চট্টগ্রাম: হোল্ডিং ট্যাক্স ও মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র স্থানান্তর নিয়ে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের দুই শীর্ষ নেতার বিরোধ চরমে উঠেছে।
ফেব্রুয়ারিতে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রটি পাথরঘাটা থেকে রাজাখালে সরিয়ে নেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন; গত মাসে সেটি আগের স্থানে নিয়ে আসেন সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। এর আগে গত ২১ মার্চ সিটি করপোরেশনের ‘পঞ্চবার্ষিকী কর মূল্যায়ন কর্মসূচি’ উদ্বোধনের পর থেকে নগরের হোল্ডিং ট্যাক্স ইস্যুতে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন দুই নেতা।
সোমবার লালদীঘি মাঠে সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে সোনালী যান্ত্রিক মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির ব্যানারে। বর্ধিত হারে হোল্ডিং ট্যাক্স (গৃহকর) আদায়ের সিদ্ধান্ত বাতিল এবং মৎস্যজীবীদের অধিকার আদায়ে ডাকা হয়েছে এই সমাবেশ। অবশ্য বর্ধিত হারে গৃহকর আদায়ের কার্যক্রম সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে সম্প্রতি স্থগিত হয়েছে। সমাবেশ আয়োজনের পেছনে রয়েছেন চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। সমাবেশের প্রধান অতিথিও তিনি।
লালদীঘি ময়দানের এই সমাবেশ কার্যত নাছিরের বিরুদ্ধে ডাকা হয়েছে। সমাবেশ সফল করতে মহিউদ্দিন চৌধুরীর পক্ষে নগরে মাইকিং ও প্রচারপত্র বিলি করা হচ্ছে। প্রচারণায় বলা হচ্ছে, নগরবাসীর স্বার্থে সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী মাঠে নেমেছেন।
শনিবার চশমা হিলে নিজের বাসভবনে পারিবারিক মেজবানে উপস্থিত সাংবাদিকদের এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, সোমবার সমাবেশে চট্টগ্রামের স্বার্থ পরিপন্থি সব কাজের প্রতিবাদ জানাবো। সমাবেশ থেকে হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধিরও প্রতিবাদ করা হবে। চট্টগ্রামের স্বার্থের পরিপন্থি কাজ যেই করুক, আমি তার প্রতিবাদ করব। আমার ছেলে হোক বা আমার বন্ধু হোক… আমার পিতা হোক। চট্টগ্রামের স্বার্থের পরিপন্থি কাজ আমার জীবন থাকতে আমি করতে দেব না।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমি চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগকে তৈরি করেছি। চট্টগ্রামে রাজনীতির ক্ষেত্র তৈরি করেছি। আজ যে যা ইচ্ছা তাই করে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার চক্রান্ত করছে। আমি বঙ্গবন্ধুর কর্মী। অন্যায়কে জীবনে প্রশ্রয় দিই নাই। আগামীতেও যারা অন্যায় করছে, দলের ক্ষতি করেছে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই রুখে দাঁড়াব। কথা একটাই, অযোগ্য-অথর্ব লোক চট্টগ্রামবাসী চায় না।
চট্টগ্রাম বন্দরে ‘লুটপাট’ চলছে অভিযোগ তুলে মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রাম অর্থনীতির একটা শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র। এটা বিভিন্নভাবে অবহেলিত হচ্ছে। বন্দরকে নিয়ে লুটপাট করা হচ্ছে। চারজন নেতা… একজন নাছির সাহেব। সবকিছু নোট করেছি। দলের ভেতরে বা বাইরে যেই হোক, যারা বন্দরকে নিয়ে চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র করবে তাদেরকে প্রতিহত করা হবে।
