শান্তনু চৌধুরী : কেন এই নিঃসঙ্গতা আমাকে তোমাকে ঘিরে। প্রেমের ক্ষেত্রে সেই নিঃসঙ্গতার জবাব হয়তো সোলস তার গানে গানে জানিয়ে দিতে পারে। কিন্তু করোনাকালের এই নিঃসঙ্গতা কি কেউ জানে? সেই কবে পড়েছিলাম মানুষ নাকি সঙ্গপ্রিয় প্রাণি। সৃষ্টির শুরু থেকে দলবদ্ধ হয়ে বেঁচে থাকতে পছন্দ করে। এভাবে সৃষ্টি হয়েছিল সমাজ, রাষ্ট্র।
কিন্তু এখন করোনার মতো এক ভয়ংকর দৈত্য এসে গ্রাস করতে চায় আমাদের। তাই আজ পৃথিবীতে মানুষের শত্রু এখন মানুষ। তোমার শত্রু আমি, আমার শত্রু তুমি। পালাচ্ছে মানুষ একজন আরেকজনের কাছ থেকে। কারণ যেই হাত এক সময় ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল সেই হাতকেই এখন সবচেয়ে বেশি ভয়। যেই হাত ছুঁয়েছিল বরুণার বুক, সেই হাতে এখন করোনার থোকা থোকা জীবাণু। নিজের হাতকেই সবচেয়ে বেশি অবিশ্বাস এখন।
কবি মহাদেব সাহার মতো করে বললে, ‘আজ বিষাদ ছুঁয়েছে বুক, বিষাদ ছুঁয়েছে বুক মন ভালো নেই, মন ভালো নেই; তোমার আসার কথা ছিলো, তোমার যাওয়ার কথা ছিলো, আসা-যাওয়ার পথের ধারে ফুল ফোটানোর কথা ছিলো সেসব কিছুই হলো না, কিছুই হলো না; আমার ভেতরে শুধু এক কোটি বছর ধরে অশ্রুপাত, শুধু হাহাকার শুধু শূন্যতা, শূন্যতা’।
প্রিয়তমা, এখন ঘরে ঘরে করোনা-আক্রান্ত রোগী। কে কাকে আশা দেবে, কে কাকে ভরসা দেবে এই অবস্থা। নিজেও আক্রান্ত ছিলাম। হয়তো বেঁচে ফিরেছি। কিন্তু যারা এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন তারাই জানেন মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসার যন্ত্রণা বা আনন্দ। বা যারা আরো একটু কঠিন সময় পার করেছেন বা করছেন? প্রিয়জনকে হাসপাতালে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি। বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার কাতরতা। সময়মতো সবকিছু না পাওয়া। বা ধুঁকে ধুঁকে অন্তিম পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়া। এ সবই নির্মম নিষ্ঠুরতা। স্বজনহারানো, প্রিয়জন হারানোর বেদনা এখন প্রতিটি মানুষকে যেন কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। আর যারা বেঁচে আছেন তাদেরও মানসিক কষ্ট এবং উৎকণ্ঠার শেষ নেই। পুরো পৃথিবীই আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত করে রেখেছে করোনা নামের অদৃশ্য শক্তি।
এমন অসুখ আগেও যে আসেনি তা নয়, কিন্তু তা ছিল অনেকটা আঞ্চলিক। বিংশ শতাব্দীতে স্প্যানিশ ফ্লু হয়েছিল, তাতে পাঁচ কোটির মতো মানুষ মারা গিয়েছিলেন। সেটাও কিছু কিছু অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বিশ্ব বাণিজ্যায়ন আর বিশ্বায়নের কারণে সারা পৃথিবী আজ একটিমাত্র দেশে পরিণত হয়েছে। এর সুফলগুলোও আমরা পাচ্ছি। সারা পৃথিবীর সব বিচিত্র ও কাম্য জিনিসগুলোকে আমরা যে রকম উপভোগ করতে পারছি, অতীতে তা পারিনি। সেই সঙ্গে আবার সারা পৃথিবীর রোগ-শোক, দুর্দশা-দুর্দৈবও বৈশ্বিক হয়ে গেছে। গ্রিক শাসক পেরিক্লিস প্লেগে মারা গিয়েছিলেন। সে সময় প্লেগ এথেন্স শহরকেন্দ্রিক ছিল। ৫৮১ সালে ইউরোপে একটা প্লেগ হয়েছিল, যাতে ২০ কোটি লোকের মধ্যে ১০ কোটি লোক মারা গিয়েছিল। কতোটা ভয়াবহ। চাণক্য লিখেছিলেন, শত্রু অদৃশ্য হলে অদৃশ্য হয়েই তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাস্ক পরা, ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, টিকা নেওয়া আপাতত করোনার বিরুদ্ধে অস্ত্র।
এক বছরেরও বেশি সময় হতে চলল করোনার ভয়ে অনেকে গৃহবন্দী। স্কুল কলেজ একপ্রকার বন্ধ। আবার অনেকে নানা কারণে বেরুতে পারছেন না ঘর থেকে। করোনা-আক্রান্ত হলে ১৪ দিনের একাকীত্ব। একা একটা ঘরে থাকা। হয়তো অনেকের কাছে সময় কাটানোর ইন্টারনেট আছে, বই আছে। তবুও প্রিয়জনের স্পর্শ না পাওয়া কতোটা যে কষ্টের সেটা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন।
