ঠোঁটের অদূরে চুম্বন গেছে থেমে

শান্তনু চৌধুরী : বিয়ে, বাঙালি জীবনে এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে ব্যাপক প্রয়োজনীয় অথচ কিছু নিয়মের মধ্যে বাঁধাপড়া জীবন যেন। কালে কালে বিয়ের রূপ, ভোল বদলেছে। ইদানিং একটি কথা প্রায় শোন যায় ‘প্রেমের বিয়ে’। মানে বাবা মায়েরাও এখন চান ছেলেমেয়ে নিজের পছন্দ নিজেরাই ঠিক করে নিক। কে আবার মেয়ে বা ছেলে খুঁজতে যাবেন। হয়তো দেখা যাবে ঘটক খুঁজে বিয়ে করতে গেলে দু’পক্ষের নানা দোষ। আগের সম্পর্ক, টিকটক বা লাইকি তারকা এমন হাজার বায়ানাক্কা। আর আমরা প্রেমিকাকে যতোই নোরা ফাতেহির মতো দেখতে চাই না কেন বউকে চাই সতী সাবিত্রি। তবে এখানে কথা আছে।

প্রিয় মানুষকে পাওয়াটা আমার কাছে কখনো অন্তিম লক্ষ্য মনে হয় না। পেয়ে গেলামতো সব শেষ। সেই সংসার, সেই বাচ্চাকাচ্চা, সেই ডাইপার আর স্যানিটারি ন্যাকপিন বা কনডম কেনা। আলু-পেঁয়াজের সহজ হিসেব। তীব্র কষ্ট বা দহন না থাকলে কি সৃষ্টিশীল কিছু জন্মে? দয়িতা নার্গিসকে ফেলে বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছিলেন বলেই না নজরুলের কতো কতো অমর সৃষ্টি। কিংবা রাত দুটোয় প্রেমিকাকে দেখার তীব্র বাসনা। প্রেমিকাকে হারিয়েছিলেন বলেই না শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি হয়ে রয়েছে ‘দেবদাস’। কতোটা কষ্ট অনুভব করলে লেখা হয়, যেখানে সীমান্ত তোমার, সেখানে বসন্ত আমার। তাই আমি বলি কষ্টকে সৃষ্টির দিকে ধাবিত করতে হলে চাই তীব্র আকর্ষণও। এখন একুশ শতক তীব্র আকর্ষণও নেই।

তাই হয়তো প্রমোদ বসু কবিতা লিখেন-
‘আমাদের ছিল সাধারণ মান, সাধারণ বেঁচে থাকা।
আমরা কখনও যন্ত্র আনিনি প্রেমে
আরাম এখন শৃঙ্খলে বাঁধা, সব আয়োজন পাকা, ঠোঁটের অদূরে চুম্বন গেছে থেমে!’

কথায় আছে, ‘জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে/তিন বিধাতা নিয়ে।’ জন্ম-মৃত্যুর মতো বিয়েটাও অধিকাংশ নরনারীর কাছে রহস্য রোমাঞ্চকর এক বিমিশ্র বিষয়। তবে আগের দিনে বিয়ে ছিল আনন্দ আয়োজন আর এখন মনে হয় প্রয়োজন। গ্রামের বাড়িতে সামিয়ানা টাঙিয়ে বিয়ে হতো। পাড়া পড়শিদের মধ্যে আনন্দ উত্তেজনা। বরপক্ষ-কনেপক্ষের খুনসুঁটি। আর এখন কে এমন পরিশ্রম করতে চান! সব ক্লাবে দিয়ে দাও। ইভেন্ট ম্যানেজম্যান্ট। কয়েক ঘণ্টার জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ। সবাই শুধু সময়মতো যার যার কাজ করতে যাবেন। কেউতো আছেন মুখ রক্ষার জন্য বা উদরপূর্তির জন্য বিয়ে বাড়িতে গেলেন।

কে বর, কে কনে দেখার ফুরসতও মিলে না। খেয়ে দেয়ে বাহির থেকে চলে আসা। আগে বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্রে ছড়া থাকতো। পান, সুপারি দিয়ে নিমন্তন্ন করার চল ছিল। বন্ধু-বান্ধবদের নিমন্ত্রণ করার সময়ে বাজার থেকে কয়েকটা কার্ড নিয়ে এসে লাল কালিতে রং বাহারি ছড়ায় নিমন্ত্রণ-ছড়া লেখা হত। যেমন, ‘বন্ধু তোমায় জানাই খবর/হয়তো তুমি হাসবে/৮ই ফাগুন আমার বিয়ে/নিশ্চয় তুমি আসবে’। বিয়ের পদ্য সাধারণত তিন ধরনেরÑ ছড়াকারে লেখা, গদ্যে লেখা আর গদ্যপদ্য মিশিয়ে লেখা। পারিবারিক পদ্যগুলি ছিল ক্ষুদ্র পুস্তিকা স্বরূপ। এখানে পরিবারের বয়ানে এসব লেখা হতো। এ ধরনের পদ্যগুলিতে আশীর্বাণী, মৃত নিকট আত্মীয়কে স্মরণ করে শোকোচ্ছ্বাসও থাকতো।