এদিকে নগর আওয়ামী লীগ সভাপতির এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র রাজাখালীতে স্থানান্তর হয়েছে। উনি (মহিউদ্দিন) কি মৎস্যজীবী? সব বিতর্কের মধ্যে তিনি নাক গলান কেন? তার কাজ দলকে সংগঠিত করা, গতিশীল করা। নিজের স্বার্থ কিংবা চিন্তার বিরুদ্ধে গেলেই মহিউদ্দিন চৌধুরী এমন কথা বলা শুরু করেন। বন্দর নিয়েও তিনি সবসময় বলেন। তিনি মনে করেন, তিনি যা করেন, সবই যৌক্তিক।
মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র প্রসঙ্গে মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, রাজাখালীতে ওয়াকফ এস্টেটের জায়গা দখল করে মাছের আড়ত করা হয়েছে। আদালতের সিদ্ধান্ত না মেনে সেখানে আড়ত করা হয়েছে। রাজাখালীতে আড়ত করা নিয়ে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। এই টাকা আড়তদারদের ফেরত দিতে হবে। মাছ বিক্রেতাদের স্বার্থে দেড় শ বছরের পুরোনো জায়গায় (পাথরঘাটা) আবার আড়ত ফিরেয়ে আনা হয়েছে।
হোল্ডিং ট্যাক্স প্রসঙ্গে আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, সিটি করপোরেশন কেবল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের গেজেট অনুসরণ করে। সিটি করপোরেশন আদায়ের এখতিয়ার রাখে, হোল্ডিং ট্যাক্স ধার্য করে না। আমাদের আয়ের একমাত্র উৎস রাজস্ব। হোল্ডিং ট্যাক্স আদায় না হলে করপোরেশন চলবে না। উন্নয়ন চলবে না। উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের জন্য তিনি (মহিউদ্দিন চৌধুরী) বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। তিনি একজন দায়িত্বশীল প্রবীণ জননেতা। সরকারি দলের নগর কমিটির সভাপতি, তিনবার মেয়র ছিলেন। সরকারি সিদ্ধান্ত, বিধি-বিধান সবই তিনি জানেন। তিনি এত বড় নেতা, যে কোনো স্থানে কথা বলতে পারেন। মিটিং করে বিভ্রান্তি ছড়ানোর প্রয়োজন নেই।
হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, নতুন করে কর বাড়ানোর বিষয়টি নগরবাসীর ওপর একটি বড় আঘাত। সে (নাছির) নগরবাসীর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে। যোগ্যতা থাকলে আয়বর্ধক প্রকল্প নিয়ে নগরকে পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন সম্ভব। আমি করে দেখিয়েছি। সরকারের গেজেট অনুযায়ী আমি কোনো বাড়তি ট্যাক্স নিইনি। বর্ধিত ট্যাক্স নেওয়া হলে আগামী নির্বাচনে আমরা কি ভোট চাইতে পারব? সে (নাছির) আওয়ামী লীগকে অজনপ্রিয় করতে এজেন্ডা নিয়ে নেমেছে। এই এজেন্ডা আমি বাস্তবায়ন করতে দেব না।
এ প্রসঙ্গে আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, আমি সরকারের নীতিমালার আলোকে রাজস্ব (গৃহকর) আদায়ের উদ্যোগ নিই। তার (মহিউদ্দিন) কর্মকান্ড সরকারের বিরুদ্ধে। এ জন্য কি সমাবেশ ডাকতে হবে? এটা তো নজিরবিহীন। তিনি (মহিউদ্দিন চৌধুরী) উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যাচার করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন। নগরের উন্নয়ন ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছেন। রাজস্ব আদায় না হলে নগরের উন্নয়ন সম্ভব নয়। এমনকি করপোরেশেনর কর্মচারীর বেতন দেওয়া যাবে না।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সভাপতি প্রফেসর সিকান্দার খান বলেন, চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের দুই শীর্ষ নেতার এভাবে প্রকাশ্যে বিরোধিতায় জড়িয়ে পড়াটা ঠিক হচ্ছে না। এ চিত্র দেখে নতুন প্রজন্মের কাছে ভুল বার্তা যাবে। সুস্থ ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে এসব যায় না। আয়বর্ধক প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সিটি করপোরেশন অর্থের সংস্থান করতে পারে।’