মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারণ কী, কারা জড়িত


জসিম উদ্দিন, কক্সবাজার : রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের কারণ কী, কারা জড়িত— এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সংশ্লিষ্টরা একুশে পত্রিকাকে দিয়েছেন চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য।

মুহিবুল্লাহর ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ জানান, বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া ক্যাম্পের একটি মসজিদে এশার নামাজ শেষ করে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) এর অফিসে অবস্থান করছিলেন তারা। এসময় ২০ থেকে ২৫ জনের একটি বন্দুকধারী দল আমার ভাইয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওই অফিসে কর্মরত অন্যান্যদের মারধর করে ছেড়ে দিলেও ভাইয়ের বুকে গুলি চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।

হাবিবুল্লাহর দাবি, তার ভাই মুহিবুল্লাহকে হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছেন রোহিঙ্গাদের কাছে ‘আরসা’ নেতা নামে পরিচিত মাস্টার আব্দুর রহিম, মুর্শিদ, লালুসহ ২০ থেকে ২৫ জনের একটি সশস্ত্র গ্রুপ। তাদের কয়েকজন কথিত ‘আল ইয়াকিনের’ সদস্য বলে দাবি করেন তিনি।

হাবিবুল্লাহ বলেন, আমার ভাই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন। তিনি রোহিঙ্গাদের সবসময় বলতেন
আমাদেরকে মিয়ানমারে আমাদের দেশে ফিরে যেতেই হবে। তাই রোহিঙ্গারাও তাকে ভালোবাসতেন বিশ্বাস করতেন। রোহিঙ্গাদের যেকোনো সমস্যা সমাধানের জন্য আমার ভাই এগিয়ে আসতেন। তাদের অধিকার আদায়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছিলেন।

তিনি আরও বলেন, শুধু এখানে নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও আমার ভাইয়ের পরিচিতি ছিল। হয়তো সেই যাত্রা বাধাগ্রস্ত করতে তাকে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে ঘাতকদের শাস্তি দাবি করেছেন হাবিবুল্লাহ।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলামের মতে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পেছনে তিনটি কারণ থাকতে পারে। এ তিনটি কারণ সামনে রেখে তদন্ত করা হলে মুহিব্বুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে।

তিনি বলেন, মুহিবুল্লাহ ক্রমাগতভাবে রোহিঙ্গাদের একক নেতৃত্বে ছিলেন, জাতিসংঘ গিয়ে বৈঠক করেছেন। জেনেভায় গিয়েছিলেন। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও দেখা করেছিলেন। তার জনপ্রিয়তা কারণে অন্যান্য যেসব রোহিঙ্গারা নেতৃত্ব দিয়ে সামনে আসতে পারছে না তাদের একটি গ্রুপ এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটাতে পারে।

রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ সবসময় রোহিঙ্গাদের মাঝে রোহিঙ্গা জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু এর বিপরীত এ যাদের অবস্থান তারাও এ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে।

এ ছাড়াও মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। কিন্তু কিছু দেশ দেশ ভূ-রাজনীতি বা ভূ-কৌশলের কারণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিপক্ষে রয়েছে। সেসব দেশও মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পেছনে কলকাঠি নাড়তে পারে। জড়িত থাকতে পারে মিয়ানমার সরকারও। ধারণা নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলামের।

তিনি এ তিনটি বিষয় মাথায় রেখে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি তদন্ত করা হলে দ্রুত হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব উল্লেখ করে প্রত্যাবাসনের পক্ষে সক্রিয় থাকা রোহিঙ্গা নেতাদের নিরাপত্তা জোরদার করার পরামর্শ দিয়েছেন এ নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

এদিকে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ নিহতের পর রোহিঙ্গা নেতাদের মাঝে আতংক বিরাজ করছে। হামলার আশঙ্কায় নিজেদের নিরাপত্তার কথা উল্লেখ করে মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে গণমাধ্যমে কথা বলতে রাজি হচ্ছেন না তারা।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা দাবি করেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক ও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে সক্রিয় অবস্থান নেওয়ার কারণে মিয়ানমার সরকারের পূর্ব পরিকল্পনায় রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে। আরও কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা তাদের টার্গেট রয়েছে বলে দাবি করেন রোহিঙ্গা নেতারা।

রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, প্রত্যাবাসনের বদলে বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠেছে মিয়ানমার সরকার। এজন্য তারা বিপথগামী রোহিঙ্গাদের দিয়ে ক্যাম্পে দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। বিশ্ব দরবারে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসাবে তুলে ধরে ২০১৯ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা মামলাটি প্রশ্নবিদ্ধ করাই তাদের লক্ষ্য।

রোহিঙ্গা নেতা আবদুল হামিদ বলেন, আমরা দেশে ফিরে যেতে চাই। তবে মিয়ানমার সরকার একদিকে আমাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলছে, অন্যদিকে যাতে আর মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে না হয় সেজন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে। তার দাবি, ক্যাম্পে এখন যেসব সন্ত্রাসী কার্যক্রম চলছে সবই হচ্ছে মিয়ানমারের ইশারায়। তারা বিপথগামী কিছু রোহিঙ্গা ব্যবহার করে আল-ইয়াকিন ও আরসার নাম ভাঙিয়ে ক্যাম্পে নানা ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে। রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড এর অংশ বলে দাবি করেন তিনি।

কক্সবাজারে শরনার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, রোহিঙ্গা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড ঘিরে যেসব অভিযোগ বা কথাবার্তা আমরা শুনতে পাচ্ছি, সব বিষয় মাথায় রেখে তদন্তের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করা হবে। মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড পরবর্তী যাতে বিশৃঙ্খলা না হয় এ জন্য নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। একই সাথে কী কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন এ বিষয়ে কাজ করছে।

তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। কেউ যদি বিশৃংঙ্খলা সৃষ্টি করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।