চট্টগ্রামে আমাদের অনেক সাংবাদিক বন্ধুর বিয়েতেও আমরা এমন পুস্তিকা দেখেছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ের পদ্য না লিখলেও অনেক বিয়েতে তিনি আশীর্বাণী লিখে দিতেন। তবে প্রথম শ্রেণির বিয়ের পদ্যকার ছিলেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক। কাটোয়ার ডাকসাইটে ডেপুটি ছিলেন কবি তারকচন্দ্র রায়। তারকবাবুর শালার বিয়েতে পদ্য লিখে দিয়েছিলেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক। আচার্য হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের সংগৃহীত সেই পদ্যটি লেখা হয়েছিল ১৩২২ সালের ১৮ মাঘ। পদ্যটি লেখা হয়েছিল তারকবাবুর নাতির নামে, ‘আজকে তোমার বইবে তুফান বুকে/মুখেতে আর বলবো আমি কত/ দুই জনেতে থাক পরম সুখে/একটি বোঁটায় দুটি ফুলের মতো’।

অনেকে বিয়েকে দিল্লিকা লাড্ডুর সাথে তুলনা করেন। অর্থাৎ যে খাবে সেও পস্তাবে, যে খাবে না সেও পস্তাবে। নচিকেতা বিয়েকে তুলনা করেছে, বলির আগে ছোট্ট আয়োজনের সাথে। তবে বিয়ে এখন আর আগের মতো নেই। বিয়ে মানেই বেশ বড় আয়োজন। বড় রকমের প্রস্তুতি। সবাই চান তার বিয়ে অন্য সবার চেয়ে আলাদা হোক। সে জন্যই বিয়ে বাড়িতে নানা আজব, মজার কা- কারখানা দেখা যায়। পাকিস্তানে একজনতো ছেলের বিয়েতে বাবা এতটাই আনন্দিত হয়েছেন যে বাতাসে ২০ লাখ রুপি উড়িয়ে দেন। বাংলাদেশেও হেলিকপ্টারে করে, উট বা গাধার পিটে চড়ে বিয়ে করতে যাওয়া নিয়ে নানা মজার কাণ্ড রয়েছে। অর্থাৎ যে কোনো প্রকারে অন্যের চেয়ে আলাদা হওয়া চাই। বিয়ের সুন্দর ও আকর্ষণীয় ছবি তোলা আজকাল বিয়ের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আলোকচিত্রীদের ওপরও সুন্দর ছবি তুলতে মক্কেলদের চাপ থাকে। চীনে এক আলোকচিত্রী বিয়ের সুন্দর ছবি তুলতে গিয়ে শেষতক আগুনই ধরিয়ে দিলেন কনের পোশাকে। আশা একটাই, যদি ছবিটা আরও আকর্ষণীয় হয়! ওই ঘটনার ভিডিও চিত্র এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওতে দেখা গেছে, কনের বিয়ের গাউনে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছেন এক ব্যক্তি। অথচ সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই কনের। উল্টো শান্তভাবে ক্যামেরায় ছবির তোলার জন্য পোজ দিচ্ছেন তিনি। গাউনে ছড়িয়ে পড়া সেই আগুন যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন এক নারী দৌড়ে আসেন অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নিয়ে। তা দিয়ে আগুন নিভিয়ে দেন। আর এই কসরতের বদলে কনে পেয়ে যান মনের মতো ছবি! সেই ছবিতে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছেন কনে, আর তাঁর গাউনে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে অবশ্য এভাবে ছবি তোলার সমালোচনা করেছেন।

মার্কিন লেখক জোশ ডি ম্যাকডোয়েলের মতে, বিয়ে যতটা না সঠিক মানুষ খুঁজে বের করা, তার চেয়ে বেশি সঠিক মানুষ হয়ে ওঠা। তাই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে গেলে সবার আগে জানা প্রয়োজন, ঠিক কোন ক্রিয়াটি সম্পর্কের একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে। বিশেষ করে রোমান্টিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যখন ভাঙন অনিবার্য হয়ে ওঠে, তখন তাকে জোড়া লাগাতে ঠিক কোন আঠা ব্যবহার করা দরকার, সে খবর কি আমরা রাখি? আলিঙ্গন যে সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও বিপুল পরিমাণে কার্যকর একটি ক্রিয়া, সে কথা এই মুহূর্তে স্বীকার করছেন অর্ধেক ভূগোলের মানুষ।

ইউরোপ ও মার্কিন দেশে এই মুহূর্তে দারুণ জনপ্রিয় তাই ‘কাডল ক্লাব’। নিরাপত্তাহীনতা, আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি, সম্পর্কে শীতলতা ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে মানুষ হাজির হন এই সব ক্লাবে। এখানে একান্ত অপরিচিত ব্যক্তিরাও আলিঙ্গনের মাধ্যমে পরস্পরের কাছাকাছি আসেন। মনের ভিতরে জমতে থাকা মেঘগুলোকে বের করে দিতে পারেন সামান্য কিছু কসরতের মাধ্যমে। কেবল প্রেমবঞ্চিত মানুষই নন, এই ক্লাবে সামিল হয়েছেন বহু সংসারী নারী-পুরুষ। একাকীত্ব মেটানোর প্রয়োজন এক ছাদের নীচে সমবেত করে চলেছে অসংখ্য মানুষকে। তবে বাঙালিরা প্রকাশ্যে এমন নয় হয়তো। তবে কৌতুক আছে, বিয়ের প্রথম বছর স্ত্রী বলেন স্বামী শোনেন, দ্বিতীয় বছর স্বামী বলেন স্ত্রী শোনেন। আর তৃতীয় বছর নাকি দু’জনের বলেন পাড়া প্রতিবেশি শোনেন।

শান্তনু চৌধুরী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক