মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সিআরবির পরিবেশ-প্রকৃতিকে বাঁচান!


হাসিনা আকতার নিগার : গল্প-কবিতার সবুজ শ্যামল বাংলাদেশ এখন আর বাস্তবে নেই। চারদিকে ইট-পাথরের দালান গড়ে উন্নয়নের নামে প্রকৃতিকে ধ্বংস করা হচ্ছে দিনের পর দিন। সবুজ গাছ-গাছালির মুক্ত বাতাসে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেবার মত জায়গার বড় অভাব এখন। গ্রাম থেকে শহর- সব জায়গা থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে নানা ধরনের গাছ-গাছালি আর অরণ্য। যান্ত্রিক জীবনে প্রকৃতির ছোঁয়া পেতে মানুষ ভুলে যাচ্ছে। পর্যটন শিল্পের নামে প্রকৃতি ধ্বংস করে তৈরি হচ্ছে বিলাসবহুল হোটেল-মোটেল। পাশাপাশি শতবর্ষের ঐতিহ্যের স্বাক্ষরকে বিনাশ করা হচ্ছে নানা ধরনের কার্যক্রমের মাধ্যমে।

সে ধারাবাহিকতায় এবার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের সুযোগ তৈরির নামে স্বার্থন্বেষী মহলের নজর পড়েছে চট্টগ্রামের সিআরবিতে। সবুজ, পাহাড় ঘেরা, সমুদ্রের পাশের এ শহর এক সময় প্রকৃতির মায়াজালে আবিষ্ট করত মানুষকে। কিন্তু পাহাড়, সমুদ্র আর গাছ-গাছালির চট্টগ্রাম তার সে রূপ হারিয়ে ফেলছে উন্নয়নের স্রোতে। সমগ্র দেশের উন্নয়নের প্রভাব এ শহরেও আসবে তা অস্বীকার করার জো নেই। কিন্তু তার জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশকে নষ্ট করে গাছ কেটে মানুষকে মুক্ত বাতাসের অক্সিজেন নেয়া থেকে বঞ্চিত করা অন্যায়।

সিআরবি- এ নামটা মনে পড়লেই চোখের সামনে ভেসে উঠে পাহাড়ি পরিবেশ, সবুজে ঘেরা এক স্থান। যেখানে এ শহরের মানুষ একটু শান্তি খুঁজতে, দম নিতে যায়। পাহাড়ের উপরে রেলওয়ের কর্মকর্তাদের বাংলো আর কর্মচারীদের কলোনি তার মাঝে দিয়ে টাইগার পাস পর্যন্ত নিরিবিলি রাস্তা সত্যি বিমোহিত করে মনকে। শুধু তাই নয় সিআরবির লাল দালানগুলো দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষী। এখানকার শিরীষতলা চট্টগ্রামে শহরের মানুষের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহার হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। ঢাকা শহরের মত চট্টগ্রামে তেমন কোন উন্মুক্ত স্থান নেই। এখন একমাত্র ভরসা এ সিআরবি।

অথচ চট্টগ্রামবাসীর আবেগ আর ভালোবাসার সে স্থানটিকে হাসপাতাল তৈরির নামে নষ্ট করার উদ্যোগ নিয়েছে কিছু মানুষ। যা সত্যি দুঃখজনক। সিআরবি রেলওয়ের সম্পত্তি হলেও এটা শহরবাসীর হৃদয়স্থল। বর্তমানে এ শহরে সিআরবি ছাড়া তেমন কোন জায়গা নেই, যেখান গিয়ে মানুষ সবুজের ছোঁয়া পাবে। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারিয়েছে নতুন আঙ্গিকে সাজানোর পর। ঝাউগাছ কেটে উজাড় করা হয়েছে ঝাউবন। সেখানে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ আর সবুজ বনের মোহময়তা নেই। বরং নিয়ন বাতি আর রং বেরংয়ের ইটের আসনগুলো অদ্ভুত এক কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করেছে।

সিআরবিতে অবস্থিত রেলওয়ে হাসপাতাল এক সময় বেশ নামকরা হাসপাতাল ছিল। অথচ দুর্নীতি আর অনিয়মের কারণে সে হাসপাতাল এখন অনেকটাই পরিত্যক্ত। সরকার যদি সাধারণ জনগণের সেবার মান বৃদ্ধি করতে চায় তাহলে রেলওয়ে হাসপাতালের সামগ্রিক উন্নয়ন করে সিআরবির পরিবেশ অক্ষুন্ন রাখতে পারে। অথচ তা না করে সে হাসপাতালের পাশে ইউনাইটেড গ্রুপের বিলাসবহুল হাসপাতাল নির্মাণ করে তাকে সেবা দিতে চাইছে তা বুঝার ক্ষমতা মানুষের আছে। ইউনাইটেড গ্রুপের পরিকল্পনা অনুযায়ী বিশাল এ হাসপাতাল নির্মাণের জন্য সিআরবির ৬ একর জায়গা বরাদ্দ দিয়ে শহরকে বিনষ্ট করা কতটা যুক্তিযুক্ত তা একবার ভেবে দেখুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

চট্টগ্রামে ঢাকার মত বিলাসবহুল হাসপাতালের অপ্রতুলতা রয়েছে মনে করে এভারকেয়ার, ইমপেরিয়াল হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে মূল শহর থেকে একটু দূরে। একইভাবে শহরের বাইরে কোন স্থানকে নির্ধারণ করা যেতে পারে ইউনাইটেড ও রেলওয়ে তাদের যৌথ উদ্যোগের হাসপাতাল নির্মাণ করতে। চট্টগ্রামে রেলওয়ের প্রচুর জমি রয়েছে, সেখান থেকে জমি দিয়ে তাদের নিজেদের বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা করতে পারে। আর উন্নত সেবা পেতে ইচ্ছুক মানুষ সে হাসপাতালে যাবে নিজের প্রয়োজন মত।

একটি হাসপাতাল গড়ে উঠলে সে হাসপাতালকে কেন্দ্র করে প্রসার হতে থাকে নানা ধরনের ব্যবসায়িক কার্যক্রম, যা সহজেই অনুমেয়। তাই কেবলমাত্র রেলওয়ের ৬ একর জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকবে না ইউনাইটেড হাসপাতালের পরিসীমা। রেল কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, শতবর্ষের গাছ না কেটে এ হাসপাতাল করার পরিকল্পনা প্রনয়ণ করা হয়েছে। আসলে পরিকল্পনা মতে এ দেশে কিছু হয় না। তা না হলে গাছ রক্ষার কথা বলে এভাবে সবুজ বন উজাড় করার চিন্তা করাটাই অকল্পনীয় হতো।

চট্টগ্রামের লালদিঘির ময়দান, আসকার দিঘির পাড়, জাম্বুরী মাঠ, ফয়েস লেক, সার্কিট হাউস সংলগ্ন এলাকা, আউটডোর স্টেডিয়াম- সব আজ হারিয়ে গেছে কৃত্রিম নান্দনিকতার কাছে। আছে কেবল সিআরবি। সেখানেও হাত পড়ছে স্বার্থান্বেষী মানুষের। এরা পরিবেশের আর্তচিৎকার শুনতে পায় না। তা যদি হতো তাহলে করোনাভাইরাসের লকডাউনকালীন সময়ে গাছের সজীবতা দেখে অনুধাবন করতে পারত, প্রকৃতি তার আপন মহিমায় যান্ত্রিক জীবনের কতটা শান্তির পরশ দেয়।গাড়ি, ধোঁয়া আর মানুষের কোলাহলে অত্যাচারের শিকার প্রকৃতি আপন রূপে যেন সাজতে পারে সে পথ খুলে দেয়ার বদলে বিলাসী হাসপাতাল সিআরবিতে নির্মাণ করা অযৌক্তিক। তাই চট্টগ্রামবাসী সোচ্চার হয়েছে তাদের প্রিয় সিআরবিকে বাঁচাতে, যা খুবই স্বাভাবিক।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দেশের যে কোন পরিস্থিতিতে আপনিই পথ দেখান জনগণকে। জনগণকে স্বস্তিতে দিতে বিবেচনা করেন তাদের চাওয়া-পাওয়াকে। যখন আপনার সরকার পরিবেশ সংরক্ষণ করতে সবুজ বনায়নে উৎসাহিত করছে, তখনই চট্টগ্রামের সিআরবি তার সবুজ হারাতে যাচ্ছে। তাই আপনার কাছে সবিনয় অনুরোধ, সিআরবিকে বাঁচান। আর এ শহরের মানুষকে মুক্ত বাতাস থেকে অক্সিজেন নিতে দিন।

লেখক: কলামিস্ট