রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

‘এবার জানতে চাইবো গত বছর যারা করোনায় মারা গেছেন তারা কেমন আছেন?’

প্রকাশিতঃ ১৪ জুন ২০২১ | ১১:০৩ পূর্বাহ্ন

শান্তনু চৌধুরী : সংবাদ উপস্থাপকদের নানা মজার কাণ্ডকীর্তি আমরা মাঝে মাঝে ভাইরাল হতে দেখি। মানে পর্দার সামনের কীর্তির কথা বলছি। তবে এসবের বেশিরভাগই হয় অনিচ্ছাকৃত বা মনের ভুলে। হয়তো কেউ কেশ-প্রসাধন করছেন বা কাপড় ঠিক করছেন, কেউ সহকর্মীর সাথে গল্প করছেন কিন্তু ভুলে গেছেন ক্যামেরা চালু রয়েছে।

আবার আমাদের দেশে না হলেও বিদেশে টিভি উপস্থাপনার সময় প্রেম বা বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন এমন উদাহরণও কম নয়। এছাড়াও রয়েছে সংবাদ পাঠের সময় ভূমিকম্প বা অন্য কোনো প্রয়োজনে হঠাৎ ‘হটসিট’ ছেড়ে চলে যাওয়া, সংবাদ উপস্থাপনা করার সময় সহকর্মীর মৃত্যুর সংবাদ পড়তে হয়েছে এসব দৃশ্যও আমরা দেখেছি। কিন্তু সবচেয়ে বেশি হয়তো মানুষকে আকৃষ্ট করে একটু বেয়াক্কেলে বিষয়গুলো।

যেমন করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা শুরুর সময় লাইভে একাত্তর টেলিভিশনের এক উপস্থাপিকা যখন বলেন, ‘আমরা এবার জানতে চাইবো গত বছর যারা করোনায় মারা গেছেন তারা কেমন আছেন?’-এমন ধরনের প্রশ্ন সত্যি হাস্যরসের সৃষ্টি করে বটে! এখন যারা সংবাদ পড়েন তারা সরাসরি নিউজের সঙ্গে জড়িত, কিন্তু একটা সময় ছিল যখন সংবাদ পাঠকের কাজ ছিল শুধুই খবর পড়া। সেই সময় ‘শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেছে, কাল ঈদ’। টেলিভিশনের পর্দায় এমন সংবাদ পড়ে এসেও নিউজরুমে আহ্লাদ করে জিজ্ঞাসা করছে, ‘ভাইয়া কাল কি ঈদ হবে!’ এমন উদাহরণও রয়েছে। তবে এসবই জীবনপাঠ।

সম্প্রতি আর্জেন্টিনায় এমন একটি মজার ঘটনা ঘটেছে। আমরা অনেকে জানি, প্রখ্যাত ব্রিটিশ লেখক, কবি, নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার মারা গেছেন ১৬১৬ সালে। ৪০০ বছরের বেশি সময় পরে এসে তাঁর মৃত্যুসংবাদ প্রচার করে আলোচনায় এসেছে আর্জেন্টিনার একটি টিভি চ্যানেল। তবে এ ঘটনা ঘটেছে ভুলবশত, নামবিভ্রাটে। নামের মিল থাকায় যুক্তরাজ্যের একজন ব্যক্তির মৃত্যুর খবর ভুল করে শেক্সপিয়ারের নামে প্রচার করেন ওই চ্যানেলের একজন সংবাদ পাঠিকা। পরে সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা বলছে, যুক্তরাজ্যের ওয়ারউইকশায়ারে ৮১ বছর বয়সে মারা যাওয়া ওই ব্যক্তির নাম উইলিয়াম বিল শেক্সপিয়ার। তিনি ফাইজার ও বায়োএনটেকের উদ্ভাবিত করোনার টিকা নেওয়া বিশ্বের দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন। এ কারণে তাঁর মৃত্যুর খবর ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গুরুত্ব দিয়ে প্রচার ও প্রকাশ করেছে। যদিও টিকা নেওয়ার পাঁচ মাস পরে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। যুক্তরাজ্যের জাতীয় কবির নামের সঙ্গে মিল থাকায় তাঁর মৃত্যু ঘিরে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের বাড়তি মনোযোগ ছিল।

তবে এ খবর প্রচার করতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলেন আর্জেন্টিনার চ্যানেল ২৬–এর সংবাদ উপস্থাপক নোয়েলিয়া নোভিল্লো। রাতের খবরে তিনি লেখক, কবি, নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের মৃত্যুর কথা প্রচার করেন। এমনকি যখন পর্দায় উইলিয়াম বিল শেক্সপিয়ারের ভিডিও ফুটেজ প্রচার করা হচ্ছিল, তখনো তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই জানি, শেক্সপিয়ার ইংরেজি ভাষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখক। তিনি করোনার টিকা নেওয়া দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন। ৮১ বছর বয়সে যুক্তরাজ্যে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।’ ওই পাঠিকার হৃদয়ে হয়তো নাট্যকার শেকসপিয়র বাস করছিলেন দীর্ঘ সময় ধরে। তাই তাঁর মৃতুতে তিনি এতোটা ভেঙে পড়েন তাকে করোনার টিকা দিতেও ছাড়েননি।

