শান্তনু চৌধুরী : করোনার কারণে দেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকমের লকডাউন আমরা দেখেছি। কখনো সীমিত, কখনো কড়া, কখনো সবকিছু খোলা রেখে শুধুই বিধিনিষেধ মানতে বাধ্য করা। আর লকডাউনের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি সম্ভবত এই দেশেই হয়েছে। কবে এখন করোনার সংক্রমণ উর্ধ্বগতি। মাঠে নামানো হয়েছে বিজিবি-সেনাবাহিনীও। কিন্তু রাস্তাঘাটের যানজট আর মানুষের কোনো কিছুই তোয়াক্কা না করার প্রবণতা মনেই হয় না করোনায় মৃত্যু একদিনে দু’শ’ ছাড়িয়েছে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনো একদিনের জন্যও খুলেনি।
জীবন ও জীবিকার যুদ্ধে মহামারির ভয়কে তুচ্ছ করেই মানুষ আজ ‘নতুন স্বাভাবিক’ জীবনে অভ্যস্ত। গত বছর ১৭ মার্চ থেকে স্কুলগুলো ছুটি হলেও এই ছুটিকে ঠিক ‘আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি’ বলা যাচ্ছে না। এ যেন ঘরে বদ্ধ থেকে জগৎটাকে অনলাইনে দেখার প্রয়াস। তাই বলা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, কিন্তু শিক্ষা আদান-প্রদান নয়। এখন অনলাইনে ক্লাস হয়। আর এতে ঘটে চলছে নানা মজার ঘটনা। যান্ত্রিক শিক্ষার মধ্যেও যন্ত্রের মধ্যেই মাঝেমধ্যে ধরা পড়ে শিক্ষার্থীদের অযান্ত্রিক মজার কর্মকা-। পড়া না শিখলে নেট চলে যাওয়া, মাইক্রোফোনে সমস্যা হওয়া, চ্যাটবক্সে গল্পের আসর বসানো, ক্লাসে সাইন-ইন করে ঘুমানো বা গেম খেলা…এসব তো রোজকার ঘটনা।
আবার বাড়ি থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ে ক্লাস করার কারণে দুজনের বাড়ির নিত্যদিনের অবস্থা আর ক্লাস চলাকালে ঘটে যাওয়া মজার ঘটনাগুলোও নতুন নতুন আলোচনার জন্ম দেয়। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ক্লাস করেন তাদের ভাইবোন, কখনো মায়েরা, বাবারা। বাসাটাই যখন স্কুল, সবাইকে তো শিক্ষার্থী হতেই হয়!
তবে ভিয়েতনামের ঘটনাটি নিঃসন্দেহে আলোচনার খোরাক জোগায়। অনলাইন ক্লাস চলাকালীনই প্রেমিকার সঙ্গে উদ্দাম যৌনতায় মাতলেন ভিয়েতনামের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র। দু’জনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়তেই তীব্র চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনাটি ঘটে হো চি মিন শহরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইনে একটি ক্লাসে যোগ দিয়েছিলেন ওই ছাত্র। ক্লাসের মাঝে বিরতি নিয়েছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন কম্পিউটারের ক্যামেরা অফ করা রয়েছে। আর তার জেরেই প্রেমিকার সঙ্গে যৌনতায় মেতে উঠেছিলেন। দু’জনের গায়ে পোশাক পর্যন্ত ছিল না। গ্রুপ চ্যাটে এই দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে যান অন্যান্য পড়–য়ারা। কয়েক মিনিট পরে বিষয়টি অধ্যাপকের নজরে পড়ে। তিনি তখনই চিৎকার করে ওঠেন।
এভাবে অনলাইন ক্লাস চলাকালীন প্রেমিকার সঙ্গে যৌনক্রিয়ার জন্য তাকে তীব্র ভর্ৎসনা করেন। তখনই যুবক বুঝতে পারেন কম্পিউটারের ক্যামেরা অন রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরার সামনে থেকে সরে যান তিনি ও তার প্রেমিকা। কিছুক্ষণ পর ছাত্র পোশাক পরে ক্যামেরার সামনে আসেন। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। নেটদুনিয়ায় বেশ কিছুক্ষণ ভাইরাল ছিল ভিডিওটি। পরে তা ডিলিট করে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তপক্ষের পক্ষ থেকেও অনুরোধ করা হয় কোনও সংবাদমাধ্যম যেন ভিডিওটি না দেখান এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় যেন শেয়ার না করা হয়।
তবে এই প্রথম নয় এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। জুম কল বন্ধ হয়ে গিয়েছে ভেবে সেক্রেটারির সঙ্গে যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হয়েছিলেন ফিলিপিন্সের সরকারি অফিসার ক্যাপ্টেন জেসাস এস্টিল। ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরোর সিটি কাউন্সিলের বৈঠকেও জুম কলের সময় এভাবেই ল্যাপটপের ক্যামেরা অফ আছে ভেবে যৌনক্রিয়ায় মেতেছিলেন এক দম্পতি। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে জুম কলে বৈঠক চলাকালীনই স্ক্রিনের সামনে নগ্ন অবস্থায় চলে আসেন দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় আইনসভার সদস্য ইনকোসি জোলাইল এনদেভুর স্ত্রী। সেই ঘটনাতেও প্রবল চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল।
করোনা শুরুর আগে আমরা বলতাম শিশু কিশোরদের মোবাইল থেকে দূরে রাখতে এবং তারা কী ব্রাউজ করছে তার দিকে যেন অভিভাবকরা নজর রাখেন। এখন সেই সময় অনেকটা বদলেছে। করোনার কারণে বাধ্য হয়েই শিশু-কিশোরদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দিতে হচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্লাস চলছে। কতোক্ষণ আর সামনে বসে থাকা যায়। খেয়ালে বা বেখেয়ালে অনেকেই এ সময় ঢুকে পড়ছে পর্ণ সাইটে বা এমন সব কিছু তারা দেখছে যেটা দেখার মতো উপযুক্ত সময় তাদের হয়নি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অনেকের মধ্যে এমন সব ধারণার জন্ম হচ্ছে যা তাদেরকে বিকৃত মানসিকতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
যেমনটি ঘটেছে ভারতের রাজস্থানের আলওয়ার জেলায়। ছোট ভাইয়ের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের জেরে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছে ১৫ বছরের দিদি। নাবালকের বয়স ১৩ বছর। সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সে। বেশ কিছুদিন ধরেই বিষয়টি চলছিল। স্মার্টফোনে প্রথমবার পর্ন ভিডিও দেখে ওই কিশোর। তারপর খেলা ছলেই দু’জনে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়। বহুদিন ধরেই এই কাজ চলতে থাকে। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে যখন গর্ভবতী হওয়ার ফলে নবম শ্রেণির ওই ছাত্রীর শরীরে পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। প্রথমে বিষয়টি লক্ষ করেন কিশোরীর ঠাকুরমা। তারপরই কিশোরীর ডাক্তারি পরীক্ষা করানো হয়। তখনই তার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবর জানা যায়। কিন্তু তখনও কেউ ভাবতে পারেননি এই ঘটনার জন্য কিশোরীর ভাই-ই দায়ী।
শেষ করবো ভিন্ন একটি প্রসঙ্গ দিয়ে। ৯৮ বছর বয়সে জীবনের ইতি টানলেন মুগল-ই-আজম খ্যাত অভিনেতা দীলিপ কুমার। মৃত্যুর পরও তিনিও রেহাই পেলেন না নোংরা নেটিজনদের কাছ থেকে। তাঁর মৃত্যু পর ভারতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা গেল ঘৃণার প্রচার। বারবার বলা হয়েছে, তিনি ‘শত্রুদেশ পাকিস্তানের এজেন্ট (চর)’। দিলীপ কুমারের জন্ম পাকিস্তানের পেশোয়ারে, জন্মের সময়ে তাঁর নাম ছিল মোহাম্মদ ইউসুফ খান আর সেই কারণেই মৃত্যুর পরে এই ধারাবাহিক আক্রমণ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অবশ্য তাঁকে একজন ‘কিংবদন্তি’ বলে বর্ণনা করে দিলীপ কুমারের কাজের প্রশংসা করেছেন। তাতে অভিনেতার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আক্রমণ থামছে না। টুইটারে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছেন, ‘দিলীপ কুমারকে কবর দেওয়ার কারণ কী? উনি তো হিন্দু বলেই পরিচিত।’
সর্বাধিক প্রচারিত টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকার ইন্টারনেট সংস্করণে মন্তব্যের অংশে এক পাঠক বলেছেন, দিলীপ কুমার ‘মুসলিম নামের একজন পাকিস্তানি অভিনেতা। তিনি বলিউডে জায়গা পেতে নাম পরিবর্তন করেছিলেন। কিন্তু ইসলাম ত্যাগ করেননি। এইভাবে ধর্মনিরপেক্ষ জেহাদিরা হিন্দুদের বোকা বানায়।’ সিধুসাহেব বলে একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে লেখা হয়েছে, ‘দিলীপ কুমার, অজিত, মধুবালা, মীনা কুমারী, বর্তমানের খানেরাসহ অন্যান্য যেসব মুসলিম অভিনেতা আছেন, তাঁদের পাকিস্তান বা বাংলাদেশে চলে যাওয়া উচিত ছিল। অনেক প্রতিভাশালী সংগীত পরিচালককেও এই তালিকায় রাখা যেতে পারে।’
অবশ্য ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি আইন নিয়ে কাজ করেন এমন আইনজীবীরা বলছেন, এই ধরনের ব্যক্তিগত আক্রমণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে পোস্ট করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। এই হচ্ছে বানরের হাতে ধারালো তলোয়ার তুলে দেওয়ার প্রতিদান!
শান্তনু চৌধুরী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক