১৮ মাস পরও খুলল না সিজিএস, সরকারি নির্দেশনার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি

জোবায়েদ ইবনে শাহাদত : শিক্ষা মন্ত্রণালয় যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সশরীরে উপস্থিতিতে শিক্ষাকার্যক্রম চালু করার সরকারি নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে চিটাগাং গ্রামার স্কুল (সিজিএস)। শ্রেণীকক্ষের বদলে এখনো অনলাইনে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করছে স্কুলটি। অথচ গত রোববার (১২ সেপ্টেম্বর)  থেকে দেশের সকল স্কুল সরকারি নির্দেশনা খুলে দিয়েছে।

স্কুল বন্ধ রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করে চিটাগাং গ্রামার আপার স্কুলের (সিজিএস) এক শিক্ষক একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সশরীরে উপস্থিত হয়ে ক্লাস পরিচালনার কোনো নির্দেশনা আমাদের দেওয়া হয়নি। আর স্কুল কেন খোলা হয়নি সেটা ম্যানেজমেন্টই ভালো বলতে পারবে। তবে আমরা অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছি।’

সিজিএস স্কুলের সিকিউরিটি গার্ড মো. ফরিদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, আমাদের স্কুল এবং স্কুলের অফিস এখনও বন্ধ। কেন খোলা হয়নি বা কবে নাগাদ স্কুল খুলবে সেটা আমাদের অবগত করা হয়নি। যতটুকু শুনছি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে স্কুল পরিদর্শন করে দেখবেন। তারা যদি মনে করেন স্কুল খোলার মত পরিবেশ রয়েছে তাহলে হয়তো কর্তৃপক্ষ স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত নিবেন।

এদিকে, স্কুল না খুলে অনলাইনে ক্লাস পরিচালনার এমন সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ক্ষুব্ধ অভিভাবকেরাও। তাদের মতে, সরকারের নির্দেশনার চেয়ে নিজেদের জেদই বড় করে দেখছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। যদিও এই বিষয়ে মুখ খুলতে আপত্তি রয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষের। সরকারি নির্দেশনার বিপক্ষে অবস্থান করে কেন এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সে সম্পর্কে জানাতে রাজি নয় তারা।

চিটাগাং গ্রামার স্কুলের (সিজিএস) শিক্ষার্থীর অভিভাবক মো. খালেদ মাহমুদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, সিজিএস এর মত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ক্ষেত্রে সরকারি বিধিনিষেধ ও নির্দেশনা অমান্য করার প্রবণতা অনেক আগে থেকেই লক্ষণীয়। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুলের শিক্ষার্থীদের সশরীরে উপস্থিতির মাধ্যম ক্লাস নেওয়ার করা থাকলেও স্কুলটি উল্টো পথে হাঁটছে।

তিনি বলেন, স্কুল খোলা থাকবে নাকি বন্ধ থাকবে এমন প্রশ্ন করে এসংক্রান্ত অভিভাবকদের মতামত জানতে চেয়ে কয়েকদিন আগে স্কুল কর্তৃপক্ষ আমার কাছে একটি চিঠি পাঠায়। আমি এর উত্তর দেইনি। কারণ যেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নির্দেশ দিয়েছে স্কুল খোলার সেখানে তাদের এই প্রশ্ন করার কোনো যৌক্তিকতা আমি দেখছি না। সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ তো এমন কাজ করতে পারে না।-যোগ করেন খালেদ মাহমুদ।

স্কুলটির বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের থেকে নির্দেশনা ছিল করোনা পরিস্থিতির কারণে স্কুলের টিউশন ফি’র জন্য অভিভাবকদের চাপ দেওয়া যাবে না। কিন্তু মাস শেষ হতে না হতেই সিজিএস অভিভাবকদের বেতনের জন্য চাপ দিতো। আমাদের ফোন করে বলতো এটা নাকি ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্ত। সর্বশেষ আগস্ট মাসের বেতন দিতে কয়েকদিন দেরি হওয়ায় স্কুলের একাউন্টস থেকে আমাকে ফোন করে বেতনের জন্য চাপ দেয়। সেবা খাতকে তারা ব্যবসা খাত করে ফেলেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক অভিভাবক বলেন, ‘চট্টগ্রামসহ সারাদেশে স্কুলের শিক্ষার্থীদের সশরীরে উপস্থিতির মাধ্যমে পাঠদান করা হচ্ছে। কিন্তু সিজিএস স্কুল না খুলে অনলাইনেই তাদের পাঠদান করছে। আর এর মাধ্যমে নিশ্চিতভাবেই সরকারের নির্দেশনা লঙ্ঘন করা হয়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ কি এতোটাই প্রভাবশালী যে সরকারের নির্দেশনা লঙ্ঘনের পরও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না!’

সিজিএস আপার স্কুলের এক শিক্ষার্থী একুশে পত্রিকাকে বলেন, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর স্কুল খোলার নির্দেশে আমরা খুবই খুশি ছিলাম। আমাদের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা ও প্রফুল্লতা কাজ করছিল। অনেকদিন পর স্কুলে যাব, সহপাঠীদের সাথে দেখা হবে, শিক্ষকদের সান্নিধ্যে পড়ালেখা করব এটা ভেবেই ভালো লাগছিল। কিন্তু আমাদের স্কুল খোলার পরিবর্তে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। অথচ বাকি সব স্কুল খোলা।

একই স্কুলের ২ শ্রেণীর এক ছাত্র বলেন, আগের ইউনিফর্মটি ছোট হয়ে যাওয়ায় ৩ তারিখই নতুন করে ইউনিফর্ম সেলাই করেছি। জানতাম ১২ তারিখ স্কুল খুলবে। প্রায় ১৮ মাস পর স্কুলে যাওয়ার কথা ভেবে আগের দিন রাতে ঘুমই আসেনি। কিন্তু পরদিন স্কুল থেকে জানাল অনলাইনে ক্লাস হবে, এখন স্কুল খুলছে না। গত দুদিন ধরে অনলাইনেই ক্লাস করছি।

বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল প্যারেন্টস ফোরামের আহ্বায়ক ব্যারিস্টার আফরোজা আক্তার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অমান্য করে চিটাগাং গ্রামার স্কুলের (সিজিএস) অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার বিষয়ে স্কুলটির বেশকিছু অভিভাবক আমাদের অভিযোগ করেছেন। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল কর্তৃপক্ষ যে প্রথমবারের মত সরকারের নির্দেশনা অমান্য করেছে তা নয়। পূর্বেও স্কুলগুলোর আইন লঙ্ঘনের বেশকিছু ঘটনা আমরা দেখেছি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি আমলে এনে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারীর কারণে গত বছর মার্চ থেকে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিকল্প হিসেবে স্কুলে না গিয়ে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এটা তো স্থায়ী কোনো সমাধান না। এসব ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। এমন সময় শিক্ষামন্ত্রণালয়ের স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু সিজিএস’র মত স্বনামধন্য স্কুল কেন এখনও অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না।’

এ বিষয়ে চিটাগাং গ্রামার স্কুলের (সিজিএস) অধ্যক্ষ তাহসিন খানের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। ফোনে এবিষয়ে কোনো কথা বলবেন না বলে জানান।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মু. মাহমুদ উল্লাহ মারুফ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সরকারি বিধিনিষেধ ও নির্দেশনা অগ্রাহ্য করার এখতিয়ার কারো নেই। এই বিষয়ে আমার জানা ছিল না। যেহেতু জানতে পেরেছি আমি খোঁজ নিয়ে আগামীকালই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’