অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান : পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট, ইতিহাস যাকে ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’হিসেবে তৈরি করেছিল এই কলঙ্কিত দিনেই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে কৃতঘ্ন ঘাতকের দল তাকে সপরিবারে হত্যা করেছিল। সেদিন বাংলাদেশের স্থপতি জনককেই তারা হত্যা করেনি কেবল, সেইসঙ্গে হত্যার চেষ্টা করেছিল বাঙালি ও বাংলাদেশকে। মহাকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ, যারা মানবের মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন—যেমন যিশু, সক্রেটিস, জোয়ান অব আর্ক, লিংকন, গান্ধী, মার্টিন লুথার কিং—এদেরই নামের তালিকায় আরেকটি উজ্জ্বল নাম সেদিন যুক্ত হলো—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে যে ঘৃণ্য ইতিহাস বিকৃতি চলেছে, সেটি কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। রাষ্ট্রের প্রকৃত ক্ষমতার মালিক জনগণকে ক্ষমতাহীন করা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করা এবং উগ্র মৌলবাদীদের দ্বারা গণতন্ত্রকে পদদলিত করার যে চক্রান্ত তিন দশক ধরে বাংলাদেশে হচ্ছে, এটি তারই অংশ মাত্র। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে এই চক্রান্তকারী গোষ্ঠী রীতিমতো একটি খোলা বিষয়ে পরিণত করে অপমান করেছে দেশের মুক্তির লক্ষ্যে জীবনদানকারী ত্রিশ লক্ষ বীর শহিদকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দীর্ঘ সময়ের সম্মিলিত সংগ্রামের ফসল। ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, সর্বশেষ ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু ভারতবর্ষের ইতিহাসের একমাত্র সফল আন্দোলনের নির্মাতাই ছিলেন না, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে তিনি উপমহাদেশের সর্বকালে সকল শহিদদের ঋণ শোধ করেছেন। বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন সেই মানুষ, যার জীবন ও কর্ম সফল করেছে ক্ষুদিরাম-প্রীতিলতা-সূর্যসেন থেকে সালাম-বরকত-রফিক কিংবা ঊনসত্তরের শহিদ আসাদের আত্মদানকে। তিনিই তো একমাত্র নেতা যিনি একইসঙ্গে বাঙালির অতীত ও ভবিষ্যতকে তাৎপর্যপূর্ণ করেছেন। তাই হীন-অসত্য-ইতিহাস বিকৃতকারীদের মূর্খতা ও স্থূলতার জবাব দেওয়াটাও অবান্তর হবে। পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টের মধ্য দিয়ে যে ইতিহাস বিকৃতির যুগ অতিবাহিত হয়ে আসছে, প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিককেই এই বিকৃতির চক্রব্যূহ ভেদ করতে হবে। বাঙালির ইতিহাসের ভেতর দিয়ে বাঙালি আপন কথা বলে। বাঙালির ইতিহাস বাঙালির অস্তিত্বের উচ্চারণ। আর বঙ্গবন্ধু সর্বকালের বাঙালির আপনতম কণ্ঠ। তাই পনেরই আগস্টের বঙ্গবন্ধু নৃশংস হত্যাকাণ্ড বাঙালির কণ্ঠরোধ করারই শামিল। আর বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম রূপকার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে ভ্রান্ত-কপট এক বিষাক্ত জাতীয়তাবাদের দিকে বাঙালিকে চালিত করার পথ প্রশস্ত হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদও বস্তুত কোনো আকস্মিক বিষয় নয়। কোনো সেনাছাউনিতে এর কলঙ্কিত জন্ম হয়নি। এর রয়েছে হাজার বছরের এক সেক্যুলার ইতিহাস। আমাদের মনে পড়বে বঙ্গবন্ধুকে যেদিন হত্যা করা হয় তার পরের দিন সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, ধর্ম নিরপেক্ষতা যে জাতীয়তার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল বিশ্বের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহ কোনো দিন তা সমর্থন করতে পারেনি।
উল্লেখ্য, একাত্তরের ঘাতক গোলাম আযম ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা তখন পাকিস্তান ও সৌদি আরবে অবস্থান করছিল। আর তাদের দোসররা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শ্লোগান দিচ্ছিল “তোয়াব ভাই, তোয়াব ভাই, চাঁদ-তারা পতাকা চাই।” এরা বাঙালির পতাকা ও জাতীয় সংগীতকে পরিবর্তনেরও দাবি তুলে। কিন্তু বাঙালি স্বভাবগত সেক্যুলার। হিন্দু মুসলমানদের মিলনের ভিতর দিয়েই এর পূর্ণতা। বহু ধর্ম-দর্শনকে এটি নিজের উদারতা দিয়ে আপন করে নিয়েছে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ হচ্ছে সেই সত্তা যাকে রামমোহন-বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সোহরাওয়ার্দীর মতো মহান ব্যক্তিবর্গ নিজের মতো করে আকার দিয়েছেন, আর সেই মৃত্তিকামূর্তির আকারে এক কঠিন সন্ধিক্ষণে তাকে এই দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাংলার ইতিহাস হয়তো দীর্ঘকালের জন্য অশুভ অন্ধকারে থমকে থাকত। আওয়ামী লীগের সত্তরের নির্বাচনী ইশতেহারের কিছু অংশ এখানে প্রাসঙ্গিক হবে-
“শেরে বাংলা আজ পরলোকে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আমাদের মাঝে নাই। যারা প্রবীণতার দাবি করেছেন তাদের অধিকাংশই হয় ইতিমধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানের এক শ্রেণির বাঙালি-বিদ্বেষীর কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিয়ে তল্পিবাহকের ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, নয়তো নিষ্কর্মা, নির্জীব হয়ে পড়েছেন এবং অন্যের সলা-পরামর্শে বশীভূত হয়ে কথা ও কাজে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। আমি নিশ্চিত বুঝতে পারছি, ভাগ্য-বিপর্যস্ত মানুষের হয়ে আমাদেরকেই কথা বলতে হবে।” [বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্বাচনী আবেদন]
বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল একটি স্বচ্ছ-জবাবদিহিতামূলক গণতান্ত্রিক কল্যাণ-রাষ্ট্র হিসেবে। পাকিস্তান আমলে এদেশের মানুষকে ভোগ করতে হয়েছে কুৎসিত সামরিক একনায়কত্ব। আমরা দেখেছি দক্ষিণ আমেরিকার অনেক রাষ্ট্র, কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাকিস্তান বা মিয়ানমার, তখনো যেমন, এখনো তেমনই সামরিক অপশাসনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। আমরা বলব এ সকল হতভাগ্য দেশ আর বাংলাদেশের মধ্যে একটাই পার্থক্য- তা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ইতিহাসে সহজেই এর যুক্তি মিলবে। পনের আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়েই সূচিত হয়েছিল বাংলাদেশের দীর্ঘ সামরিক দুঃশাসনের। এরপর গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে চলেছে সামরিক মনোভাবের অপশাসন। নিরীহ জনগণের উপর বারবার হয়েছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বাহিনীর জুলুম-নির্যাতন। বাংলাদেশের ভিত্তি যে শাসনতন্ত্র তা ভূলুণ্ঠিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয় তখনই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়। আরও পাঁচ মাস আগেই ১৯৭২ সালের ৭ই জুন ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু যে বক্তৃতা করেন, তাতে বাংলাদেশের সংবিধান বা শাসনতন্ত্র সম্পর্কে তার নিজস্ব ভাবনা সুস্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত হয়েছিল। তিনি ওই বক্তৃতায় বাংলাদেশের সংবিধানের চার স্তম্ভ সম্পর্কে বিশদ বলেন-
“আমার বাংলার সভ্যতা, আমার বাঙালি জাতি, এ নিয়ে হল বাঙালি জাতীয়তাবাদ।
বাংলার বুকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ থাকবে। এ হলো আমার এক নম্বর স্তম্ভ।
দ্বিতীয় স্তম্ভ, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। এ সমাজতন্ত্র আমি দুনিয়া থেকে ভাড়া করে আনতে চাই না, এ সমাজতন্ত্র হবে বাংলার মাটির সমাজতন্ত্র। এ সমাজতন্ত্র বাংলার মানুষের সমাজতন্ত্র।, তার অর্থ হলো শোষণহীন সমাজ, সম্পদের সুষম বণ্টন। … কিন্তু সমাজতন্ত্র সেখানে আছে যেখানে গণতন্ত্র নাই। দুনিয়ায় আমি বাংলার মাটি থেকে দেখাতে চাই যে, গণতন্ত্রের মাধ্যমে আমি সমাজতন্ত্র কায়েম করব। আমি ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি।
