শরীফুল রুকন : চট্টগ্রাম নগরে ৬০ হাজার টাকায় মিলবে আড়াই কাঠা জমি- এমন লোভ দেখিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে একটি চক্র। লোভে পড়ে সেই ফাঁদে ধরা দিচ্ছে চট্টগ্রামের নিম্নআয়ের অনেক মানুষ। প্রতারকরা নিজেদেরকে পরিচয় দিচ্ছে কথিত ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সোসাইটি’র কর্মকর্তা হিসেবে।
নগরের হালিশহর, সরাইপাড়া, পাঠানটুলি, বেপারীপাড়া, রঙ্গীপাড়া, সবুজবাগ আবাসিক, রমনা আবাসিকসহ আগ্রাবাদ এলাকায় এই চক্রের সদস্যরা বেশি সক্রিয়। প্রাথমিকভাবে চট্টগ্রামে ১৫ হাজার সদস্য করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে তারা মাঠে নেমেছে বলে জানা গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, ২০০ টাকা দিয়ে আবেদন ফরম পূরণ করে মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সোসাইটি’র সদস্য হলে পর্যায়ক্রমে আমেরিকা ঘুরিয়ে আনার প্রলোভনও দেয়া হচ্ছে। দৈনিক ২০০ টাকা উপার্জনের প্রলোভন দেখিয়ে বস্তিতে বসবাসকারী হতদরিদ্র নারীদের এই সদস্য ফরম বিক্রির জন্য মাঠে নামিয়েছে একটি চক্র। ফরম পূরণ করার কথা বলে এই অসাধু চক্রের সদস্যরা সংগ্রহ করছে একটি পাসপোর্ট সাইজ ছবি, ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি ও ২০০ টাকা।
মাঠপর্যায়ে যারা সদস্য করার কাজে নেমেছে তাদের একজন ডলি আক্তার; তিনি বলেন, ‘আমাকে এসব ফরম বিক্রি করতে দিয়েছে মুজিব নামের একজন। আমার মনে হচ্ছে, এসব প্রতারণা। মানুষ জায়গা না পেলে আমাকে ধরবে। তাই ফরমগুলো ফেরত দিয়ে দেব আমি।’
এদিকে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে মুজিব নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সোসাইটি’র চট্টগ্রামের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে পরিচয় দেন; তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সহযোদ্ধা এবং তাদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-পতি, আওয়ামী লীগ পরিবারের অসহায়-দরিদ্র, অবহেলিত-লাঞ্ছিত ও ভূমিহীনদেরকে আমরা সদস্য করবো। আবেদন ফরম পূরণের পর যাচাই-বাছাই করা হবে। আমরা ১৫ হাজার সদস্য নেব। প্রত্যেক সদস্য ৬০ মাসে ৬০ হাজার টাকা দিলে আড়াই কাটা করে জমি পাবে। এখন আমরা থানা পর্যায়ে কমিটি গঠন করে সদস্য বাড়ানোর কাজ করছি।’
এ প্রতিবেদকের আত্মীয়-স্বজন কেউ মুক্তিযোদ্ধা নন, এরপরও প্রতিবেদক জমি পেতে পারেন কিনা প্রশ্নে মুজিব বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের নেতা মুক্তিযোদ্ধা নুরুউদ্দিন জমাদারের সাথে আপনি আলাপ করেন।’
জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা পুনবার্সন সোসাইটি চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুউদ্দিন জমাদার বলেন, বোয়ালখালীতে আমাদের ৬০০ একর জায়গা আছে। চৌধুরী হাটের পশ্চিম পাশে আছে আড়াইশ’ একরের মত। বায়েজিদ ক্যান্টনম্যান্টের পাশে ইসলামপুরে প্রায় ২২২ একর জায়গা আছে। কালুশাহ মাজার এলাকায় আছে ৩৭৪ একর। কুমিরায় মেডিকেলের পেছনে আছে ৭০ কানি। আমাদের জায়গা অনেক স্থানে আছে।’
এসব জমি জেলা প্রশাসন বস্তোবস্তি দিয়েছে কিনা জানতে চাইলে নুরুউদ্দিন জমাদার বলেন, ‘এখনো দেয়নি। তবে আমরা এসব জায়গা মোটামুটি দখলে নিয়েছি। জেলা প্রশাসক তো জনগণের অধিকার নিশ্চিত করবে। দারিদ্র্য বিমোচন নিশ্চিত করার জন্য, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মানুষ ও তাদের আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে আমরা ২৬ হাজার সদস্যের একটা চাহিদাপত্র তৈরি করেছি। এটা ডিসির মাধ্যমে ভূমি মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে দিয়েছি। সব প্রক্রিয়া ঠিক করা আছে। এখন আমরা নানা প্রোগ্রাম করবো। জনসভা করবো, র্যালি করবো। বিভিন্ন মিডিয়া দিয়ে প্রচার-প্রচারণা বাড়িয়ে তারপর আমরা চূড়ান্ত কাজে নামবো।’
দখল করা এসব জায়গা থেকে সরকার পরে তুলে দেবে কিনা জানতে চাইলে নুরুউদ্দিন জমাদার বলেন, ‘উচ্ছেদ করবে কেন? কারওয়ান বাজারে সরকার পাঁচটা ভবন করেছে, সেখানের ফ্ল্যাট প্রত্যেক সদস্যকে ১০০ বছরের জন্য দিয়েছে সরকার। আমাদেরকে সরকার নিজেই সামনে বন্দোবস্তি দেবে। সরাসরি রেজিস্ট্রি। সেজন্য আমরা এতদিন অপেক্ষা করে আসছি। নয়তো একদিনেই মানুষজন নিয়েই আমরা জমি দখল করে নিতে পারি। সেটা তো করছি না। কেন করছি না জানেন, সরকারের জমি সরকার নিজেই সিদ্ধান্ত দেবে, রেজিস্ট্রি দেবে।’
‘আমাদের সংগঠনের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, মঈন উদ্দিন খান বাদল এমপি, সিটি মেয়র আ জ ম নাছিরসহ ১৫জন আছেন। ৭১ সদস্যের বিভাগীয় কমিটি আছে। কমিটির সেক্রেটারী হাজী আবু তাহের; তিনি কালুরঘাটের কামাল বাজার এলাকার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।’ -দাবি করেন মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সোসাইটি’র চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুউদ্দিন জমাদার।
কমিটির সেক্রেটারী হাজী আবু তাহেরের সাথে যোগাযোগের একটি মুঠোফোন নাম্বার (০১৮১৯ ৩১৬০৯০) দেন নুরুউদ্দিন জমাদার; তবে ওই নাম্বার ফোন করলে শোনা যায়, এই নাম্বারটি আর ব্যবহার হচ্ছে না।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম-৮ আসনের সংসদ সদস্য মঈন উদ্দিন খান বাদল বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সোসাইটি নামে কোনো সংগঠনের সাথে আমি যুক্ত নই। তারা আমার নাম ভাঙিয়ে অপকর্ম করছে হয়তো। আমি এ বিষয়ে কিছুই জানতাম না। এখন খোঁজখবর নেব।’
এ প্রসঙ্গে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সোসাইটি নামে কোনো সংগঠনকে আমি চিনি না। ভণ্ডরা এসব করছে। ধান্ধাবাজির জন্য… সব ফাইজলামি।’
এ ব্যাপারে আ জ ম নাছির উদ্দীনের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। বুধবার সন্ধ্যায় মেয়রের ব্যক্তিগত সহকারী রায়হান ইউছুফ বলেন, ‘মেয়র সাহেব চট্টগ্রামের বাইরে আছেন। এখন যোগাযোগ করা সম্ভব না।’
এদিকে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সোসাইটি’র সদস্যের জন্য আবেদন ফরমে সরকারি লোগো ব্যবহার করা হয়েছে; এতে উল্লেখ আছে, ‘এই সংগঠন রাষ্ট্রীয় সম্পদ।’ ২৩ ধরনের তথ্য চাওয়ার পর ফরমের নিচে লেখা হয়েছে, ‘মহামান্য হাইকোর্টের রায়প্রাপ্ত, তাং ২৬ শে জুন, ২০০০ ইং’; এর পরের লাইনে উল্লেখ আছে, ‘সৌজন্যে হযরত গোলাপ শাহ (রাঃ)’।
সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে এতে লেখা হয়েছে, ‘জাতীয় বীর আলহাজ্ব এম এ সামাদ সরকার।’ ফরমে ঠিকানা দেয়া হয়েছে, ‘৬৭, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, ঢাকা ১০০০’। সেখানে উল্লেখ থাকা মুঠোফোন নাম্বারে (০১৮১৫০০৪৬২৭) যোগাযোগ করলে সংগঠনের কার্যালয়ের স্টাফ পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি ফোন রিসিভ করেন; জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের সংগঠন সরকার অনুমোদিত; রেজিস্ট্রেশন নাম্বার আইভি-৪২। চট্টগ্রামে আমাদের বিভাগীয় কমিটি আছে। জিইসিতে অফিস; মতুর্জা আহমেদ চট্টগ্রামের সভাপতি। তবে ৬০ হাজার টাকায় জমি দেয়ার ব্যাপারটি আমরা জানি না। তারা সরকার থেকে লিজ নিয়ে থাকলে মানুষ তা যাচাই করেই টাকা দেবে, কাগজ ছাড়া মানুষ টাকা দেবে কেন? আজকাল মানুষ এত বেকুব না। জেনেশুনেই কাজ করে।’
এদিকে গত ১৬ মার্চ বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন চন্দ্রনগর এলাকায় চট্টগ্রাম বন্দরের এক কর্মকর্তার জায়গা দখল করতে গিয়ে দুই নারীসহ তিনজন গ্রেফতার হন। এদের মধ্যে শাহিনুর আক্তার নিজেকে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সোসাইটি’র চট্টগ্রাম বিভাগের প্রচার সম্পাদক হিসেবে পরিচয় দেয়। একই সংগঠনের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য পরিচয় দেয় মরিয়ম বিবি।’
এ প্রসঙ্গে বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ‘গ্রেফতারকৃতরা মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সোসাইটি’র পরিচয় দিলেও সে বিষয়ে আমরা আর যাচাই-বাছাই করিনি। তারা ফৌজধারী অপরাধ করায় সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা রেকর্ড করে আদালতে প্রেরণ করেছিলাম।’
এদিকে ‘সহকারী মুক্তিযোদ্ধা’ আখ্যা দিয়ে নানা মানুষকে সনদপত্র দিচ্ছে কথিত মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সোসাইটি। এ সংক্রান্ত একটি সনদ এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ থানার সিন্নিরচর এলাকার মৃত নাজিম আলী মৃধার ছেলে মো. খোরশেদ মৃধার নামে এই সনদ ইস্যু করা হয়। সনদটির নাম্বার দেয়া হয়েছে ১০১৭।
এই সনদে খোরশেদ মৃধার পরিচয় উল্লেখ করে লেখা হয়েছে, ‘একজন সহকারী মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বাংলাদেশের ৭১’ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করিয়াছেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাহার অবদান চির উজ্জ্বল হইয়া থাকিবে। তাহার সর্বাঙ্গীন উন্নতি ও মঙ্গল কামনা করিতেছি।’
যথারীতি সনদে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সোসাইটি’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জাতীয় বীর আলহাজ্ব এম এ সামাদ সরকার।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের কাজ করছেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্ট্রের চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ডা. মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এমনিতেই মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সরকারিভাবে জমি দেওয়ার বিরোধী আমি। সরকারি জমি মুক্তিযোদ্ধারা নেবে কেন? এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সোসাইটি নামের কোনো সংগঠন, সামাদ সরকার ও নুরুউদ্দিন জমাদার নামের কাউকে আমি চিনি না, জানি না। ‘সহকারী মুক্তিযোদ্ধা’ নাম দিয়ে যে সনদ তারা দিচ্ছে তা ভুয়া। ‘জাতীয় বীর’ নামে কোনো খেতাব মুক্তিযোদ্ধাদের নেই। এই প্রতারকদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আমি লিখিত অভিযোগ করবো।’
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. সামসুল আরেফিন বলেন, ‘দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এসব প্রকল্প জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর বাইরে কোনো সংগঠনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে জায়গা দেওয়ার সুযোগ নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ভাঙিয়ে যারা এমন প্রতারণা করছে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব।’