাকায় পৌঁছার পরে যানজটের কারণে ভালোভাবে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করাটা কঠিন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে পরীক্ষা কেন্দ্র খুঁজে বের করা, থাকা-খাওয়া নিয়ে তো ঝামেলা আছেই। এমনিতে চাকরিপ্রত্যাশীদের ভেতর এক ধরণের অজানা অস্থিরতা বিরাজ করে তারওপর এমন ভোগান্তির কবলে পড়ে বেকার চাকরিপ্রত্যাশীরা শারীরিক, আর্থিক ও মানসিকভাবে দুর্দশা-হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছেন।

মো. সালাহ উদ্দিন (২৭)। নগরীর একটি সরকারি কলেজ থেকে ২০১৮ সালে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেন তিনি। টিউশনি করে পড়াশোনার খরচ চালিয়ে আসা সালাউদ্দীনকে চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা দিতে মাসে চার-পাঁচবার দৌঁড়াতে হচ্ছে ঢাকায়। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়ার খরচ আর সময় মেলাতে রোজ হিমশিম খেতে হচ্ছে সালাউদ্দীনকে। এছাড়া করোনা শুরুর আগে চাকরি আবেদন ফরম পূরণ করা পরীক্ষাগুলোও এখন নেয়া হচ্ছে দ্রুতগতিতে। তাই অনেকাংশে একই সময়ে একাধিক প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে বলে আবেদন ফরম পূরণ করা স্বত্ত্বেও সব জায়গায় পরীক্ষা দিতে পারছেন না তিনি। একদিকে ঢাকা দৌঁড়ানোর ভোগান্তি অন্যদিকে চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতা; উভয় কারণে এখন শারীরিক এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন তিনি।

সালাহ উদ্দিন বলেন, গত ১৭ সেপ্টেম্বর একই দিনে ছয়টি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। তন্মোধ্যে আমি দুইটা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছি। সময় এবং শারীরিক ক্লান্তির কারণে বাকি চারটা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারিনি। এগুলোর তো একটা সমন্বয় থাকা উচিত। এসব তো দেখার কেউ নেই।

নগরীর বেসরকারি কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করেছেন উম্মে ঐশী (২৪)। পরিবারের আর্থিক টানাপোড়েন স্বত্ত্বেও এগিয়ে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছা ঐশীর। স্বপ্ন একটা সরকারি চাকরি করার। কিন্তু চাকরির আবেদন করতে গিয়ে নানা পরীক্ষায় ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পে-অর্ডার ও ব্যাংক ড্রাফট দিতে হয়েছে ঐশীকে। তারপর সেই পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য দুই-তিন হাজার টাকা খরচ করে ঢাকা যাওয়াটা ঐশীর ওপর মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চট্টগ্রাম থেকে একা ঢাকা যেতে নিরাপদবোধ করেন না তিনি। তারওপর আর্থিকভাবে অসচ্ছল মা-বাবার পক্ষে এত টাকা-পয়সা খরচ করাও সম্ভব হচ্ছে না। তাই তিনি চাকরির আবেদন ফি কমিয়ে এবং বিভাগীয় শহরে নিয়োগ পরীক্ষা নিতে অনুরোধ করেছেন সরকারের প্রতি। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার মতো চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা বিভাগীয় শহরে নিতে বাধা কোথায়, আমরা বুঝতেছি না।

শুধু সালাহ উদ্দিন বা ঐশী নন, দেশের লাখ লাখ চাকরিপ্রত্যাশী একই সমস্যায় ভুগছেন। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য দেশের নানা জায়গায় দলবদ্ধভাবে মানববন্ধনও করেছেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। কিন্তু সমাধান না হওয়ায় চাকরিপ্রত্যাশীদের ভেতর বাড়ছে ক্ষোভ-হতাশা।

এ বিষয়ে কথা হয় চট্টগ্রাাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সমাজতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. ওবায়দুল করিম দুলালের সাথে। তিনি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এখন করোনাকাল। করোনাকালে যত কম মুভ করা যায় তত ভালো। রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর তো সারাদেশে শাখা আছে। এবং জেলা অফিসে তাদের কর্মকর্তারা আছেন সুতরাং আমার মনে হয় নিয়োগ পরীক্ষা বিকেন্দ্রীকরণ করাটা খুব কঠিন কিছু না। ছাত্র-ছাত্রীদের বিভাগীয় শহরে পরীক্ষা নেওয়ার দাবিটা খুব যৌক্তিক। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও করা যেতে পারে যেসব প্রতিষ্ঠানে লজিস্টিক সাপোর্ট আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘করোনা মহামারির এই দুর্যোগের সময় বাংলাদেশের মানুষের আর্থিক সামর্থ্য অনেক কমে গেছে। একটা ছেলেকে ঢাকায় গিয়ে পরীক্ষা দেওয়া, ওখানে আত্মীয়স্বজন না থাকলে হোটেল ওঠতে হবে। হোটেলে তাকে একদিন-দুইদিন থাকতে হয়, এমন আরও সমস্যা আছে। এখন যদি সে চট্টগ্রামের ছেলে হয়, আর পরীক্ষাটাও যদি চট্টগ্রামে হয় তাহলে তার পক্ষে অল্প খরচে পরীক্ষায় শামিল হওয়া সম্ভব। এটা বিবেচনায় নেওয়া দরকার। এমনিতে এই দুর্যোগে অনেক ছাত্র-ছাত্রী আর্থিকভাবে কষ্টে পড়েছে। কারণ কারও বাবার চাকরি চলে গেছে, কারও ভাইয়ের চাকরি চলে গেছে। সুতরাং এসব হিসাবের মধ্যে নেওয়া দরকার। লেখাপড়া যেন বন্ধ না হয়, চাকরি পাওয়ার সুযোগ যেন অবারিত থাকে প্রত্যেকের জন্য।’

‘আমরা তো সব সময় বলি, সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে হবে। আমি মনে করি, সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করার এটা একটা উপায়। আমাদের উচিত, সুযোগটা মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া উচিত। তবে ছোটখাটো প্রতিষ্ঠানে এটা সম্ভব নাও হতে পারে কারণ যাদের ঢাকায় একটা প্রতিষ্ঠান আছে কিন্তু অন্য কোথাও শাখা নেই। আমার মনে হয়, রাষ্ট্রীয় ব্যাংকসহ নানাবিধ সরকারি প্রতিষ্ঠান বিভাগীয় শহর বা জেলা পরীক্ষা নিতে পারে।’ যোগ করেন অধ্যাপক ড. ওবায়দুল করিম দুলাল।