মামলার আসামিকে বাঁচাতে পুলিশের কৌশল

মোহাম্মদ রফিক : সুজয়মান বড়ুয়া জিতু (৩৫)। ২০১৩ সালে সিআরবিতে শিশুসহ জোড়া খুনের মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি তিনি। ২০১৫ সালের অক্টোবরে খুলশী থানায় তার বিরুদ্ধে চুরির মামলাও হয়েছিল। এরপর ২০১৯ সালের নভেম্বরে কোতোয়ালী থানায় দায়ের করা চাঁদাবাজির একটি মামলায় আসামি করা হয় জিতুকে। চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল চট্টগ্রাম মেডিকেলে মারামারি ও চুরির ঘটনায় পাঁচলাইশ থানায় দায়ের করা মামলার আসামির তালিকায়ও জিতুর নাম আছে।

এভাবে একের পর এক মামলার আসামি হওয়ার পর আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন সুজয়মান বড়ুয়া জিতু। ৩০ এপ্রিল চট্টগ্রামে মেডিকেলে মারামারির পর চারদিনের মাথায় ৪ মে রাত সাড়ে আটটায় নগরের আতুরারডিপো এলাকায় একুশে পত্রিকার আইটি ইনচার্জ ওয়াহেদ বুলবুল অর্পণকে লাটিসোটা দিয়ে মারধর করতে নির্দেশও দেন তিনি। এসময় অর্পণের মানিব্যাগ থেকে ১০ হাজার টাকাও ছিনতাই করে আসামিরা। পরে অর্পণকে চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেলে নেওয়া হয়।

এ ঘটনায় জিতুসহ পাঁচজনকে আসামি করে পাঁচলাইশ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন অর্পণ। বাকি আসামিরা হলেন- খালেদ হোসাইন অন্তর (২৩), আসিবুর রহমান সায়েম ওরফে মো. আছিবুর রহমান (২৩), আসিফ তালুকদার ওরফে মো. আসিফুজ্জামান (২৩) ও সৈয়দ মুহাম্মদ সাদিক উল্লাহ ওরফে সাহারিয়ার (২০)।

তদন্ত শেষে গত ২৬ আগস্ট পাঁচজন আসামির সবার বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা পাঁচলাইশ থানার এসআই মো. মাসুকুর রহমান। তবে ত্রুটিপূর্ণ চার্জশিটের কারণে উক্ত মামলায় জিতুসহ অন্য আসামিরা খালাস পাবেন বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

মামলাটিতে দণ্ডবিধির ১৪৩, ৩৪২, ৩২৩, ৩২৫, ৩০৭, ৩৭৯ ও ৫০৬ ধারায় অভিযোগ করা হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে ঘটনার নির্দেশদাতা ও মূল পরিকল্পনাকারী জিতুর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে শুধু ১১৪ (অপরাধে সহায়তা) ও ৩৪২ (অন্যায়ভাবে আটক) ধারার। এছাড়া আসামিদের কারও বিরুদ্ধে ৩০৭ (হত্যাপ্রচেষ্টা) ও ৩২৫ (গুরুতর জখম) ধারার অপরাধ সংঘটনের প্রমাণ তদন্তকারী কর্মকর্তা পাননি বলে দাবি করেছেন। উক্ত দুটি ধারার অপরাধের দায় থেকে আসামিদের অব্যাহতি দিতে আদালতে আবেদন করেছেন তিনি।

মামলাটিতে দণ্ডবিধির ১৪৩, ৩৪২, ৩২৩, ৩২৫, ৩০৭, ৩৭৯ ও ৫০৬ ধারায় অভিযোগ করা হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে ঘটনার নির্দেশদাতা ও মূল পরিকল্পনাকারী জিতুর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে শুধু ১১৪ (অপরাধে সহায়তা) ও ৩৪২ (অন্যায়ভাবে আটক) ধারার। এছাড়া আসামিদের কারও বিরুদ্ধে ৩০৭ (হত্যাপ্রচেষ্টা) ও ৩২৫ (গুরুতর জখম) ধারার অপরাধ সংঘটনের প্রমাণ তদন্তকারী কর্মকর্তা পাননি বলে দাবি করেছেন। উক্ত দুটি ধারার অপরাধের দায় থেকে আসামিদের অব্যাহতি দিতে আদালতে আবেদন করেছেন তিনি।

এর আগে উক্ত মামলাটি তদন্ত করেন এসআই আশরাফুল কবির। তখন তিনি দুইজন স্বাক্ষীর জবানবন্দি রেকর্ড করেন। তিনি বদলি হয়ে যাওয়ায় মামলার তদন্তভার নেন এসআই মাসুকুর রহমান। তিনি চার্জশিটে উল্লেখ করেছেন, `পূর্ববর্তী তদন্তকারী অফিসার কর্তৃক গৃহিত সাক্ষীদেরকে বাদীর মাধ্যমে ঘটনাস্থলে হাজির পাইয়া সাক্ষীদের মামলার ঘটনার বিষয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদকালে তাহাদের দেওয়া জবানবন্দি পূর্বে দেওয়া জবানবন্দির সাথে মিল না পাওয়ায় সাক্ষীদের জবানবন্দি পুনরায় ১৬১ ধারা মতে আলাদা কাগজে লিপিবদ্ধ করি।’

চট্টগ্রাম আদালতের আইনজীবী জসিম উদ্দিন বলেন, এই মামলায় দুই কর্মকর্তার তদন্ত ভিন্ন ও সাংঘর্ষিক। সাক্ষীদের জবানবন্দি মিল না পাওয়ার কথা চার্জশিটে উল্লেখ করায় সুবিধা পাবে আসামিরা, তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন হবে।

এ প্রসঙ্গে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মাসুকুর রহমান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘মামলা তদন্তে অবহেলা ও গাফিলতির অভিযোগ সঠিক নয়। তদন্তকালে আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩২৫ এবং ৩০৭ ধারার অপরাধের কোনও তথ্যপ্রমাণ মেলেনি। তাই ওই দুটি ধারার অপরাধের দায় থেকে আসামিদের অব্যাহতি দিতে চার্জশিটে উল্লেখ করেছি।’

চার্জশিটে ঘটনার বিবরণ দিয়ে উল্লেখ করা হয়, “মামলার বাদি ওয়াহেদ বুলবুল অর্পণ পেশায় একজন সংবাদকর্মী। পেশাদারিত্বের কারণে ২নং আসামি সুজয়মান বড়ুয়া জিতুর সাথে বিভিন্ন সময় তার কথা কাটাকাটি হয়। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে আসামি সুজয়মান বড়ুয়া জিতু বাদির ক্ষতি করার জন্য বিভিন্ন সুযোগ খুঁজতে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৪ মে রাত সাড়ে ৮টায় জিতুর নির্দেশে অন্য চার আসামি মিলে অর্পণকে মারধর করে তার নগদ টাকাপয়সা চুরি বরেন। অর্পণের শোরচিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসে। এসময় অর্পণকে প্রকাশ্যে খুন করার হুমকি দেয় আসামিরা। মামলার ব্যাপক তদন্তকালে ১নং আসামি খালেদ হোসাইন অন্তরের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১৪৩, ৩৪২, ৩২৩, ৩৭৯ ও ৫০৬ ধারার অপরাধ, ২নং আসামি সুজয়মান বড়ুয়া জিতুর বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১১৪ ও ৩৪২ ধারার অপরাধ, ৩নং আসামি আছিবুর রহমান সায়েম, ৪নং আসামি আসিফ তালুকদার ও ৫নং আসামি সৈয়দ মুহাম্মদ সাদিক উল্লাহর বিরুদ্ধে ১৪৩, ৩৪২, ৩২৩ ও ৫০৬ ধারার অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেছে।’

চার্জশিটে আরও উল্লেখ করা হয়, `তদন্তকালে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩২৫ ধারায় স্বেচ্ছাকৃতভাবে গুরুতর আঘাত প্রদানের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি ৭ বছরের কারাদণ্ড। দণ্ডবিধির ৩০৭ ধারায় হত্যাপ্রচেষ্টা অপরাধের শাস্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড বলে উল্লেখ আছে।

মামলার বাদী একুশে পত্রিকার আইটি ইনচার্জ ওয়াহেদ বুলবুল অর্পণ দাবি করেন, ‘বেশ কিছু মামলার রায়ে আমরা দেখেছি, ঘটনার নির্দেশদাতার ফাঁসি পর্যন্ত হয়েছিল। অথচ আমার মামলাটিতে নির্দেশদাতা জিতুকে ছোট অপরাধের ধারায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। জিতুর নির্দেশে যারা আমার উপর হামলা করেছে তাদের যেসব ধারায় অভিযুক্ত করা হয়েছে, একই ধারায় জিতুকেও অভিযুক্ত করা যেত। কিন্তু তা করেননি তদন্তকারী কর্মকর্তা। জিতুর বিষয়ে তিনি রহস্যজনক আচরণ করেছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘হামলার ঘটনার পর আমি বেশ কিছুদিন চিকিৎসাধীন ছিলাম। এরপরও হত্যাপ্রচেষ্টার ধারায় আসামিদের অভিযুক্ত করা হয়নি। সাক্ষীদের বক্তব্যও যথাযথভাবে রেকর্ড করা হয়নি। আসামিদের সবাই এখন জামিনে থাকায় আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। ইতোমধ্যে তারা আমাকে প্রাণনাশের হুমকিও দিয়েছে। চার্জশিটের বিরুদ্ধে আদালতে আমি নারাজি দেব।’

এদিকে অর্পণের মামলায় চার্জশিটভুক্ত ১নং আসামি খালেদ হোসাইন অন্তর এবং আসিফ তালুকদার ওরফে আসিফুজ্জামান দুইজনই কিশোর গ্যাং লিডার হিসেবে পরিচিত। ২০১৯ সালের ২৪ এপ্রিল রাত ১১টার দিকে নগরের আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনিতে সংঘর্ষের সময় তারা প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন করে বলে অভিযোগ উঠে। ওইদিন রাত ১২টার দিকে ডবলমুরিং থানা পুলিশ কলোনির মূল ফটক বন্ধ করে ভেতরে অভিযান চালিয়ে আসিফুজ্জামানের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, দুই রাউন্ড গুলি, একটি ম্যাগজিন ও একটি কিরিচ জব্দ করে।

অন্যদিকে ঘটনার নির্দেশদাতা ও চার্জশিটভুক্ত ২নং আসামি জিতুর বিরুদ্ধে বর্তমানে নগরের কোতেয়ালী, খুলশী ও পাঁচলাইশ থানার তিনটি মামলা আদালতে বিচারধীন আছে। ৩নং আসামি আছিবুর রহমান খালেদ হোসাইন অন্তরের অন্যতম সহযোগী। তার বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা আছে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, হত্যা, চাঁদাবাজি, হত্যাপ্রচেষ্টা ও চুরি মামলার মতো গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত সুজয়মান বড়ুয়া জিতু এখন চট্টগ্রাম মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটিতে জায়গা পেতে জোর লবিং করছেন, ধর্না দিচ্ছেন বিভিন্ন নেতার দুয়ারে। রাজনীতি সংশ্লিষ্টদের মতে, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও দুর্বৃত্তমুক্ত পরিশুদ্ধ স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতৃত্ব গঠনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তথা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতাদের যে অঙ্গীকার তা ভেস্তে যেতে পারে জিতুদের মতো বিতর্কিতরা কমিটিতে ঠাঁই পেলে।

এদিকে শুধু অর্পণের মামলা নয়, আসামিকে বাঁচাতে আরও অনেক মামলায় পুলিশ নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে বা নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সাধারণত অপরাধের প্রমাণ পেলে চার্জশিট দেওয়া হয়, আর প্রমাণ না পেলে ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া হয়। কিন্তু অনেক সময় এমনভাবে চার্জশিট দেওয়া হচ্ছে, যা ফাইনাল রিপোর্টের সমতুল্য।

২০১৮ সালের ৩০ জুলাই দিবাগত রাত ১টার দিকে নগরের বাকলিয়া থানার পশ্চিম বাকলিয়া হাফেজনগর এলাকার একটি বাসার দরজা ভেঙে ১৩ হাজার ৫০০ ইয়াবা জব্দ করে র‌্যাব। এর আগে বাড়িটির মালিকের ছেলে নাজিম উদ্দিন মিল্লাতকে ৬০০ ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। পাশাপাশি ওই বাসা থেকে পুলিশের ইউনিফর্ম, মাদক বিক্রির ২ লাখ ৩১ হাজার টাকা এবং একটি মোটরসাইকেলও জব্দ করা হয়। র‌্যাব বলছে, সাইফ ওই বাসাটি ভাড়া নিয়ে ইয়াবাব্যবসা করতেন। তবে তিনি পরিবার নিয়ে কল্পলোক আবাসিক এলাকায় থাকতেন। সাইফের সহযোগি ছিলেন গ্রেপ্তার মিল্লাত।

এ ঘটনায় র‌্যাব-৭ চট্টগ্রামের উপসহকারী পরিচালক নাজমুল হুদা একই বছরের ৩১ জুলাই বিকেলে নাজিম ও পলাতক এসআই সাইফকে আসামি করে বাকলিয়া থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেন। তদন্ত শেষে গত বছরের ২ ডিসেম্বর ওই মামলায় মিল্লাত ও সাইফকে আসামি করে চার্জশিট দিয়েছেন নগর গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন পরিদর্শক রাজেস বড়ুয়া। এতে ২৬ জনকে সাক্ষী রাখা হয়েছে।

চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে হাফেজনগর এলাকার ওই বাসায় প্রবেশের সময় মিল্লাতকে আটকের পর তার প্যান্টের পকেট থেকে ৬০০ ইয়াবা উদ্ধার করে র‌্যাব। এরপর এসআই সাইফের বাসার তালা ভেঙে মিল্লাতের দেখানো ও বের করে দেওয়া মতে, ভেতরে থাকা টেবিলের ড্রয়ার থেকে ১৩ হাজার ৫০০ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত ইয়াবা, নগদ টাকা ও অন্য আলামত এসআই সাইফের ভাড়া করা রুম থেকে উদ্ধার করার কারণে তাকে অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়েছে বলে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন।

তবে উক্ত চার্জশিটে তিনি লিখেছেন, সাইফের সোর্স হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি বাসার বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করেন মিল্লাত। বাসার চাবি থাকার সুবাদে সাইফের অবর্তমানে মিল্লাত উক্ত বাসায় অবাধে আসা-যাওয়া করতে পারতো বলে গোপনীয় তদন্তে জানা যায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলাটি বিচারের জন্য গেলে অভিযোগপত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে আসামি সাইফের পক্ষ থেকে বলা হতে পারে, বাসাটি তার জিম্মায় থাকলেও অপর আসামি মিল্লাতের কাছেও চাবি ছিল। সাইফকে ‘ফাঁসানোর’ জন্য তার অনুপস্থিতিতে মিল্লাত এসব ইয়াবা বাসায় রেখে দিয়েছেন। এ প্রেক্ষিতে ‘বেনিফিট অব ডাউট’ যুক্তিতে মামলার দায় থেকে এসআই সাইফকে মুক্তি দেওয়ার দাবি তার আইনজীবীরা জানাতে পারেন বলে মত দিয়েছেন চট্টগ্রাম আদালতের একজন আইনজীবী।

এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক রাজেস বড়ুয়া একুশে পত্রিকাকে বলেছেন, ‘মিল্লাতের কাছে সাইফের বাসার চাবি থাকতেও পারে, আবার না-ও থাকতে পারে। যতটুকু মনে পড়ে আমি সুনির্দিষ্ট করে কিছু লিখিনি। সে (সাইফ) তো বিভিন্নভাবে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে। অনেকভাবে সুযোগ নিতে পারে। কিন্তু আমি সে রকম সুযোগ রাখিনি। সত্য বিষয়টা তুলে ধরেছি।’

যদিও এসআই সাইফের বাসায় কীভাবে ইয়াবাগুলো গেল, সেখান থেকে ইয়াবাগুলো কোথায় যায়, আরো কারা জড়িত- সেসব বিষয়ে তথ্য আসেনি অভিযোগপত্রে। ২০ জনের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে জমা দিলেও সেগুলো প্রায় অভিন্ন। একা একা অভিযান, ইয়াবাব্যবসা করা তো এসআই সাইফের পক্ষে সম্ভব না; এক্ষেত্রে পুলিশের আরো কেউ যুক্ত থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অভিযোগপত্রে গ্রেপ্তার মিল্লাত ও সাইফ ছাড়া আর কাউকে অভিযুক্ত করা হয়নি। এককথায় মামলাটির বিস্তারিত তদন্ত হয়নি বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে অভিযোগপত্রভুক্ত এক নাম্বার আসামি মিল্লাতকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও তিনি জবানবন্দি দেননি।

অন্যদিকে এসআই খন্দকার সাইফকে গ্রেফতারের জন্য পরোয়ারা থাকলেও পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। অভিযোগপত্র দেওয়ার দু’মাস পর ২০১৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগর আদালতের পঞ্চম বিচারিক হাকিম সরোয়ার জাহানের আদালতে আত্মসমর্পণ করলে বিচারক সাইফকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
মামলার বাদি র‌্যাব-৭ চট্টগ্রামের তৎকালীন উপ সহকারী পরিচালক নাজমুল হুদা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘অভিযোগপত্রে কী আছে, না আছে- আমি কিছুই জানি না। আমাকে এ বিষয়ে অবহিত করা হয়নি।’

এদিকে ইয়াবা উদ্ধারের পর থেকে সাইফকে রক্ষার জন্য পুলিশের কিছু কর্মকর্তা তৎপর রয়েছেন, যারা এসআই সাইফের নানা অপকর্মের সহযোগি বলে অভিযোগ আছে। একই কারণে এ ঘটনায় জড়িত অন্যদের চিহ্নিত করা হচ্ছে না বলেও অভিযোগ।

পুলিশ বলেছে, এসআই সাইফ ঘটনার দিন ৩০ জুলাই রাতে বাকলিয়া থানা-পুলিশের হেফাজতে ছিলেন। পরদিন সকালে ‘অসুস্থতার’ কথা বলে বাকলিয়া থানার তৎকালীন ওসি প্রণব চৌধুরী তাকে ফোর্স দিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান চিকিৎসার জন্য। সেখান থেকে তিনি ‘কৌশলে’ পালিয়ে যান বলে সে সময় গণমাধ্যমকে জানান ওসি প্রণব চৌধুরী।

অভিযোগ রয়েছে, পালানোর সুযোগ করে দিতেই সাইফকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন বাকলিয়া থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। বিষয়টি জানার পর নগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ হন। এ ঘটনায় বাকলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ কবীর হোসেনকে ক্লোজ (প্রত্যাহার) করা হয়।

অভিযানে অংশ নেওয়া র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা একুশে পত্রিকাকে বলেন, বাকলিয়ার ওই বাসাটি ঘটনার দেড় বছর আগে ভাড়া নেন সাইফ। তিনি বাকলিয়া, চাক্তাই এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযানে ধরা পড়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগের বিরুদ্ধে মামলা না দিয়ে টাকা নিয়ে ছেড়ে দিতেন। পরে ওই ইয়াবাগুলো বাসায় রাখতেন। এরপর এগুলো বিক্রি করতেন।

এদিকে ২০১৯ সালের ১৮ এপ্রিল নগরের বায়েজিদে শাহাদাত হোসেন মৃধা নামের এক ব্যক্তিগত গাড়িচালককে খুনের মামলায় নিহতের ভাই অহিদুল ইসলামকে আসামি করে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। একইসঙ্গে এক কিশোরকে আসামি করে দোষীপত্র দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ১৪ অক্টোবর নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার এসআই গোলাম মোহাম্মদ নাসিম হোসেন এগুলো আদালতে জমা দেন।

পুলিশ বলছে, ওই কিশোরকে ছুরি দিয়েছিল নিহত ব্যক্তির ভাই। নিহত ব্যক্তির পরিবার বলছে, প্রধান আসামিকে বাঁচাতে পুলিশ শাহাদাতের ভাই অহিদুলকে আসামি করেছে। একইসঙ্গে প্রাপ্তবয়স্ক হলেও আসামিকে কিশোর বলে উল্লেখ করেছে। মামলার বাদী ও নিহত ব্যক্তির বাবা আবদুল হালিম মৃধা বলেন, আসামিকে বাঁচাতে পুলিশ কৌশল করেছে।

তিনি বলেন, আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় মামলা থেকে বাঁচতে আমার আরেক ছেলেকে পুলিশকে দিয়ে আসামি করেছে। ভাইকে হত্যার জন্য কোনো ছুরি দেননি অহিদুল। এ ছাড়া ঘটনার পরপর অহিদুল আমাকে হত্যার খবর দেন। মিথ্যা মামলায় আমার আরেক মেয়েকে ফাঁসিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ছেলে হত্যার বিচার চাওয়ায় একের পর মামলায় জড়ানো হয়েছে আমার ছেলেমেয়েদের।

তবে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বায়েজিদ বোস্তামী থানার তৎকালীন এসআই গোলাম মোহাম্মদ নাসিম হোসেন বলেন, আসামির স্বীকারোক্তি ও তদন্তে উঠে আসায় নিহত ব্যক্তির ভাইকে আসামি করা হয়েছে। সনদ অনুযায়ী আসামিকে কিশোর বলা হয়েছে।

এদিকে ২০১১ সালের ২৬ ডিসেম্বর রাতে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় আলোচিত চেয়ারম্যান নুরুল আবছার হত্যা মামলায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন আসামি মো. জসিমউদ্দিন। এতে তিনি বলেন, ‘ওসমান মামু আমাদের বলে, নুরুল আবছার প্রফেসরকে খুন করতে কত টাকা লাগবে? তখন মোনাফ চেয়ারম্যানও আমাদের সামনে বসা ছিল। আমি শাহ আলমকে বলি, তুমি দরদাম ঠিক করো। শাহ আলম ৮ লাখ টাকা চায়। মোনাফ চেয়ারম্যান ও ওসমান মামু পরামর্শ করে ৬ লাখ টাকা দিতে রাজি হয়। এর মধ্যে ২ লাখ টাকা অ্যাডভান্স দিতে রাজি হয়। মোনাফ চেয়ারম্যান তার টেবিলের ড্রয়ার থেকে দুই বান্ডেল টাকা বের করে ওসমানের হাতে দেয়। ওসমান মামু টাকাগুলো আমাকে দেয়। আমি টাকাগুলো শাহ আলমকে দেই। মূলত রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে ওসমান ও উপজেলা চেয়ারম্যান মোনাফ আমাদের দিয়ে নুরুল আবছার চেয়ারম্যানকে হত্যা করিয়েছে।’

শুধু এ আসামি নন, আরো চার জন আসামি তাদের দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে খুনের পরিকল্পনাকারী হিসেবে ওসমান ও মোনাফের নাম বলেছেন। কিন্তু চাঞ্চল্যকর এই খুনের পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা ওসমান ও মোনাফকে বাদ দিয়ে বাকি ১৩ আসামির বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে চার্জশিট দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা সাতকানিয়া সার্কেলের তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান মোল্যা।

উক্ত তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি দেন বাদী। নারাজি আবেদন আংশিক গ্রহণ করে চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জয়ন্তী রাণী রায় আদেশে বলেছেন, “মামলার আসামি জসিমউদ্দিনসহ পাঁচ আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং রাষ্ট্রপক্ষে ৩৪ জন সাক্ষীর ১৬১ ধারায় জবানবন্দি পর্যালোচনায় দেখা যায়, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আসামি মোনাফ ও ওসমান গণি চৌধুরী জড়িত।

এছাড়া ১৮ জন সাক্ষী আসামি মোনাফ, ওসমান গণি, আবু তাহের, সারোয়ার সালাম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত মর্মে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আসামি ও সাক্ষীদের জবানবন্দিতে খুনের সঙ্গে এদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ার পরেও কোন আইনবলে এবং কীভাবে চার্জশিট থেকে এদের অব্যাহতি দিতে তদন্ত কর্মকর্তা আবেদন করেছেন, তা আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

আসামি জসিমের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সত্য না মিথ্যা, ষড়যন্ত্র হয়েছিল কি হয়নি বা কবে থেকে শুরু হয়েছে তা বিচারিক আদালতের বিষয়। তদন্ত কর্মকর্তার এ ধরনের কর্মকাণ্ড অগ্রহণযোগ্য ও আইনবহির্ভূত। এতে ওনার তদন্তকাজে স্পষ্ট অদক্ষতা ও অবহেলার বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। সার্বিক পর্যালোচনায় মোনাফ, ওসমান, আবু তাহের ও সারোয়ার সালামের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪/১০৯ ধারার অপরাধ আমলে নেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ বিদ্যমান থাকায় তাদের চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু করা হলো।”

এদিকে উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে দায়রা জজ আদালতে রিভিশন করে আসামিরা। কিন্তু রিভিশন খারিজ করে দেয় আদালত। এই আদেশে সংক্ষুব্ধ হয়ে হাইকোর্টে মামলা বাতিলের আবেদন করেন মোনাফ ও ওসমান গণি। আবেদনের পক্ষে কুমার দেবুল দে ও রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী শুনানি করেন। হাইকোর্ট মামলা বাতিলের আবেদন উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করে দেয়।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে কারো নাম আসার পর তাকে অব্যাহতি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ত্রুটিপূর্ণ চার্জশিট কেন দেওয়া হয়, সেটা সবাই জানেন। পুলিশের ভেতর শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সরষের মধ্যে ভূত থাকলে কিছুই হবে না।

এদিকে আসামিকে বাঁচাতে কিছু তদন্তকারী কর্মকর্তার নানা কৌশলের আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) সামছুল আলম একুশে পত্রিকাকে বলেন, একটি মামলার তদন্ত শেষ করতে দুই মাস, তিন মাস কিংবা এক বছর সময় লাগে। তদন্তকারী কর্মকর্তা এজাহারে বর্ণিত ঘটনাটি কখন, কোথায়, কীভাবে ঘটেছে তার গভীরে গিয়ে তদন্ত করেন, সাক্ষ্য-প্রমাণ নেন। তদন্তে যে পেলেন তা চার্জশিটে উল্লেখ করেন। আর তদন্তকারী কর্মকর্তা যে চার্জশিটটি আদালতে জমা দেন, সেটি যে আদালত গ্রহণ করবেন এমন তো কথা নেই। ধরুন একজন আসামির বিরুদ্ধে ৩০৭ ও ৩২৫ ধারার অভিযোগ আনলেন মামলার বাদি, এখন ওই আসামির বিরুদ্ধে এর আগে একাধিক খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি খুনের অভিযোগে মামলা ছিল। এখন সেই আসামি কি ভাল হতে পারে না। আর একজন অফিসার শুধু মামলা তদন্ত করেন কিন্তু তার তদন্ত তদারকি করেন ওসি, এসি এবং ডিসি। সুতরাং আসামি বাঁচাতে পুলিশ কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে এ কথা সঠিক নয়।