মিলে গেলেন দুই নেতা, বেকায়দায় প্যানেল মেয়র হাসনী !

চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক চৌধুরী হাসান মাহমুদ হাসনীকে ‘মাইনাস’ কিংবা দূরে রাখার শর্তে মুজিবনগর দিবস উপলক্ষে এক হয়েছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী ও আ জ ম নাছির। ইতোমধ্যেই খবরটি বেশ চাউর হয়েছে।

চট্টগ্রামের রাজনীতিতে শব্দযুদ্ধের মাধ্যমে গত এক সপ্তাহ ধরে তুমুল উত্তাপ ছড়ানোর পর সামনে এসে হাজির হয় মুজিবনগর দিবস। দুই নেতার বিরোধ এত বেশি তুঙ্গে উঠেছিল যে, ঐতিহাসিক এই দিবস উপলক্ষে মহানগর আওয়ামী লীগের কর্মসূচি পালন নিয়েও একটা সংশয়, অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। রাজনীতিতে এতটা ‘আগুন’ ছড়িয়ে খুব সহসা একসঙ্গে এক মঞ্চে বসাটা ছিল দুইনেতার জন্য অনেকটা কঠিন ও ‘বিব্রতকর’।

কিন্তু শীর্ষ দুই নেতার বিরোধের কারণে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অঞ্চলভিত্তিক দ্বিতীয় বৃহত্তম ইউনিট চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের মুজিবনগর দিবসে কোনো কর্মসূচি না থাকলে তা হবে আত্মঘাতি, ভয়ঙ্কর। দুই নেতার পাশাপাশি এই উপলব্ধি তৈরি হয় মহানগর ইউনিটের অন্যান্য নেতাকর্মীর মাঝেও।
সবার এই উপলব্ধি সামনে রেখে মুজিবনগর দিবসের কর্মসূচিতে দুই নেতাকে একজায়গায় আনতে উদ্যোগ নেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন, ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক মো. রেজাউল করিম চৌধুরী, নোমান আল মাহমুদ, শফিক আদনান, শেখ ইফতেখার সাইমুলসহ ১৬ জন নেতা। গত শনি ও রোববার জামালখান-ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায় দুই আওয়ামী লীগ নেতার বাসায় এ নিয়ে দুই দফা বৈঠক হয়।

বৈঠকে সব ছাপিয়ে ঘুরে ফিরে আলোচনার বিষয় ছিলো মহিউদ্দিন চৌধুরীকে নিয়ে প্যানেল মেয়র হাসান মাহমুদ হাসনীর দেওয়া বক্তব্য, বিষোদ্গার। বৈঠকে আলোচনা হয়, শীর্ষ দুই নেতা একে অপরকে নিয়ে বিষোদ্গার করেছেন, করছেন। তারা আবার একসঙ্গে, একমঞ্চে রাজনীতিও করেন। কিন্তু এই ইস্যুতে মহিউদ্দিন চৌধুরীর মতো একজন রাজনীতিককে নিয়ে হাসনীর বক্তব্য বেমানান এবং তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই রোববার নগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি জহিরুল আলম দোভাষের বাসভবনে ১৬ নেতার রুদ্ধদ্বার বৈঠকে প্রথমে সিদ্ধান্ত হয় এ নিয়ে একটি সমন্বিত বিবৃতি প্রদানের। পরক্ষণে আ জ ম নাছির অনুসারীদের অনুরোধে সে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে হাসান মাহমুদ হাসনীকে মুজিবনগর দিবসের কর্মসূচি থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত হয়।

এছাড়া মুজিবনগর দিবসে উপস্থিত হলে প্যানেল মেয়র হাসনী মহিউদ্দিন চৌধুরী অনুসারী নেতাকর্মীদের রোষানলে পড়তে পারেন, সৃষ্টি হতে পারে বিশৃঙ্খলা- এই আশঙ্কা জানিয়ে সিএমপির নগর বিশেষ শাখার প্রতিবেদনটিও ১৬ নেতার আলোচনায় চলে আসে। তাই সবকিছু বিবেচনায় হাসনীকে বাইরে রেখেই সোমবার বিকেলে মুজিবনগর দিবসের কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হলো। সেই অনুষ্ঠানে হাতে হাত রেখে দুই নেতা (মহিউদ্দিন-নাছির) ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার ঘোষণা দেন। মাত্র ১৮ মিনিটেই নিভে যায় ৮ দিনের উত্তাপ।

এই অবস্থায় প্রশ্ন এসেছে, হাসান মাহমুদ হাসনীর এখন কী হবে? দুই নেতা মিলে গেলেন, মাঝখানে মহিউদ্দিন অনুসারীদের ‘টার্গেটে’ পরিণত হলেন হাসনী।

মহিউদ্দিন-নাছিরের তুমুল আক্রমণাত্মক বক্তব্যে রাজনৈতিক উত্তাপের মাঝেই গত ১১ এপ্রিল চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কাউন্সিলরদের আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে হাসান মাহমুদ হাসনী মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রয়াত স্ত্রী শাহেদা মহিউদ্দিনকে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে এ হত্যাকান্ডের জন্য মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রতি ইঙ্গিত করে বক্তব্য রাখেন। এছাড়া মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসায় কাজের মেয়ে রানু, সন্তোষ, রবি, ওয়াজিউল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে উল্লেখ করে হাসনী বলেন, হত্যাকাণ্ডগুলো এ শহরের প্রবীণ মানুষদের বিবেককে এখনও নাড়া দেয়।

হাসনীর এই বক্তব্যের সংবাদ ও ভিডিও মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায় ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোযোযোগ মাধ্যমে। তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় নানা মহলে। এ যেন রাজনীতিতে নতুন উত্তাপ, আগুনের লেলিহান শিখা।

হাসনীর বক্তব্যের পর রাজনীতি করেন না এমন মানুষকেও বলতে শোনা গেছে, সব কিছুর সীমা থাকা উচিত, এমন সীমালঙ্ঘন আগে কখনো দেখিনি। কোনো দায়িত্ববানের কারো ব্যক্তিগত দুর্বল জায়গায় এমন নির্মম আঘাত আগে দেখা যায়নি বলেও মন্তব্য করেন অনেকে। আবার কেউ কেউ বলেছেন মহিউদ্দিন চৌধুরীর বক্তব্যের জবাব আ জ ম নাছির দিলেই ভালো হতো। এখানে হাসনীর উপস্থিতি অত্যন্ত বেমানান।

অনেকে এই নিয়ে ফেসবুকে ঝড় তোলেন। হাসনীর সাথে এক যুবতীর যৌথ ছবি ট্যাগ করে আজেবাজে মন্তব্য করতে ছাড়েননি কেউ কেউ। মনজুর হোসাইন নামের একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী হাসনীর বক্তব্য সম্বলিত নিউজ ও ভিডিও শেয়ার দিয়ে বলেন, সিনিয়র নেতাদের বিবাদে কোনো দায়িত্বশীল ব্যাক্তি’র ঘি ঢালা উচিৎ? এতোদিন বিনা প্রকাশে উনি লাভবান ছিলেন? দুদিন বাদে কিন্তু আবার এক মঞ্চে দেখা যাবে। তখন…?

অর্থাৎ দুইদিন পর শীর্ষ দুই নেতাকে আবার একমঞ্চে দেখা যাবে, তখন হাসনীর অবস্থা কী হবে! বাস্তবে তাই হলো। কয়েকদিনের মাথায় এক মঞ্চে এসে মিলে গেলেন মহিউদ্দিন-নাছির। আপাত মিটিয়ে ফেললেন বিবাদ-বিসম্বাদ। কিন্তু দূরে থাকলেন হাসনী। অনেকের মতে, অতি উৎসাহী হাসনীর আ জ ম নাছিরের পক্ষে এমন ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হয়নি। হাসনী যার পক্ষে রাজনীতিতে এই ঝুঁকি নিলেন সেই আ জ ম নাছিরের পক্ষেই বা তিনি কতটা ডেডিগেটেড সেই প্রশ্নও উঠেছে নতুন করে।

২০১৫ সালের এপ্রিলের শুরুর দিকে আ জ ম নাছির উদ্দীনকে মেয়র নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা ইস্যুতে একটি নিউজ চ্যানেলের ‘লাইভ’ প্রোগ্রামে গিয়ে অফ দ্যা রেকর্ডে হাসান মাহমুদ হাসনী বলেছিলেন, “নাছির ভাই মনোনয়ন পেয়েছেন, ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের স্বপ্নগুলোর কী হবে! নাছির ভাই এই যাত্রায় অন্তত দুই টার্ম খাবেন। মানে ১০ বছর। আর ১০ বছর পর আমার বয়স হবে ৬০ প্লাস। তখন কী আর স্বপ্নপূরণের সময় থাকবে?”

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নেতার (নাছির) প্রতি আনুগত্য বিষয়ে প্রশ্ন আর টানাপোড়েনের মাঝেই হাসান মাহমুদ হাসনী সেই নেতার (নাছির) পক্ষে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় ‘উত্তাপ’ ছড়িয়ে তাৎক্ষণিকভাবে আলোচনায় এসেছেন ঠিকই, কিন্তু আগামীর রাজনীতির খেলায় হাসান মাহমুদ হাসনী থাকবেন কিনা, থাকলে কত নাম্বার খেয়োয়াড় হিসেবে থাকবেন তা সময়ই বলে দেবে।

তবে এসব প্রসঙ্গে হাসান মাহমুদ হাসনীর ব্যাখ্যা ভিন্ন। মঙ্গলবার বিকেলে একুশে পত্রিকাকে তিনি বলেন, সোমবার বিকেলে যখন মুজিবনগর দিবসের আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়, ঠিক একই সময়ে মেয়র গোল্ডকাপের সংবাদ সম্মেলন ও র‌্যালি ছিল। মেয়র গোল্ডকাপের কার্যক্রমে অংশ নিতে মেয়র সাহেব আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তাই মুজিবনগর দিবসের সভায় যেতে পারিনি।

তিনি আরও বলেন, আমাকে মেয়র বলেছিলেন, মুজিবনগরের মিটিংয়ের কারণে মেয়র কাপের উদ্বোধনে আমি থাকতে পারছি না। তুমি সেখানে গিয়ে র‌্যালি উদ্বোধন কর। র‌্যালিসহ অন্যান্য কাজ শেষ করতে করতে সন্ধ্যা ৭টা বেজে যায়।

মহিউদ্দিন ও নাছিরের মিলে যাওয়া প্রসঙ্গে হাসনী বলেন, এটাতো রাজনৈতিক বিষয়। ফ্যাসাদ কেউ চায় না। এখানে ব্যক্তিগত কিছু হয়নি। সব রাজনৈতিক। এ বিষয়টা নেগেটিভ দেখারও কিছু নেই।

মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে স্ত্রী হত্যার অভিযোগ তুলে হাসান মাহমুদ হাসনীর বক্তব্যের ভিডিও দেখতে এখানে ক্লিক করুন :