অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল : পাকিস্তানি শাসনের আঠারো বছরের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং সর্বোপরি পাক-ভারত যুদ্ধের পটভূমিতে আওয়ামী লীগের পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন, যা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে পরিগণিত হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ছয় দফাকে নির্বাচনী ইশতেহার হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং এতে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে বিজয় অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার ক্ষমতার প্রশ্নে টালবাহানা শুরু করে। এর বিপরীতে বাঙালি জনগণ আর নিশ্চুপ থাকেনি। শুরু হয় স্বাধীনতার লড়াই। এক রক্তাক্ত বিপ্লবের মধ্যদিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র।
Xiaomi
বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রণীত ছয় দফা কর্মসূচি আকস্মিক কোনো ঘটনা ছিল না। ছয় দফা কর্মসূচিতে যে স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপিত হয়েছিল তার প্রেক্ষাপট এক দিনে রচিত হয়নি। স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর দীর্ঘ আঠারো বছরের সংগ্রামের পটভূমিতে এ কর্মসূচি গৃহীত হয়। বস্তুত এ ঘোষণা ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোর অধীনে বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সর্বোচ্চ যৌক্তিক ও ন্যায্য দাবি।
ভারতীয় উপমহাদেশে স্বায়ত্তশাসনের দাবি দীর্ঘ দিনের। ১৯১৬ সালের লখনৌ চুক্তিতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপিত হয়। তবে ১৯১৯ সালের মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইনে এই দাবি পুরোটা গৃহীত হয়নি। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনেও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পরিধি ছিল গণ্ডিবদ্ধ। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে স্বায়ত্তশাসনের দাবি জনগণের ম্যান্ডেটে পরিণত হয়। যুক্তফ্রন্টের একুশ দফায় প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা- এ তিনটি বিষয়ে ফেডারেল সরকারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৫৬ সালের সংবিধান পাকিস্তানে একটি ফেডারেশন প্রতিষ্ঠা করে, কিন্তু তাতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ততটা প্রদান করা হয়নি। বাঙালির দুর্ভাগ্য যে, সেই সীমিত স্বায়ত্তশাসনও কখনও বাস্তব রূপলাভ করেনি। সর্বশেষ ১৯৫৮ সালের সামরিক অভ্যুত্থান প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের স্বপ্টম্নকে সম্পূর্ণরূপে গুঁড়িয়ে দেয়।
স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে বাঙালির দীর্ঘ দিনের পথ-পরিক্রমার একটি প্রত্যক্ষ যোগসূত্র তৈরি করে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ। কাশ্মীর নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধে মেতে ওঠে। এই যুদ্ধের অভিজ্ঞতা বঙ্গবন্ধুকে দারুণভাবে তাড়িত করে। ১৭ দিনের পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। বিশ্বের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের যোগাযোগ পুরোপুরি পশ্চিম পাকিস্তানের মাধ্যমে হওয়ায় এ-সময় দেশটি প্রায় এক মাসের মতো পুরো বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। এ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু লক্ষ্য করলেন, ব্যালটের মাধ্যমেও বাঙালির কোনো কিছু করার জো নেই। ফলে ছয় দফা পরিণত হলো বাঙালি বাঁচার দাবিতে।
১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলো তাসখন্দ চুক্তির বিরোধিতায় এক কনভেনশনে মিলিত হয়। কনভেনশনের দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু তার ছয় দফা উত্থাপন করেন। ১৩ মার্চ আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় এটি পাস হয়। ১৮-১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ছয় দফা কর্মসূচি অনুমোদিত হয়। এই সভায় বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
ছয় দফার প্রতিটি দফা প্রণয়নে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও সুদূরপ্রসারী চিন্তার পরিচয় লক্ষণীয়। ছয় দফার উদ্দেশ্য ছিল দীর্ঘ দিনের বিবদমান সংঘাতকে সীমিত করে পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে সদ্ভাব তৈরি করা এবং একই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। তুমি তোমার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করো, আমার ব্যাপারে নাক গলাতে এসো না- ছয় দফার দফাগুলো বিশ্নেষণ করলে এটিই প্রতীয়মান হয়।
বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ছয় দফাকে সহজে মেনে নেবে না। এজন্য তিনি ছয় দফার সপক্ষে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে জনসভায় বক্তৃতা দেন এবং ছয় দফা তুলে ধরেন। ১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ থেকে ৮ মে পর্যন্ত পঞ্চাশ দিনে ৩২টি জনসভায় ভাষণ দিয়ে তিনি ছয় দফা ব্যাখ্যা করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা কর্মসূচি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে কতটা শঙ্কিত করে তুলেছিল তা আইয়ুব খানের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া থেকে অনুধাবন করা যায়। জেনারেল আইয়ুব খান ছয় দফাকে ‘হিন্দু আধিপত্যাধীন যুক্তবাংলা গঠনের ষড়যন্ত্র’ বলে আখ্যা দেন। তিনি ছয় দফাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী, বিদেশি মদদপুষ্ট, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, ধ্বংসাত্মক ইত্যাদি আখ্যায়িত করেন এবং এর প্রবক্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ‘১ নম্বর দুশমন’ হিসেবে চিহ্নিত করে ছয় দফার সমর্থকদের ‘অস্ত্রের ভাষা’ প্রয়োগের হুমকি দেন। ১৯৬৭ সালের মার্চ মাসে আইয়ুব খান ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বলেন, ‘যারা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য চেঁচামেচি করছে, তারা পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা কামনা করে। যদি এটা ঘটে তাহলে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে।’
বঙ্গবন্ধু ও তার ছয় দফার প্রচারণাকে দমিয়ে রাখার অপচেষ্টায় পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে তাকে একাধিকবার গ্রেপ্তার করা হয়। ছয় দফার প্রচারকালে কখনও ঢাকা, কখনও সিলেট, কখনও নারায়ণগঞ্জ, আবার কখনও ময়মনসিংহ থেকে বঙ্গবন্ধুকে তিন মাসে আটবার গ্রেপ্তার করা হয়। সর্বশেষ ৮ মে তাকে গ্রেপ্তার করে দীর্ঘ সময়ের জন্য কারা অভ্যন্তরে রাখা হয়। বঙ্গবন্ধু ও তার ছয় দফা কর্মসূচিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে দু’বছরের মাথায় (১৯৬৮ সালে) বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করে পাকিস্তান সরকার আগরতলা মামলা দায়ের করে, যার সরকারি নাম দেওয়া হয় ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ছাত্ররা আন্দোলন করে। জনগণ স্লোগান দিল- ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব’। এভাবে পাকিস্তানি উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে গণজোয়ার সৃষ্টি হয় এবং গণঅভ্যুত্থানে (১৯৬৯ সালে) আইয়ুব খান ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।
ছয় দফা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের মধ্যে যে সচেতনতা ও ঐক্য গড়ে ওঠে, তার প্রভাব পড়ে সত্তরের নির্বাচনে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ছয় দফা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ফলে বাঙালি ব্যালটের ভাষায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিবর্তনের জবাব দেয় এবং বিপুল ভোটে বিজয় লাভ করে। অন্যদিকে ছয় দফা বিরোধী দলগুলোকে জনগণ আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে। ‘৭০-এর নির্বাচনী ফল প্রকৃতপক্ষে ছয় দফার প্রতি গণসমর্থনেরই বহিঃপ্রকাশ। এভাবে ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি স্বাধীনতা অর্জনের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে স্বাধীন-সাবভৌম বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়।
সুতরাং ছয় দফা ভিত্তিক আন্দোলন এবং এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কোনো হঠকারী ঘটনা নয়। বহু পথপরিক্রমার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বাঙালি স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে, বিচ্ছিন্নতাবাদ হিসেবে নয়। ছয় দফা কর্মসূচি স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এটি অনস্বীকার্য যে, ছয় দফা পরবর্তী আগরতলা মামলা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং সর্বোপরি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ একই সূত্রে গাঁথা।
ছয় দফা কর্মসূচি ও ছয় দফাভিত্তিক আন্দোলন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে একটি মাইলফলক সৃষ্টি করেছিল- এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়। এটি বললে অত্যুক্তি হবে না যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় লাহোর প্রস্তাব যেরূপ ভূমিকা পালন করেছিল, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ছয় দফার ভূমিকা ছিল তদ্রূপ। বস্তুতপক্ষে ছয় দফা ছিল পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের দীর্ঘ আঠারো বছরের অর্থনৈতিক শোষণের পরিসমাপ্তির অঙ্গীকার; বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। যে কারণে ছয় দফা ‘বাঙালির ম্যাগনাকার্টা’য় পরিণত হয়। মূলত ‘ম্যাগনাকার্টা’ হলো ১২১৫ সালে ইংল্যান্ডের রাজা জন কর্তৃক প্রণীত ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রের একটি দলিল, যেখানে শোষণহীন সমাজকে কল্পনা করা হয়। বঙ্গবন্ধু তার ছয় দফায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির মাধ্যমে সেখানে স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতি গড়ে তোলার রূপরেখা প্রণয়ন করেছিলেন। সেই অর্থে ছয় দফা ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ বা ম্যাগনাকার্টা।
ঐতিহাসিক ছয় দফা একটি সুচিন্তিত ও সুনির্দিষ্ট দাবিমালা, যেখানে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের সুস্পষ্ট রূপরেখা প্রণীত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের উপনিবেশবাদ থেকে বেরিয়ে এসে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, যেখানে জনগণ পাবে অর্থনৈতিক মুক্তি। ছয় দফার মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক স্বাধীনতার লক্ষ্যে স্থির থেকে অর্থনৈতিক দিকটি সামনে নিয়ে আসার কৌশল তৈরি করেন।
লেখক : উপ-উপাচার্য (শিক্ষা), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।