চতুর্থ: বাংলাদেশ হবে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্ম নিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানদের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিষ্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্ম নিরপেক্ষতা আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে যাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আলবদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেয়া হবে না। এই হলো চার দফা, চার স্তম্ভ।”
তার এই বক্তব্য প্রমাণ করে যে, সংবিধান প্রণীত হওয়ার অনেক আগ থেকেই তার চিন্তা চেতনায় রাষ্ট্র-বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ। এটি তার কাছে আকস্মিক ঘটনা ছিল না। পাকিস্তান আমলের দ্বিতীয় গণপরিষদ ও জাতীয় সংসদে ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত দেওয়া বিভিন্ন ভাষণে তার রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তিনি সাধারণ পেশাজীবী রাজনীতিক ছিলেন না, ছিলেন প্রকৃত অর্থে একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জাতীয় নেতা। বঙ্গবন্ধু চিরকাল সংবিধানের চার স্তম্ভের উপর জোর দিতেন। তাই তাকে হত্যা করে ওই চার স্তম্ভকে বিকৃত করা হবে তা স্বাভাবিক। আর এভাবেই পনেরই আগস্ট একজন মহান স্থপতিকে হত্যার মাধ্যমেই শুরু হয় তার সৃষ্ট স্থাপনার ধ্বংসযজ্ঞ। আজকের বাংলাদেশের নিগৃহীত জনগণের দিকে ভালো করে তাকালে বোঝা যাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সংবিধানের পবিত্রতা নষ্ট করার কী ফলাফল। ১৯৭৮ সালে সংবিধানের মূলনীতি সংক্রান্ত ৮(১) দফা পরিবর্তন করা হয় এবং ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা’ শীর্ষক ১২ নং অনুচ্ছেদটি বিলুপ্ত করা হয়। যদিও তখন দেশে সাংগঠনিক গণতন্ত্র একেবারেই অনুপস্থিত ছিল। সেদিন জাতীয়তা পরিবর্তনের সময় ১ শতাংশ আদিবাসী সম্প্রদায়ের দোহাই দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সংবিধানকে ইসলামীকরণের সময় তারা বেমালুম অস্বীকার করেছিল ১২ শতাংশ ভিন্নধর্মী মানুষকে। বঙ্গবন্ধুর উল্লিখিত ভাষণটি পড়ে অবাকই হতে হয় যে, তিনি কতটা সুদূরপ্রসারী চিন্তক ছিলেন। বস্তুত বাংলাদেশকে ও এদেশের মানুষকে তার চেয়ে ভালো কেউ চিনত না। ধর্মের নামে যে রাজাকার তৈরির প্রচেষ্টা আবারও হবে তা বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালেই বলেছিলেন। আর সেই বাস্তবতাই আজ প্রতিফলিত হয়েছে সদ্য প্রয়াত অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ভাষায়-
“১৯৭১-এ যারা পাকিস্তানীদের সাথে যোগ দিয়েছিল, তারাই শুধু রাজাকার, এ ধারণা বাদ দিতে হবে; স্বাধীনতার পর রাজাকারের সংখ্যা বেড়েছে। যারা প্রতিক্রিয়াশীল, ধর্মান্ধ, বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃত করে, এখন তারাই রাজাকার। … রাজাকার শুধু ব্যক্তি নয়, ধারনাও; আমি তো এখন দিকে দিকে রাজাকার দেখি, ১৯৭১-এ এত দেখতাম না।”
পঁচাত্তরের ঘাতকদের প্রকৃত লক্ষ্য ছিল বাঙালি ও বাংলাদেশকে অভিভাবকহীন করা। যেসব পাপিষ্ঠ দুর্মুখেরা একথা উচ্চারণ করে যে বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র কায়েম হয়েছে তাদের ইতিহাস ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবে। তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারক বাহকেরা আমাদের উপহার দিয়েছে ঢাকা-১০ আসনের প্রহসনের উপনির্বাচন অথবা ছিয়ানব্বইয়ের ১৫ ফেব্রুয়ারির প্রহসনের নির্বাচন। গণতন্ত্রের নানা প্রকারভেদ আছে। যে গ্রিকদের গণতন্ত্রের প্রথম চর্চাকারী বলা হয়ে থাকে, সেখানেও কিন্তু সকল নাগরিকের ভোটাধিকার ছিল না। এথেনীয় গণতন্ত্র আর আধুনিক মার্কিনি গণতন্ত্রে আকাশ-পাতাল তফাৎ। মানুষের অধিকার মানুষকে ফিরিয়ে দেওয়ার নানা পথ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে দলীয় চেয়ারম্যান এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের কিছু অংশ প্রণিধানযোগ্য-
“বাংলাদেশ নির্বাচন দিয়েই ৯৭ পারসেন্ট ভোট, আউট অব হানড্রেড ফিফটিন, থ্রি হানড্রেড সেভেন সিটস আমাদের পাটি আওয়ামী লীগের ছিল। যদি তারপরেও ইলেকশন দিতাম এখনো বিশ্বাস করি, দুই এক পারসেন্ট বাদও যেতে পারে। কিন্তু নব্বই পারসেন্টের কম পাবে না আমাদের পার্টি। সেজন্য এই সিস্টেম ক্ষমতাচ্যুত হবার সম্ভাবনা আমাদের অনেকদিন ছিলনা, যদি ক্ষমতায় থাকতে চাইতাম। তাহলে আমরা অনেকবারই ক্ষমতায় আসতে পারতাম।”
পনেরই আগস্টের ঘাতকেরা একথা জানত, পেশীশক্তি প্রয়োগ না করলে বাংলাদেশ ও বাংলার জনগণের বুক থেকে আওয়ামী লীগকে উপড়ে ফেলা যাবে না। তাই একুশ বছর হীনচক্রান্ত করে ঠেকিয়ে রাখা হয় আওয়ামী লীগকে। আবার কারচুপির নির্লজ্জ নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০১ সালে অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতায় বসে পঁচাত্তরের ঘাতকদের পৃষ্ঠপোষকরা। বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়াকেও তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিলম্বিত করেছে। একাত্তরের ঘাতকদেরকে বসানো হয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতায়। তাই পনেরই আগস্টের হত্যাকাণ্ডকে বাংলাদেশের হত্যাকাণ্ডই বলা চলে। এটি বাংলাদেশের মূলনীতিগুলোকে হত্যা করার অপচেষ্টা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ইতিহাসের মহত্তম ঘটনাসমূহের একটি। মানব ইতিহাসে এটি হয়ে থাকবে সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী দৃষ্টান্ত, যাতে একজন মানুষকে আমরা দেখি একটি জাতিগত স্বপ্নের অবয়ব নিতে এবং সেই মানুষের ব্যক্তিত্বের প্রভাব এতটাই গভীরে ছিল যে, তার উদ্দীপক উপস্থিতি রোধ করা যায়নি। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের জাতীয় আন্দোলন অনেক হয়েছে, কিন্তু এরকম বাঁধনছাড়া ভালোবাসা আর কোনো নেতা পাননি। জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ হেগেলর (১৮৭০-১৮৩১) ভাষায় “মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হচ্ছে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা”। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বাঙালির কোনোদিন কোনো রাষ্ট্র ছিল না। বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দেওয়ার কৃতিত্ব সাধারণ বাঙালি কৃষক সন্তান মুজিবের।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে বাংলাদেশে যে দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল, বাস্তব পৃথিবীতে এরকম নজির মিলবে না। একে কেবল তুলনা করা চলে বনবাস শেষে রামচন্দ্রের অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে। একযুগ বনবাসে থেকে তিনি যখন ফিরে আসেন তখনও অযোধ্যাবাসী তার উচ্চতা আর গুণে মোহাচ্ছন্ন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হিসেবে তারই সিংহাসন পাবার কথা; সৈয়দ নজরুল ইসলাম যেন সেদিন ঠিক ভরতের মতোই উচ্ছ্বাসে উদ্বেল হয়ে বাংলার সিংহাসনের প্রকৃত মালিক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দেন। রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবন্ধুর যে শক্তিমত্তা ছিল, তার সঙ্গে কারোরই তুলনা হতে পারে না। ভারতীয় সৈন্য ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে তিনি যে সুচারু দক্ষতা প্রদর্শন করেন, তা পৃথিবীর যে কোনো রাষ্ট্র নায়কের পাঠ্য হতে পারে। গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর মতো দক্ষ নেতাও পৃথিবীতে নেই।
বঙ্গবন্ধু বরাবরই সকল মানুষের কথা ভাবতেন। তিনি ব্যক্তি হিসেবে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে খাওয়া মানুষের প্রতিনিধি ছিলেন। উপমহাদেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণে সুদীর্ঘকাল যে নবাব বংশের সন্তান, বিলাতফেরত ব্যারিস্টার ও গজদন্তমিনারবাসী উচ্চবিত্তের আধিপত্য ছিল, বঙ্গবন্ধু তার উজ্জ্বলতম ব্যতিক্রম। সপ্তদশ শতকের ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্রের উৎখাতে যে বিপ্লব সাধিত হয় তাকে পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু অন্য অনেক বিপ্লবের মতোই এটিও ছিল একটি অসম্পূর্ণ খণ্ডিত ঘটনা। ক্রমওয়েল রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিতে চেয়েছিলেন বহুবিত্তশালী বণিক শ্রেণিকে, লিলবার্ন শহরবাসী স্বল্পবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে, উইনস্ট্যানলি ভূমিহীন জনতাকে। তাই গণতন্ত্রের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো এরকম সকল সম্প্রদায়ের মানুষের একযোগে অংশগ্রহণ কোনো বিপ্লবের তুলনা পাওয়া যাবে না। গান্ধীজী যখন অহিংস অসহযোগের ডাক দিয়েছিলেন তখন এইচ. আর. এ.-এর মতো র্যাডিক্যাল গ্রুপের সদস্যরা জঙ্গি আন্দোলন চালিয়েছিলেন, শহিদ হয়েছিলেন ভগত সিংহের মতো নেতারা। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু হংকংয়ে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু একাত্তরে বাঙালি জাতির মধ্যে নীতি বা নেতৃত্বের কোনো সংকটই উপস্থিত হয়নি কেবল শেখ মুজিবের মতো ক্যারিশমাটিক নেতার উপস্থিতির কারণে।
বাঙালি, বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধুকে আলাদা করে দেখা যাবে না। বাংলাদেশ নামক যে রাষ্ট্র তার ভৌগলিক উপস্থিতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবনব্যাপী সাধনারই ফল। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব একাত্তরের পূর্বে কখনো প্রতিষ্ঠা পায়নি। সিরাজউদ্দৌলাকে বলা হয় বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। কিন্তু তিনি জনগণকে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি। বলা হয়ে থাকে পলাশীর প্রান্তরের চারপাশের প্রত্যেকটি লোক যদি একটি করে ইটও ছুড়ত তাহলে লর্ড ক্লাইভের দখলদার বাহিনীর পক্ষে জয়লাভ করা সম্ভব হতো না। তাই, যে বাংলাদেশ জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতার উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তার রূপকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বাংলাদেশ আর মুজিবকে আলাদা করা যাবে না। মুজিব হচ্ছে সেই সোনার কাঠি যা বাঙালি নামক ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়েছিল। তাই বঙ্গবন্ধু হত্যা সেই জাতিকে ঘুম পাড়ানোর ঘৃণ্য অপচেষ্টা। কোনো জাতিকে যদি শৈশবেই দাবিয়ে রাখা হয় তাহলে পরিণত অবস্থায় সে জাতি ক্ষতধারা হবে এটাই স্বাভাবিক।
পনেরই আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার মাধ্যমেই মৃত্যু ঘটে বাঙালি জাতির উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের। একই সময়ে যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনিকে হত্যা এবং তার কিছুদিন পর ৩রা নভেম্বর জাতীয় তিন নেতাকে হত্যার মধ্য দিয়েও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও চিন্তার ধারাবাহিকতাকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করা হয়। বাংলাদেশকে এখন পুনঃপাস্তিকানীকরণ করে একটি উগ্র মৌলবাদী পশ্চাদপদ মধ্যযুগীয় অকল্যাণকর রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, অসুস্থ দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানকে ব্যর্থ করেই বাংলাদেশের অভ্যুদয়। রবীন্দ্রনাথ তার সভ্যতার সংকট প্রবন্ধে বলেছিলেন যে, ‘মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ’। তাই বাংলার আপামর জনতার উপর আস্থা রেখে বলা যায় এই ষড়যন্ত্র সফল হবে না।
কবির ভাষায়- ‘শোনো একটি মুজিবের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি’। হ্যাঁ, আমরা সেই ধ্বনি শুনতে পাই। পিতার অপূর্ণ কাজ সম্পাদন করবে সন্তান। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা আর লক্ষ মুজিবসেনা ধরে রাখবে বঙ্গবন্ধুর চেতনা। ব্যক্তির মৃত্যু হয় কিন্তু চেতনার মৃত্যু হয় না। তাই বঙ্গবন্ধুর দৈহিক তিরোধানই তার মৃত্যু নয় বরং তাকে হত্যা করার এক অক্ষম প্রচেষ্টা মাত্র। আসুন সকলে মিলে ঐসব খুনিদের স্মরণ করিয়ে দেই বঙ্গবন্ধু হচ্ছে গ্রিক পুরানের ফিনিক্স পাখি, যে বারবার আগুনের ভেতর থেকে জন্ম নেয়। ভস্ম হয়ে গেলেও মরে না।
লেখক : অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।