রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

ম্যানহোলের ঢাকনা নয়, যেন মরণফাঁদ

প্রকাশিতঃ ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ৫:৩২ অপরাহ্ন

জোবায়েদ ইবনে শাহাদত : চট্টগ্রাম নগরের পোর্ট কানেক্টিং (পিসি) রোডের বড়পোল এলাকা। সেখানে সড়কের উপর আছে ‘ম্যানহোলের উঁচু ঢাকনা’। গত ১২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় ওই স্থান দিয়ে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনার শিকার হন মোটরসাইকেল আরোহী ইমতিয়াজ সাদমান ও আশিক রহমান। পরে স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে যান।

গুরুতর আহত আশিক রহমান চমেক হাসপাতালে পাঁচদিন চিকিৎসা নেওয়ার পর কিছুটা সুস্থ হয়েছেন। সেদিনের ঘটনার বিবরণ দিয়ে একুশে পত্রিকাকে আশিক রহমান বলেন, ‘আমরা আগ্রাবাদ থেকে পোর্ট কানেক্টিং রোড হয়ে ঢাকায় ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলাম। বড়পোল অংশে আসতেই হঠাৎ সামনে পড়ে ম্যানহোলের উঁচু ঢাকনা। এটি অস্বাভাবিক উঁচু ছিল। আমি কখনো রাস্তায় এতো উঁচু ম্যানহোলের ঢাকনা দেখিনি। কিছু বুঝে উঠার আগেই মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তা থেকে ছিটকে পড়ি। ভাগ্য ভালো থাকায় প্রাণে বেঁচে গেছি।’

নগরের দেওয়ানহাট মোড়েও আছে ‘ম্যানহোলের উঁচু ঢাকনা’। সেখানে সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন চালক আবদুল আজিজ। একুশে পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘গত ১৯ সেপ্টেম্বর আমি ইপিজেড থেকে ভাড়া নিয়ে মনসুরাবাদ যাচ্ছিলাম। দেওয়ানহাট মোড়ে আসতেই হঠাৎ সামনে পড়ে ম্যানহোলের দুটি উঁচু ঢাকনা। নিয়ন্ত্রণ রাখতে আমি তাৎক্ষণিক ব্রেক কষলেও একটি রিকশায় ধাক্কা লাগে। রিকশার যাত্রী ছিটকে পড়ে আহত হয়েছিলেন। অপরিকল্পিতভাবে এভাবে তৈরি করা ম্যানহোলের ঢাকনা আমাদের জন্য মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে।’

কাইয়ুম আলী পেশায় বাদাম বিক্রেতা। সম্প্রতি দেওয়ানহাট পোর্ট সিটি কমপ্লেক্সের সামনে দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি। একুশে পত্রিকাকে কাইয়ুম আলী বলেন, ‘রাত ১১টায় বেচাকেনা শেষে পোস্তার পাড় এলাকায় নিজের বাসায় যাচ্ছিলাম। রাস্তায় অস্বাভাবিক উচ্চতার একটি ম্যানহোলের ঢাকনার সাথে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই। এতে হাত ভেঙে যাওয়ার পাশাপাশি মাথাও ফেটে যায়।’

তিনি বলেন, ‘রাস্তায় এমন ম্যানহোলের ঢাকনা বসানোর কাজ ওয়াসা করেছে। রাস্তার উপর এভাবে ম্যানহোলের ঢাকনা বসানোর মানে কী? ম্যানহোলের উচ্চতা কতটুকু হবে এটাও কী তাদের জানা নেই?’

এভাবেই নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কের মাঝখানে চট্টগ্রাম ওয়াসা ও বিটিসিএল’র উঁচু ম্যানহোলের ঢাকনার কারণে ঘটা দুর্ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন ভুক্তভোগীরা।

নগরীর প্রায় সড়কের নিচে চট্টগ্রাম ওয়াসার নতুন পাইপলাইন স্থাপন ও বিটিসিএল’র সংযোগ স্থাপনের কাজ শেষে ‘কানেকটিং পয়েন্টে’ রাস্তা থেকে অস্বাভাবিক উচ্চতায় ম্যানহোলের ঢাকনা তৈরি করা করা হয়েছে। ৬ থেকে ১০ ইঞ্চি উঁচু এসব ম্যানহোলের ঢাকনা পথচারী ও যানবাহনের জন্য দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করেছে। অস্বাভাবিক উচ্চতার এসব ম্যানহোলের কারণে সড়কে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা।

সরেজমিন নগরের পোর্ট কানেক্টিং রোডের নয়াবাজার থেকে বড়পোল অংশে গিয়ে দেখা যায়, সড়কের মাঝখানে ১৬টি ম্যানহোলে বড় ঢাকনা বসানো হয়েছে, যেগুলোর উচ্চতা সাধারণ ‘স্পিড ব্রেকারের’ প্রায় তিনগুণ। এসব ম্যানহোলের উপরে বড় করে লেখা রয়েছে বিটিসিএল। একই সড়কে রয়েছে ওয়াসার ম্যানহোল। এগুলোও একইভাবে রাস্তা থেকে প্রায় ৭ থেকে ৮ ইঞ্চি উঁচু। স্থানীয় বাসিন্দা ও দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুধুমাত্র এই সড়কে গত ২ মাসে ছোট-বড় ১৪টি দুর্ঘটনা ঘটেছে এসব ম্যানহোলের ঢাকনার কারণে।

অন্যদিকে দেওয়ানহাট এলাকায় এসব ম্যানহোলের ঢাকনা এতোটাই অস্বাভাবিক উচ্চতার যে সড়কের বেশিরভাগ যানবাহন ও পথচারী এগুলো এড়িয়ে চলছেন। সড়কের মাঝখানে কোথাও বিটিসিএল, আবার কোথাও ওয়াসার লোগো যুক্ত এসব ম্যানহোলের ঢাকনা দূর থেকে যে কেউ দেখে গতিরোধক ভেবে ভুল করতে পারেন। শুধুমাত্র দেওয়ানহাট মোড় থেকে পোস্তার পাড় পর্যন্ত ১২টি ম্যানহোলের উঁচু ঢাকনা রয়েছে। এসব ঢাকনার কারণে সড়ক সংকুচিত হয়ে পড়েছে।

দেওয়ানহাট মোড় থেকে অলংকার ও নয়াবাজার যেতে মাহিন্দ্রা-ম্যাক্সিমা, সিএনজি অটোরিকশা, লেগুনা ও হিউম্যান হলারসহ বেশিরভাগ যানবাহনকে এসব ম্যানহোলের কারণে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। অস্বাভাবিক উচ্চতার এসব ম্যানহোলের ঢাকনার কারণে সড়ক সংকুচিত হওয়ায় দুর্ঘটনার পাশাপাশি যানজটে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যাত্রী ও পথচারীদের।

দেওয়ানহাট মোড়ে দায়িত্বরত একজন ট্রাফিক পুলিশ সদস্য একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘নিয়মের কারণে দিনের বেলা গণপরিবহনকে পোস্তারপাড় হয়ে দেওয়ানহাট ফ্লাইওভার যেতে হয়। কিন্তু ম্যানহোলের উঁচু ঢাকনার কারণে যানচলাচল বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি দুর্ঘটনাও ঘটছে অহরহ। কিছুদিন আগেই এই ম্যানহোলে হোঁচট খেয়ে একজন ব্যক্তি গুরুতর আহত হন। এসব ম্যানহোল যদি রাস্তার সাথে সমান থাকতো তাহলে যানবাহন ও পথচারী উভয়ের উপকার হতো।’

এদিকে নগরজুড়ে উঁচু ঢাকাযুক্ত ম্যানহোলের সংখ্যা কম নয়। নগরের মনসুরাবাদ থেকে দেওয়ানহাট যেতে ছোট-বড় প্রায় ১০টি, নয়াবাজার থেকে দেওয়ানহাট অংশে ৭টি, দেওয়ানহাট থেকে জিইসি অংশে ১৯টি, লালখান বাজার থেকে জামালখান মোড়ে ১২টি, জামালখান থেকে চকবাজারে ১৬টি ও চেরাগিপাহাড়ে ৭টি উঁচু ঢাকনা দেখা গেছে। এছাড়া নগরের খুলশী এলাকার জাকির হোসেন সড়কেও এ ধরনের ম্যানহোল চোখে পড়েছে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সহকারী স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ আবদুল্লাহ আল ওমর একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ভাষায় এগুলোকে আমরা সার্ভিস পিট বলে থাকি। সড়ক থেকে এই পিটগুলো খুবই অস্বাভাবিকভাবে উঁচু। বিটিসিএল এবং ওয়াসা নিজের ইচ্ছেমতো এসব পিট নির্মাণ করছে। নগরজুড়ে এরকম অসংখ্য পিট রয়েছে। এসব পিটের কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। পিটগুলো সড়ক থেকে অধিক উঁচু হওয়াতে গাড়ি থেমে যাচ্ছে। রাতের বেলায় ঘটছে দুর্ঘটনা। পথচারীরা হাটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ছে।’

