একুশে প্রতিবেদক
চট্টগ্রাম: মানুষ বিপদে পড়লে, প্রথমে যায় থানায়। নিরাপত্তার যেকোনো প্রয়োজনে পুলিশ সহায়তাও দেয়। কিন্তু প্রায়ই অভিযোগ উঠে, থানায় গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন মানুষ। সাধারণ মানুষ আর পুলিশের মধ্যে এ দুরত্ব কমাতে শুরু করা হয় মডেল থানার কার্যক্রম। সেবার মান বাড়িয়ে নানামুখী সুবিধা দিতে স্থাপন করা হয় মডেল থানা। কিন্তু মডেল থানায় যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা তা পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি মডেল থানাগুলোই রয়েছে নানা অসুবিধায়। খুঁজে পাওয়া যায় না মডেল আর সাধারণ থানার মধ্যে কোন পার্থক্য। এতে পূরণ হচ্ছে না মডেল থানা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে। এছাড়া কয়েকটি মডেল থানার পুলিশের বিরুদ্ধে রয়েছে অভিযোগের পাহাড়ও!
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের ১৬টি থানার মধ্যে পাঁচলাইশ ও পতেঙ্গাকে মডেল থানা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অন্যদিকে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের ১৬টি থানার মধ্যে মডেল থানা ঘোষণা করা হয় সীতাকুন্ড, হাটহাজারী ও রাঙ্গুনিয়াকে। এসব মডেল থানায় যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা তার বেশিরভাগই নেই। লোকবল সংকট, অফিস কক্ষ ও আবাসন সংকট তো রয়েছেই। রিকুইজিশন করা যানবাহন দিয়ে চলছে মডেল থানার কার্যক্রম। নিজস্ব জমি নেই এমন মডেল থানাও রয়েছে। নেই নারী ও শিশুবান্ধব আলাদা পুলিশী সেবা।
পুলিশ সূত্র জানায়, অবকাঠামো উন্নয়ন, জনবল বৃদ্ধি, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, বিশুদ্ধ খাবার পানির সরবরাহ, আন্তরিক অভ্যর্থনা, ২টি করে পিকআপ ভ্যান, ৫টি মোটরসাইকেল, সার্ভিস ডেলিভারি সেন্টারে বসার চেয়ার-টেবিল, কম্পিউটারসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা মডেল থানায় থাকার কথা ছিল। কিন্তু সরেজমিন থানাগুলো ঘুরে এ চিত্র দেখা যায়নি। সংশ্লিষ্টদের মতে, শুধু সুষ্ঠু তদারকির অভাবে এসব পরিকল্পনা ও উদ্যোগ ভেস্তে যাচ্ছে।
সরেজমিন পাঁচলাইশ মডেল থানায় গিয়ে দেখা গেছে, উপ-পরিদর্শকদের কক্ষে পাশাপাশি চেয়ার-টেবিল পেতে রাখা হয়েছে ৮টি। অথচ এ থানায় উপ-পরিদর্শক রয়েছেন ২২জন। একজন অফিসার আসলে, আরেকজন অফিসারকে চেয়ার ছেড়ে দিতে হয়। রয়েছে পুলিশ সদস্যদের আবাসন সংকটও। ফটোস্ট্যাট মেশিন, ফ্যা´ মেশিন ও অগ্নি নির্বাপক সরঞ্জামগুলো নষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছে। থানার কাজে ব্যবহার হওয়া তিনটি গাড়ির মধ্যে একটি আবার ভাড়া। মডেল থানার প্রধান হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্বে আছেন পাঁচলাইশ জোনের সহকারী কমিশনার আসিফ মহিউদ্দিন। এ থানায় দুইজন পরিদর্শক, ২২জন এসআই, ২৪জন এএসআই ও ৩৭ জন কনস্টেবল কর্মরত আছেন। এ হিসেবই বলে দিচ্ছে পাঁচলাইশে পুলিশ কনস্টেবলের চেয়ে পুলিশ কর্মকর্তা বেশী। কনস্টেবল সংকটের কারণে অভিযান পরিচালনায় সমস্যায় পড়তে হয় বলে জানিয়েছেন থানার ওসি মহিউদ্দিন মাহমুদও।
অন্যদিকে পতেঙ্গা মডেল থানায় গিয়ে দেখা গেছে, থানায় নেই নারী ও শিশু হাজত। রয়েছে ২টি গাড়ি। বেপজার মালিকানাধীন জমিতে চলছে থানার কার্যক্রম। অফিস ও আবাসন সংকটে ধুঁকতে থাকা পতেঙ্গা মডেল থানার বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগও। গত ২৩ এপ্রিল পতেঙ্গা মডেল থানার অদূরে হাদীপাড়া এলাকায় মিনহাজ নামের এক প্রতিবন্ধি শিশুকে পিটিয়ে মারাত্মক আহত করে ইসহাক নামে এক যুবলীগ কর্মী। এ ঘটনার পরপরই অভিযুক্ত ইসহাককে পুলিশ আটক করে ‘সামান্য মারধর’ করা হয়েছে মর্মে আদালতে চালান দেয়। এ মামলার আসামি ইসহাক ২৫ এপ্রিল জামিন পায়। তবে শিশু নির্যাতনের এ ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর দেশজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠে। এ বিষয়টিকে পুলিশ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে বলে অভিযোগ উঠে। এ প্রসঙ্গে পতেঙ্গা মডেল থানার ওসি মোঃ আলমগীর বলেন, মারধরের অভিযোগে ইসহাককে আদালতে পাঠিয়েছি। সে জামিন পেয়েছে কিনা জানি না।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অর্থ ও প্রশাসন) মইনুল হোসেন বলেন, মডেল থানাগুলোতে লজিস্টিক সাপোর্ট কম। গাড়ির বিষয়ে সীমাবদ্ধতা আছে। এরপরও যতটুকু সুবিধা আছে, সেটুকুকে আমরা সর্বোচ্চ ব্যবহার করে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।
এদিকে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের আওতাভুক্ত রাঙ্গুনিয়া মডেল থানায় নেই সহকারী পুলিশ সুপার পদবীর কর্মকর্তা। গাড়ি রয়েছে দুইটি, এর মধ্যে একটি পুলিশ রিফর্ম প্রজেক্ট (পিআরপি) থেকে পাওয়া। তবে পিআরপি থেকে কোন মোটরসাইকেল এ থানা পায়নি। থানার গাড়ি ও পুলিশ সদস্যদের আবাসন সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ থানায় দালালদের উৎপাতে সেবাপ্রার্থীরা অতিষ্ট বলে অভিযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে ১৪ ইউনিয়ন, একটি পৌরসভা এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে আছে হাটহাজারী মডেল থানা। থানার প্রধান হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন হাটহাজারী সার্কেলের এএসপি মশিউদৌল্লাহ রেজা। এ থানার রয়েছে মাত্র ৩টি গাড়ি। হাটহাজারী মডেল থানার ওসি, দুইজন এসআই, দুইজন এএসআই ও চারজন কনস্টেবল আবাসিক বাসা পেয়েছেন। কয়েকজন ব্যারাকে থাকলেও বেশিরভাগই বাসা ভাড়া নিয়ে আছেন। ফোর্স সংকট মোকাবেলায় জেলা পুলিশের কাছে ধরনা দিতে হয় সবসময়।
এদিকে সীতাকুন্ড মডেল থানায় রয়েছে ৩টি গাড়ি। এর মধ্যে দুইটি আবার অনেক পুরনো। কাজ চালাতে হয় রিকুইজিশন করা গাড়ি দিয়ে। ওসির জন্য জরাজীর্ণ একটি বাসা থাকলেও আর কোন অফিসারদের সেই সুবিধাটুকুও নেই। কয়েকজন কনস্টেবল ব্যারাকে থাকলেও অন্য সবাইকে থাকতে হচ্ছে ভাড়া বাসায়। এদিকে এ মডেল থানার পুলিশের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা গুরুতর অভিযোগ। গত ১৫ ডিসেম্বর বিকেলে ওসমান গণি নামে এক যুবককে গুলি করে হত্যার অভিযোগ উঠে থানার এএসআই ইকবালের বিরুদ্ধে। তবে সীতাকুন্ড মডেল থানার ওসি ইফতেখার হাসানের দাবি, পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে ওসমান। এসময় পুলিশের সাথে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। এছাড়া পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি করেন সারা দেশে এমন ৯৮ জন পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যের নাম-পরিচয় গত বছর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দেয় একটি গোয়েন্দা সংস্থা। এ তালিকায় রয়েছে সীতাকুন্ড মডেল থানার ওসি ইফতেখার হাসান, এসআই মিজান ও কামালের নাম।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মডেল থানা আর সাধারণ থানার সুযোগ-সুবিধা একই। মডেল থানাগুলোতে দুই-তিনটি করে গাড়ি আছে, সাধারণ থানাগুলোতেও একই পরিমাণ গাড়ি রয়েছে। মডেল থানা ঘোষণার সময় পুলিশ রিফর্ম প্রজেক্ট থেকে থানায় যেসব সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়, তার সবগুলো চট্টগ্রামের থানাগুলোতে দেওয়া হয়নি।