মামলা থেকে মুক্তি পেলেও পাসপোর্ট মিলছে না


মোহাম্মদ রফিক : মামলা থেকে মুক্তি পেলেও পুলিশ ও পাসপোর্ট অফিসের অদক্ষতা ও অপেশাদার আচরণের কারণে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার এক যুবক পাসপোর্ট পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ভুক্তভোগী রাঙ্গুনিয়ার পদুয়া ইউনিয়নের শারাশিয়া গ্রামের মো. হাসান মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে প্রায় পাঁচমাস আগে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে পাসপোর্ট পেতে আবেদন করেন।

কিন্তু তার বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাঙ্গুনিয়া থানায় দায়ের হওয়া একটি হত্যাপ্রচেষ্টা মামলার অজুহাত দেখিয়ে পাসপোর্ট ইস্যু করছে না কর্তৃপক্ষ।

যদিও ওই মামলায় হাসানকে বাদ দিয়ে মামলার এজাহারভুক্ত অপর দুই আসামি আবুল কাশেম এবং নুরুল আবসারকে অভিযুক্ত করে ২০১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আদালতে চার্জশিট দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা রাঙ্গুনিয়া থানার তৎকালীন ওসি মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর।

পরে ২০১৬ সালের ১৬ মার্চ চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মুন্সী মশিউর রহমানের আদালতের রায়ে অভিযুক্ত দুজনও বেকসুর খালাস পেয়ে যান।

হাসানের অভিযোগ, চার্জশিট থেকে তার নাম বাদ যাওয়া এবং অভিযুক্ত দুই আসামিও আদালতের রায়ে খালাস পাওয়ার সই মুহুরী নকল পুলিশ এবং পাসপোর্ট অফিস কর্তৃপক্ষকে দেখালেও তা আমলে নিচ্ছে না কেউই।

এছাড়া পাসপোর্ট পেতে পুনরায় তদন্তের আবেদন প্রস্তুত করলেও তা গ্রহণ করছেন না চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের সহকারী পরিচালক সাধন সাহা।

অপরদিকে স্বপ্রণোদিত হয়ে পুলিশও বিষয়টি পাসপোর্ট অফিস কর্তৃপক্ষকে জানাচ্ছে না। এ অবস্থায় পাসপোর্টের জন্য পাসপোর্ট অফিস এবং রাঙ্গুনিয়া থানা পুলিশের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন হাসান।

এর আগে গত ১২ এপ্রিল নগরের মনসুরাবাদ চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে ‘সাধারণ’ শ্রেণির পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন মোহাম্মদ হাসান। দশ বছর মেয়াদি পাসপোর্টটি তাকে সরবরাহ করার কথা ছিল ৪ মে। তার পাসপোর্ট ডেলিভারি স্লিপ নম্বর ৪০০৬-০০০০৫৩৪৭৪।

আবেদনের পর নাম-ঠিকানা তদন্তকালে রাঙ্গুনিয়া থানার সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা পাসপোর্ট অফিসে হাসানের পক্ষে ইতিবাচক প্রতিবেদন পাঠানোর কথা বললেও তিনিই মামলার বিষয়টি প্রতিবেদনে উল্লেখ করে দেন।

ওই পুলিশ কর্মকর্তা হাসানের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার সর্বশেষ অবস্থা যাচাই না করেই পাসপোর্ট অফিসে জমা দেয়া প্রতিবেদনে হাসানের বিরুদ্ধে শুদু মামলা থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেন।

প্রতিবেদনে মামলা থাকার বিষয়টি উল্লেখ করায় কর্তৃপক্ষ তার পাসপোর্ট ইস্যু করছে না। ফলে হাসানের বিদেশ যাওয়া অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে।

অথচ আইন অনুযায়ী, মামলা থেকে মুক্তি পেলে যে কারও পাসপোর্ট পাওয়ার কথা। বাংলাদেশের পাসপোর্ট ও ভ্রমণ বিষয়ক কার্যক্রম পরিচালিত হয় এই ১৯৭৩ সালের পাসপোর্ট আদেশের মাধ্যমে।

বাংলাদেশ পাসপোর্ট আদেশ ১৯৭৩-এর ৬ ধারা অনুযায়ী পাসপোর্ট কতৃর্পক্ষ যে সব কারণে কোনো ব্যক্তির পাসপোর্ট বা ভ্রমণ দলিল প্রত্যাখ্যান করতে পারেন:

– যদি আবেদনকারী বাংলাদেশে নাগরিক না হন।

– যদি আবেদনকারী বাংলাদেশ দালাল আদেশ ৭২ এর অধীনে দোষী প্রমাণিত হয়ে থাকেন।

– যদি আবেদনকারী আবেদন করার পূর্বের পাঁচ বছরের মধ্যে যে কোনো সময় বাংলাদেশের যেকোনো আদালত কর্তৃক নৈতিক অসচ্চরিত্রতাজনিত অপরাধের জন্য অন্তত দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে থাকেন।

– যে আবেদনকারী মুদ্রা, মাদকদ্রব্য, অস্ত্র চোরাচালান, মহিলা এবং দাসের ব্যবসা, অবৈধ বৈদেশিক মুদ্রা অথবা বৈদেশিক বিনিময় মুদ্রা সংক্রান্ত ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত আছে বলে সন্দেহ করা হয়েছেন বা দোষী সাব্যস্ত হয়ে থাকেন।

– যে আবেদনকারী বাংলাদেশের কোনো ফৌজদারী আদালতে বিচারাধীন কোনো কার্যধারা এড়িয়ে যাচ্ছেন বা এড়াবার সম্ভাবনা আছে অথবা কোনো আদলত থেকে বাংলাশের বাইরে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

– যে আবেদনকারী তার অনভিপ্রেত কার্যকলাপের দরুণে আগে কোনো দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন।

– যে আবেদনকার স্বদেশে পূর্নবাসিত হয়েছেন কিন্তু পূর্নবাসনের খরচ তিনি প্রত্যার্পন করেন নি।

– যে আবেদনকারী নি:স্ব হওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং তার পূর্নবাসন সরকারি তহবিলের উপর বোঝাস্বরূপ হবে।

– যে নাবালকের জন্য আবেদন করা হয়েছে তাকে আদালতের আদশে লঙ্ঘন বা বৈধ অভিভাবকের মতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার হচ্ছে বলে সন্দেহ করা হয়।

– যে আবেদনকারী শারীরিক বা মানসিক সমস্যায় ভুগছেন এবং যদি তার বৈধ অভিভাবক বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি সঙ্গে না থাকলে সে নিজের তত্ত্বাবধান নিজে করতে পারবে না।

এছাড়া যদি
– সরকারের মতে আবেদনকারী বাংলাদেশের বাইরে বাংলাদেশের সাবভৌমত্ব বা নিরাপত্তার পক্ষে ক্ষতিকর কাজে জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

– সরকারেরর মতে আদেবদনকারী আইনের অধীনে জনস্বার্থে দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য কিন্তু কর্তব্য এড়ানোর বা এড়ানোর চেষ্টা করছে বলে যুক্তিসঙ্গত ভাবে সন্দেহ করা হয়।

– যে সরকারের মতে আবেদনকারী বরাবরের কোনো পার্সপোর্ট বা ভ্রমণ দলিল ইস্যু জনস্বার্থে হবে না।

উপরোক্ত কোন কারণই রাঙ্গুনিয়ার হাসানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তবুও তাকে পাসপোর্ট না দেয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের পরিচালক আবু সাইদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘পুলিশ প্রতিবেদনে হাসানের বিরুদ্ধে মামলা থাকার বিষয়টি উল্লেখ থাকায় পাসপোর্ট ইস্যু করা যাচ্ছে না। মামলার দায় থেকে অব্যাহতি পাওয়ার উপযুক্ত ডকুমেন্টসহ সাদা কাগজে তাকে আবেদন করতে হবে।’

আদালতের রায়ের সই মুহুরী নকলসহ নতুন করে আবেদন প্রস্তুত করলেও পাসপোর্ট অফিসে সেটি গ্রহণ করা হচ্ছে না- এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পাসপোর্ট অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আবু সাইদ সদুত্তর দেননি।

এ প্রসঙ্গে রাঙ্গুনিয়া থানার ওসি মাহবুব মিল্কি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘পাসপোর্ট আবেদনকারী হাসানকে অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেয়া এবং মামলাটি আদালতের রায়ে নিষ্পত্তি হওয়ার বিষয়টি সিডিএমএস রেকর্ডে নেই। তাই তার বিরুদ্ধে মামলা থাকার বিষয়টি জেলা বিশেষ শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন। এখন তাকে (হাসান) আদালতের রায় এবং অভিযোগপত্রের সই মুহুরী নকল নিয়ে পাসপোর্টের জন্য পুনরায় আবেদন করতে হবে। এরপর জেলা বিশেষ শাখা থেকে আমাদের কাছে প্রতিবেদন চাইলে আমরা পাঠাবো।’