যেমনটি প্রেমিকাকে নিজের রুমে দশ বছর ধরে লুকিয়ে রেখেছিলেন জার্মানির ডলি। পুরো নাম ওয়ালবুর্গা ওয়েসটেরেইচ। তিনি ছিলেন একজন জার্মান। বিয়ে করেছিলেন আমেরিকার ধনী কাপড় ব্যবসায়ীকে। তার নাম ছিল উইলিয়াম। ডলি তার স্বামী উইলিয়াম এবং তার প্রেমিক ওট্টো। এই ত্রিকোণ প্রেম ঘিরে এক সময় এক অদ্ভুত ঘটনা সামনে এসেছিল। স্বামী এবং প্রেমিক ওট্টোর সঙ্গে ১০ বছর একই ঘরে থাকতেন ডলি। তবে মজার বিষয় ছিল ১০ বছরের একটি দিনও তার স্বামী সে সত্য জানতে পারেননি। ঘরের মধ্যে ওট্টোকে এমন একটি জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিলেন ডলি, যে কোনোদিন তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতির আঁচটুকুও পাননি তিনি। তাদের বাড়ির চিলেকোঠায় এই ১০ বছর লুকিয়ে ছিলেন ওট্টো। স্বামী উইলিয়াম কাজে বেরিয়ে গেলেই ডলির কাছে নেমে আসতেন তিনি।

এবার আসি ভিন্ন এক প্রসঙ্গে। জান্তা সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে মিয়ানমার নানাভাবে আলোচনায় আসছে। এরা কতোটা হিংস্র প্রকৃতির সেটা মনে হয় রোহিঙ্গারা জানে আর সেখানকার নিপীড়িত জনগণ বুঝেন। আর প্রগতিশীল নিরপেক্ষ মানুষগুলো সবসময় যেন এদের প্রতিপক্ষ। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিচর্চা কোনো দেশের কোনো স্বৈরশাসক কখনো পছন্দ করেন না। সেদেশেও তেমনটাই ঘটছে।

মিয়ানমারের কবি কেথ থির লিখেছিলেন, ‘তারা গুলি চালায় মাথায়, কিন্তু তারা জানে না, বিপ্লব বাস করে হৃদয়ে’। মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায় তাঁর এই লাইনগুলো। মিছিলে-স্লোগানে উচ্চারিত হতে থাকে এই ধ্বনি। মানুষের মুখে মুখে ফিরতে থাকে, ‘বিপ্লব বাস করে হৃদয়ে’।

অসামান্য এই শব্দগুলো আগুন ধরিয়ে দিল সামরিক জান্তার মনে। একই সঙ্গে তাঁকে এনে দিল অমরত্ব। সেদিন ছিল ৮ মে। কেথ থি নিজ বাড়িতেই ছিলেন। তাঁর বাড়ি সাগাইং এলাকার শোয়েবোতে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য আচমকা হাজির হলো কেথ থির বাড়িতে। তারা তাঁকে বলল, ‘যেতে হবে আমাদের সঙ্গে।’ কেথ অবাক, ‘কোথায় যাব?’ উত্তর দেয়নি সৈন্যরা। টেনেহিঁচড়ে তুলে নিয়ে গেছে কবিকে। পরদিন কেথের স্ত্রী একটি হাসপাতালে তাঁকে পেয়েছেন বটে, তবে জীবিত নয়। কেথকে শুধু মেরেই ফেলা হয়নি, কেটে নেওয়া হয়েছে তাঁর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ!

কে জা উইনের কথা বলা যাক এবার। তিনিও বিপ্লবের বলি। তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা মনিওয়া শহরের কাছে লেতপাদুংয়ে। চীন ও মিয়ানমার সেনাবাহিনী যৌথভাবে একটি কারখানা তৈরি করতে গিয়ে কেড়ে নিয়েছে কে জা উইনদের জমি। তারপর থেকে তিনি ভূমি অধিকার নিয়ে সরব হয়ে ওঠেন। তিনি ছিলেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। ২০১৫ সালে শিক্ষা সংস্কারের দাবিতে এক বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। সেই মিছিল থেকে সৈন্যরা ধরে নিয়ে যায় এই সন্ন্যাসী কবিকে।

প্রায় এক বছর কারাগারে বন্দী করে রাখে। কারাগার থেকে বের হওয়ার পর মাই রিপ্লাই টু রোমান নামে একটি বই প্রকাশ করেন তিনি। বইটি তাঁকে প্রভূত খ্যাতি এনে দেয়। নিহত হওয়ার আগে কে জা উইন ফেসবুকে কবিতা লিখতেন। সর্বশেষ লিখেছিলেন, ‘তোমার সঙ্গে আমার দ্বিমত থাকতে পারে, তারপরও তোমার জন্য আমি আমার জীবন দিয়ে দেব।’ ভালোবেসে এখনো কেউ কেউ জীবন দিতে প্রস্তুত। দেশের জন্য সর্বস্ব দিতেও তারা কুণ্ঠাবোধ করেন না। আর কেউ কেউ আছে পারলে দেশটাই বেঁচে দেন।

শান্তনু চৌধুরী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক