মৃত্যু জীবনের শেষ নহে নহে

শান্তনু চৌধুরী : সমরেশ মজুমদারের লেখায় পড়েছিলাম, ‘মৃত্যু কী সহজ, কী নিঃশব্দে আসে। কিন্তু মানুষ চিরকাল জীবন নিয়ে গর্ব করে যায়। কোনো কোনো মানুষ কী  নিদারুণ ব্যথাতুর থেকে ফুরিয়ে দেয় জীবনের সব লেনদেন। এই করোনাকালে কেউ চাকরি হারিয়ে, কেউবা করোনা রোগ হয়েছে শুনে আবার কেউবা অর্থকষ্টে থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন জগত থেকে।

হাদীসে বলা হয়েছে, ‘মানুষ যদি মৃত ব্যাক্তির আর্তনাদ দেখতে এবং শুনতে পেতো তাহলে মানুষ মৃত ব্যক্তির জন্য কান্না না করে নিজের জন্য কাঁদত’। মৃত্যু নিয়ে কতো কবিতা, কতো গান বা কতো ছন্দ লিখেছেন কবিরা, গীতিকাররা।

কবি আল মাহমুদ বলেছেন-

‘কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে
মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ;
অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে
ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ’।

বীরের মতোই তো সবাই মরতে চাই। কিন্তু কোনো কোনো মৃত্যু ঠিক বুকের মধ্যে বিঁধে। আত্মহনন! কিছুদিন আগে রাজশাহীতে আত্মহত্যা করেছেন আনারুল ইসলাম টুটুল নামের এক ফ্রিল্যান্সার। তিন মাস ধরে তিনি খাবারের কষ্টে ছিলেন। আত্মহত্যার আগে ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, ‘প্রিয় দেশবাসী তিন মাস থেকে আমার ঘরে খাবারের কষ্ট। আমার স্ত্রী অনেক কষ্টে খাবার জোগাড় করতেছে। আমার মৃত্যুর পর আমার স্ত্রী, ছেলেমেয়ের পাশে থাকবেন। ওদের থাকার জায়গাটাও আমি রেখে যেতে পারলাম না। কথাগুলো লিখতে লিখতে অনেক কাঁদলাম। সবাইকে অনেক মনে পড়ছে। আর থাকতে পারলাম না চলে যাচ্ছি। ক্ষমা করে দিয়েন; ক্ষমা করে দিও আল্লাহ। আমার স্ত্রী, ছেলেমেয়ের জন্য কিছুই করে যেতে পারলাম না। বেঁচে থাকলে আরও ঋণ বেড়ে যাবে। তাই চলে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই। যদি সম্ভব হয় আমার স্ত্রী, ছেলেমেয়ের থাকার একটা ব্যবস্থা করে দেবেন আপনারা।’

এই পৃথিবী খুব বেশি স্বার্থপর এখন। কেউ কাউকে মনে রাখে না। কবি নাজিম হিকমতের ভাষায় বলি, ‘আমার স্মৃতি কালো ধোঁয়ার মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে, বিংশ শতাব্দীতে, মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর’।

এই যেমন আমরা কতোজনকেই তো ভুলে গেছি। সে যেমন মৃত্যুই হোক। আত্মহত্যার আগে সাংবাদিক মিনার মাহমুদের প্রিয়তমা স্ত্রী লাজুক লতাকে লেখা চিঠিটার কথা মনে পড়লো। তিনি লিখেছেন, ‘লাজুক, সাংবাদিকতা পেশায় মেধাহীন আমি শ্রমই দিয়েছি। নিউজপ্রিন্টের ওপর বলপয়েন্ট দিয়ে ক্রমাগত লিখে যাওয়া-হাত ফুলে উঠতো, লাইট বাল্বের উত্তাপ দিয়ে সেক দেওয়া। আবার লেখা। নিজের কাছে প্রশ্ন করি, সাংবাদিকতা পেশার নাম বিনিয়োাগ করে কখনও আমি কি কোনও সুবিধা নিয়েছি? নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এখন চার হাজার টাকা। কোন বাড়ি অথবা দেশের কোথাও এক ইঞ্চি জমি নেই। আক্ষরিক অর্থে সর্বহারা। একটা সময়ে বাংলাদেশকে আমি দেখেছি পর্বতের উচ্চতা থেকে। নিজের জন্য সম্পদ মাথায় আসেনি। এখন শোনো লাজুক। আমি সর্বহারা। ‘কিছু নেই’ একজন মানুষ। বিচিন্তা আবার প্রকাশ করেছিলাম, পাঠকরা নেয়নি। পরে একটি চাকরির জন্য কত চেনা অচেনা পত্রিকা-মিডিয়ায় চেষ্টা করেছি কেউ নেয়নি। অবাক হয়েছেন নিয়মিত লেখা এক সাংবাদিক। হাজিরা দেব, নিয়মিত লিখব, মাস শেষে একটা বেতন কোথাও হয়নি। কাউকে অভিযোগ করিনি’।

একজন সাংবদিক হিসেবে এই কথাগুলোও মাঝে মাঝে মনকে আর্দ্র করে তোলে। তবে মনে করি নিজেকে ভালো না বাসা কোনো মহত্ত্ব হতে পারে কি? ইদানীং এসব নিয়ে পড়ছি বেশ। পাঠকদের শেয়ার করছি। ঠাকুর নিগমানন্দ বলছেন, ‘মরাও আবার অনেক রকম আছে। জ্ঞানপূর্বক যাদের মৃত্যু হয় তাদেরই উন্নত অবস্থা লাভ হয়ে থাকে। আর যাদের আকস্মিক মৃত্যু বা আত্মহত্যা করে মত্যু হয়, তাদের খুব নিম্নগতি হয়। সবচেয়ে আত্মহত্যাটাই খারাপ। কোনো আকস্মিক দৈব-দুর্বিপাকে মৃত্যুটা স্বেচ্ছাকৃত নয়; কিন্তু আত্মহত্যা স্বেচ্ছ্বাকৃত।এইরূপ মৃত্যুতে অনেকদিন পর্যন্ত অজ্ঞান অবস্থায় থাকতে হয়-এটা ভয়ানক খারাপ অবস্থা’।

এ প্রসঙ্গে চলে আসে ভূত-প্রেতের কথা। আমরা যেটা ছোটবেলায় শুনতাম মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে ভূত বা প্রেত হয়ে মৃত্যুযান। ভারতের হুগলিতে জয়দীপ মহারাজের কাছে একবার জানতে চাওয়া হয়েছিল প্রেত সম্পর্কে। তিনি বলেছিলেন, ‘যদি চোখের সামনে কারো মৃত্যু দেখেন তাহলে নিজেই বুঝতে পারবেন। রাস্তায় কারো অ্যাক্সিডেন্ট হলো, আপনার চোখের সামনে সে মারা গেল। এবার মারা যাওয়ার সময় যদি দেখেন সে মলত্যাগ বা মূত্রত্যাগ করে ফেলল, তার মানে হচ্ছে মলদ্বার বা মূত্রদ্বার দিয়ে তার প্রাণবায়ু বেরিযে গেল। এক্ষেত্রে তার প্রেতযোনি প্রাপ্ত হয়। বিশেষ করে যারা আত্মহত্যা করে বা বড় রকমের কোনও অপরাধ করে, অথবা মদ্যপ অবস্থায় অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়, যখন বেহুঁশ অবস্থায় তার মৃত্যু হয় তখন শরীরের নিম্নাঙ্গ দ্বার দিয়ে তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায়। এদের মৃত্যুর পর প্রেতযোনি প্রাপ্ত হয়। প্রেতযোনি প্রাপ্ত হওয়া মানে পৃথিবীর স্তরের খুব কাছে সে আটকে থাকবে, কারণ তার যে মৃত্যু হয়েছে এটা বুঝতে তার অনেকটা সময় লাগে। বিশেষ করে যারা আত্মহত্যা করে তাদের যে মৃত্যু হয়েছে এটা বুঝতে বহুদিন লেগে যায়। তাই মৃত্যুর আগে তারা যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থাতেই তাদের থাকতে হয়।

ধরুন, কেউ গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করল বা নিজেকে গুলি করে সুইসাইড করল, মৃত্যুর পরেও বছরের পর বছর ধরে তার ওই দৃশ্যটাই একইভাবে দেখে যেতে হবে। যেখানে প্রেত থাকে সেখানে গেলে দেখবেন ‘জ্বলে গেলাম, মরে গেলাম গো’ বলে কাঁদছে, অর্থাৎ তার এখনো মনে হচ্ছে সে নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে মারা যাচ্ছে, এখনো তার মনে হচ্ছে সে খুব কষ্ট পাচ্ছে। তার মনে হয় তাকে কেউ দেখতে বা বুঝতে পারছে না। এটা খুবই কষ্টের সময়। প্রেতযোনি অবস্থায় সে শরীরে কষ্ট পাচ্ছে না কিন্তু সে ভাবছে সে কষ্ট পাচ্ছে।

ধরুন, একজনের সত্তর বছরের আয়ু, সে পঁচিশ বছর বয়সে আত্মহত্যা করল, সেক্ষেত্রে ৭০-২৫ অর্থাৎ পঁয়তাল্লি­শ বছর তাকে ওই অবস্থায় থাকতে হবে। এভাবে তাদের প্রারব্ধ ভোগ করতে হয়। এটা খুবই কষ্টকর অবস্থা, একেই বলে প্রেতযোনি’। একবার আত্মহত্যা করে তার তিনজন্ম আত্মহত্যা করার প্রবণতা থাকে, অর্থাৎ পরের জন্মেও সে আত্মহত্যা করতে পারে, কারণ তার ‘কিছুই ভালো লাগছে না, মরে যাব’ এই ভাবটা ছোটবেলা থেকেই কাজ করবে। সামনে কোনও গভীর খাদ দেখলেই তার সেখান থেকে ঝাঁপ দিয়ে মরে যেতে ইচ্ছে করবে। খরস্রোতা নদী দেখলে নদীতে ভেসে যেতে ইচ্ছা করবে, কেউ মারা গেলে নেশার মত সেই গল্প শুনতে চাইবে। মৃত্যু সম্পর্কে চিরকাল তার একটা অজানা কৌতূহল থাকবে, সারাক্ষণ তার মনে হবে মরে গেলে কী হয়? তার মনে হবে সব সময় তাকে কে যেন ডাকছে, কোন গাছ থেকে, নোংরা জায়গা থেকে, শ্মশান থেকে কে যেন তাকে ‘আয় আয়’ বলে ডাকছে। একে আমরা ‘নিশির ডাক’ বলি। এই কারণে শাস্ত্রে বলা হয়েছে ‘আত্মহত্যা মহাপাপ’। আত্মহত্যা করা উচিত নয়। আপনি তো জীবনকে সৃষ্টি করেননি, তাই জীবনকে শেষ করার অধিকারও আপনার নেই’।

শান্তনু চৌধুরী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক