‘লেদু ফুফু’ একাই দাফন করেন ২২ জনকে!

শরীফুল রুকন, সৈদালী (মিরসরাই) থেকে ফিরে : চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের সৈদালী গ্রাম। ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল এই গ্রামে গণহত্যা চালায় পাকবাহিনী। এতে শহীদ হন এক নারীসহ ২২ জন। তখন লাশগুলো দাফন করার কেউ ছিল না। পুরো এলাকা হয়ে পড়েছিল পুরুষশূন্য। এ অবস্থায় লাশগুলো ‘দাফনে’ এগিয়ে আসেন এক নারী। সবাই তাকে চিনতেন, ডাকতেন ‘লেদু ফুফু’ নামে।

সাহসী এই নারীর স্মৃতিচারণ করেন সোনালী ব্যাংকের সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ও সৈদালীর সন্তান আ আ ম শাহজাহান, ‘যুদ্ধের সময় আমি ৬ষ্ঠ কিংবা ৭ম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। ২০ এপ্রিল হানাদার বাহিনী সৈদালী গ্রামে গণহত্যা ও আগুন জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়। এসময় একটি পরিবারের পাঁচজনসহ ২২জন শহীদ হন। এসব লাশ দাফনের জন্য কোনো পুরুষ ছিল না। তখন আমরা দেখেছি, লেদু ফুফু সবার আগে এগিয়ে এসে লাশ দাফনের মূল কাজটি করেন।’

২০ এপ্রিলের স্মৃতি ধরে রাখা সাবেক এই ব্যাংকার বলেন, ‘দাফন বলতে কবরের মত খুঁড়ে তাতে মাটি চাপা দেওয়া আর কী। গ্রামের আরও কয়েকজন মহিলাকে সাথে নিয়ে পৃথক পৃথক স্থানে গর্তের মতো খুঁড়ে লাশ দাফন করেন লেদু ফুফু। তিনি অন্য মহিলাদের চেয়ে একটু ব্যতিক্রম ছিলেন। অনেক সাহসী, একেবারে জাঁদরেল টাইপের ছিলেন। সবাই যখন প্রাণ বাঁচাতে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখনই তিনি কঠিন কাজটি করেন।’

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় লেদু ফুফুর বয়স ছিল ৩৫ থেকে ৪০ বছর। যুদ্ধের আগে স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হলে সৈদালীর নিজ গ্রামে চলে আসেন তিনি। তার এক ছেলে থাকলেও যুদ্ধের আগে মারা যায়। সৈদালী নাগরিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, ‘গ্রামে কোনো বাড়িতে রান্নার বিশেষ আয়োজন হলে, লেদু ফুফুর ডাক পড়তো। সৈদালী গ্রামের সব বাড়িতে তার অবাধ যাতায়াত ছিল। সবাই খুব সম্মান করতেন।’

গত ১৮ এপ্রিল বার্ধক্যজনিত রোগে লেদু ফুফু মারা গেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘লেদু ফুফুর দূর সম্পর্কের আত্মীয় হন বড়তাকিয়া বাজারের ব্যবসায়ী নুর মোহাম্মদ। তার বাড়িতেই জীবনের শেষ সময়টুকু পার করেন লেদু ফুফু। বর্তমানে লেদু ফুফুর কোনো ওয়ারিশ নেই।’

এদিকে ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল পাক সেনাবাহিনীর গণহত্যার ঘটনার পর এই প্রথমবারের মত ‘সৈদালী গণহত্যা দিবস’ পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে মধ্যম সৈদালী জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে তৈরি হয় বাঁশ, ইট ও কালো কাপড়ের স্মৃতিস্তম্ভ। অস্থায়ী এই স্মৃতিস্তম্ভে লেখা হলো শহীদদের নাম। গত ২০ এপ্রিল সন্ধ্যায় সেই স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। একইদিন বিকেলে সৈদালী নাগরিক ফোরাম আয়োজন করে আলোচনা সভা, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল।

কোন প্রেক্ষাপটে সৈদালী গ্রামে গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী? ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল সকালে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় পাকবাহিনীর বিশাল গাড়ি বহর। মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া বাজার অতিক্রম করার সময় ১১টার দিকে ওই বহরের উপর আক্রমণ করেন কর্ণেল (অব.) অলি আহমদের নেতৃত্বে সশস্ত্র যোদ্ধারা। দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত চলে প্রতিরোধযুদ্ধ। পরে গোলাবারুদ ফুরিয়ে গেলে পিছু হটেন মুক্তিকামী যোদ্ধারা। এ প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ হন হাবিলদার সিদ্দিক ও ল্যান্স নায়েক আবুল কালাম। ওই যুদ্ধে দুই থেকে আড়াইশ পাক আর্মি হতাহত হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধারা জানিয়েছেন।

এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হানাদার বাহিনী প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে বিকেল ৩টার দিকে বড়তাকিয়া বাজারের পাশের সৈদালী গ্রামে প্রবেশ করে। সেখানে রাত আটটা পর্যন্ত অবস্থান করে ২২জন নিরীহ নারী-পুরুষকে হত্যা করে। ধর্ষণ করা হয় দুই গৃহবধূকে। জ্বালিয়ে দেয়া হয় গ্রামের শতাধিক ঘরবাড়ি। নিহত ২২ জনের মধ্যে ২১ জনকে গ্রামের ভূঁইয়া পুকুরপাড়, লুতু পুকুরপাড় ও বিভিন্ন জমির গণকবরে সমাহিত করা হয়। অন্য একজনের লাশ খুঁজে পাননি স্বজনরা।

অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার উল্লাহ্ সেদিনের স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘পাকবাহিনী গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে আগুন দিতে শুরু করে। দৌড়ে বাড়িতে গিয়ে দেখি পাঁচজন পাকসেনা দাঁড়িয়ে আছে। সাথে আমার চাচারাও ছিলেন। দুই পাকিস্তানি সৈন্য আমাকে উদ্দেশ্যে করে বলেন, এদিকে আয়। আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে থাকলাম। তখন আমার চোখের সামনে মেজ চাচাকে গুলি করে দিল। চাচা তখন মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। নড়াচড়া করে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়েন।’

‘এরপর একজন ছাড়া অন্য পাকিস্তানি সেনারা বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে চলে গেলেন। বুঝলাম, ওই সেনা সদস্য আমাদেরকে মারার জন্য অপেক্ষা করছে। আমার ছোট চাচার সঙ্গে কথা বলে সে পেছনে ১০ হাত দূরে সরে যায়। এরপর ৫-৬টা গুলি করে। এই সময় আমি কীভাবে যে বসে গেলাম, নিজেই জানি না। আমার পেছনে থাকা ছোট চাচার গায়ে গুলি লেগে তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন।’

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দেন আনোয়ার উল্লাহ্, ‘চোখের সামনে এই দৃশ্য দেখে আমি ওই সৈন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। অস্ত্র নিয়ে তার সাথে টানা-হেঁচড়া করি। একপর্যায়ে আমাকে সে বুট দিয়ে এমন এক লাথি মারলো, যেটা গুলির চেয়েও ভয়াবহ। উঠানে তখন একটা খেঁজুর গাছ ছিল। টানাটানির একপর্যায়ে সে খেঁজুর গাছে আঘাত পেলে অস্ত্রটা আমার হাতে চলে আসে। রাইফেল হাতে আসার আগে আমার ডান হাতে গুলি লেগেছিল। ডান হাত দিয়ে আমি রাইফেলটা চালাতে পারছিলাম না। এরপর বাম হাত দিয়ে রাইফেলটা ছুঁড়ে ফেললাম। সেটা ১০-১২ গজ দূরে গিয়ে পড়লো। সে রাইফেলের জন্য দৌড় দিল। আর আমি বিপরীত দিক দিয়েই দৌড় দিয়েছি।’

মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার উল্লাহ আরও বলেন, ‘এরপর নুর হোসেন লাতু (মুক্তিযোদ্ধা) আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সুস্থ হয়ে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। এরপর মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশ স্বাধীনে অংশগ্রহণ করেছি।’

মায়ানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কবির আহম্মদ নিজামী বলেন, ‘সৈদালী গ্রামে যে গণহত্যা হয়েছে, তা এতদিন অপ্রকাশিতই থেকে গেছে। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর প্রথমবারের মত গত ২০ এপ্রিলকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করেছে এলাকাবাসী। সৈদালী গ্রামের শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে শহীদদের নামসম্বলিত একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দায়িত্ব আমি নিয়েছি। শহীদদের কবরকে উন্নয়নসাধন করে সংরক্ষণ করা হবে।’

সৈদালী নাগরিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, ‘সৈদালী গ্রাম থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেন ২৪ কিশোর-যুবক। যাদের মধ্যে বর্তমানে ১৭ জন বেঁচে আছেন। সবাই মিলে গণহত্যার ঘটনা গবেষণা-অনুসন্ধান শেষে বই আকারে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘গণহত্যায় নিহতদের স্বজনরা এখনো অসহায়। পরিবারের একমাত্র উপর্জনক্ষম ব্যক্তি নিহত হওয়ার কারণে কেউ কেউ এখনো দারিদ্র্যতার সাথে লড়াই করে যাচ্ছে। এসব পরিবারকে সাধ্যমত সহযোগিতার জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি।’

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মিরসরাই উপজেলা কমান্ডার কবির আহাম্মদ বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব স্থানে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, সেসব স্থান ইতিহাসের একটি অংশ। সৈদালী গ্রামে গণহত্যার ঘটনাটি চাপা পড়ে গিয়েছিল। অথচ এটি ইতিহাসের পাতায় ঠাঁয় নেয়ার মত বড় ঘটনা।’

গণহত্যায় নিহত হন যারা :
২০ এপ্রিল সৈদালী গণহত্যার ঘটনায় নিহত ২২জন হলেন- মোখলেছুর রহমান, আবুল কালাম প্রকাশ হোরা মিয়া, আমীর হোসেন, খোরশেদ আলম, মকছুদ আহম্মদ, নজির আহম্মদ, সুলতান আহম্মদ, কবির উদ্দিন, শেখ আহম্মদ, আব্দুল মালেক, জোবায়দা খাতুন, তমিজ উদ্দিন, হাকিম বক্স, বেদন আলী, জায়দ আলী, সামছুল আলম ভুঁইয়া, নুরুল আলম ভুঁইয়া, ফকির আহম্মদ, রহিম বক্স, আব্দুর রশিদ, মফিজুর রহমান, হোসেনের জামান। এদিকে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সৈদালী গ্রামের বাসিন্দা ও মুক্তিযোদ্ধা বজলুর রহমান।