তিনি বলেন, ‘সংস্থাগুলোকে এই বিষয়ে আমরা অসংখ্যবার বলেছি। কোনো সময় তারা আমাদের কথা শুনে দুই-একটি পিট সমান করে দেয়, কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই তাদের তদারকি না দেখে শেষ পর্যন্ত চসিকের প্রকৌশল বিভাগ কিছু কিছু জায়গায় এগুলো সড়কের সাথে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তাছাড়া এগুলো সড়কের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এসব অপরিকল্পিত পিটের কারণে সড়কের বড় একটি অংশ চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এমন কাজের পর সংস্থাগুলোর প্রকৌশল বিভাগের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাও স্বাভাবিক।’

জানতে চাইলে বিটিসিএল চট্টগ্রাম অঞ্চলের মূখ্য মহাব্যবস্থাপক মনজুর মোর্শেদ সরকার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ম্যানহোলগুলো যে অস্বাভাবিক উচ্চতার বিষয়টি সঠিক। শুধু যে উঁচু ম্যানহোল আছে তা নয়, কোথাও কোথাও দুর্ঘটনার কারণে এগুলো ভেঙেও গেছে। বিষয়টি আমরাও খেয়াল করেছি। উন্নয়নের স্বার্থে পরিচালিত এসব কাজের কারণে যদি একজন ব্যক্তিকেও সমস্যায় পড়তে হয় সেটা আমাদের জন্য চিন্তাজনক। যেহেতু আমাদের এই প্রজেক্টগুলো ঢাকা থেকে পরিচালনা করা হয় তাই আমরা তাদের এ বিষয়ে জানাবো। দ্রুত যাতে এই সমস্যার সমাধান করে দেওয়া হয় তার ব্যবস্থা আমরা নিবো।’

ম্যানহোলের উচ্চতার ব্যাখ্যা দিয়ে গিয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্ল্যানিং এন্ড কনস্ট্রাকশন) মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘মেইনটেইনেন্সের সুবিধার্থে কানেকটিং পয়েন্টে আমরা গেইট বাল্ব স্থাপন করে থাকি। এসব বাল্বের জন্য একটি করে চেম্বার আমাদের করতে হয়। সাধারণত এগুলো রোড লেভেলে থাকে। কিন্তু বিভিন্ন সময় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সড়ক উঁচু করা হয় তখন আমাদের এই চেম্বারগুলো কার্পেটিংয়ের নিচে পড়ে যায়। তাই বাধ্য হয়ে ওয়াসার চেম্বারগুলো একটু উঁচু করতে হয়। অন্যথায় পাইপ লাইনের মেইনটেইনেন্স করতে আমাদের সমস্যায় পড়তে হয়।’

সড়কের কোথাও অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ম্যানহোলের ঢাকনা উঁচু করা হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, ‘সড়ক থেকে চেম্বারগুলো একটু উঁচু হয় ঠিকই, তবে এগুলো অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে উঁচু করা হয় না। এগুলো সড়কের সাথে মিলিয়ে দেওয়া হয় যাতে যানচলাচল বিঘ্নিত না হয়। তবে অস্বাভাবিক উচ্চতার কোনো চেম্বার যদি সড়কে থেকে থাকে সে ব্যাপারে ওই প্রকল্পের পরিচালক, ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলীই ভালো বলতে পারবেন। আমার অনুরোধ থাকবে তার সাথে যোগাযোগ করার জন্য।’

চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী প্রধান প্রকৌশলীকে এই প্রকল্পের পরিচালক বললেও মাকসুদ আলমের দাবি (প্রধান প্রকৌশলী) ওই প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন আরিফুল ইসলাম (তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী)। তিনি বলেন, ‘আসলে নগরের বেশ কিছু জায়গায় চিটাগাং ওয়াটার সাপ্লাই এন্ড স্যানিটেশন প্রজেক্টের আওতায় তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এই কাজগুলো করেছেন। তবে আমি যে প্রকল্পে কাজ করছি সেখানে চেম্বারগুলো সড়কের সাথে একই উচ্চতায় রয়েছে। তবে আগামীকালের মধ্যে এই চেম্বারগুলোর পজিশন সার্ভে করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’