কোভিড-আক্রান্ত অমিতাভ বচ্চন এক পোস্টে লিখেছিলেন, ‘চোখ ভিজলেও মুছিয়ে দেওয়ার মতো কোনও হাত আমার পাশে নেই। একা থাকার এই ভয়, হতাশা মনে ক্ষত তৈরি করতে পারে যে কোনও সময়’। আসলেই ওই যে বলে মানুষ শেষ পর্যন্ত একাই! তাই মানুষ চিরকাল নিঃসঙ্গ। ফেসবুক বা টুইটারের বন্ধু সংখ্যা এমনকি বাস্তব সমাজে আমাদের পরিচিতজন বা বন্ধুর সংখ্যার ওপরও নিঃসঙ্গতা নির্ভর করে না। কিংবা দিনের কতটা সময় আমরা অন্যদের সংস্পর্শে কাটাচ্ছি সেটাই সব নয়। নিঃসঙ্গতার বিষয়টি ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির বা সমষ্টির সম্পর্কের গুণগত মানের ওপর নির্ভর করে। সঙ্গীর প্রতি, বন্ধুবান্ধবদের প্রতি, সমাজের প্রতি কতটা টান অনুভব করছি, আবেগের জায়গা থেকে কতটা কাছাকাছি বোধ করছি সেটাই হতে পারে নিঃসঙ্গতার পরিমাপক।
জাপানে করোনাভাইরাসে ঘরবন্দী মানুষের নিঃসঙ্গতা বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আত্মহননের প্রবণতা। জাপানে আত্মহত্যার হার অন্য অনেক দেশের তুলনায় এমনিতেই বেশি। মহামারি শুরুর পর এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নড়েচড়ে বসেছে সরকার। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগার সরকার একজন মন্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়েছেন সমস্যা সমাধানের। সুগার মন্ত্রীসভার আঞ্চলিক পুনরুজ্জীবনের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী তেৎসুশি সাকামোতো। তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জনসাধারণের নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে ওঠার উপায় খুঁজে বের করতে। অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এখন তিনি করোনাভাইরাস সংকটের কারণে নিঃসঙ্গতা অনুভব করা মানুষদের সাহায্য করার পদক্ষেপ সমন্বয়ের দিকগুলো দেখাশোনা করবেন। আবার মানুষ যতো বড় হতে থাকে, জনপ্রিয় হতে থাকে। সে কারণে বুদ্ধিমান মানুষ কখনো শেকড়ের টান উপেক্ষা করেন না।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বড় নায়ক হওয়ার পরও নাকি কফি হাউজে যেতেন। ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। সম্প্রতি পড়ছিলাম সমরেশ মজুমদারের ট্রিলজি উপন্যাস ‘কলিকাতায় নবকুমার’। গ্রাম থেকে আসা নবকুমার একসময় ফিল্মস্টার হন কলকাতায় এসে। কিন্তু জনপ্রিয় হতে হতে এক সময় বুঝেন কতোটা নিঃসঙ্গ তিনি। শেষে তাকে সব ছেড়ে দিয়ে গ্রামেই ফিরে যেতে হয়। সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবিটির কথা যদি বলি। ছবিতে ট্রেন যাত্রায় সেই নায়ক সেলেব্রেটি বলেই নিঃসঙ্গ। স্বপ্নে জাগরণে একাকীত্বের ভার তাকে বহন করতে হয়। একসময় জনপ্রিয় লেখক, গায়ক, শিল্পীদের পাশের বাড়ির মানুষ বলেই মনে হতো। এখন তারা দূর আকাশের তারা যেন। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলতেন পথ হাঁটতে না পারলে তিনি কবিতা লিখতে পারেন না।
আনন্দে আবেগে বেদনায় উল্লাসে স্রষ্টার মন আন্দোলিত হওয়া চাই, মানুষের সঙ্গে মিশতেই যদি না পারা গেল তবে মন কেমন করে জাগবে। করোনার প্রথম ধাক্কার সময় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জাফরুল্লাহ চৌধুরী খোলা চিঠি পাঠিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। সেখানে তিনি নিজেকে ‘বোকা’ ও প্রধানমন্ত্রীকে ‘নিঃসঙ্গ’ বলে উল্লেখ করেছেন।
তিনি লিখেছেন, ‘দেশের উন্নয়নের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি কঠিন পরিশ্রম করেছেন, কিন্তু লক্ষ্য থেকে ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছেন, সঙ্গে বাড়ছে আপনার একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতা। দেশের এই কঠিন সময়ে আপনার নিজ দলের পুরোনো সহকর্মী এবং অন্য সকল রাজনীতিবিদদের সঙ্গে নিয়ে আপনাকে অগ্রসর হতে হবে’।
পুলিৎজারজয়ী আমেরিকান লেখক অ্যাডাম জনসন বলেছেন, ‘মা ছিলেন সফল চিকিৎসক এবং পিএইচডি নিয়ে ব্যস্ত। বাবা ছোটখাটো কাজ করতেন চিড়িয়াখানায়। মা-বার বিচ্ছেদের পর আরও কাজের ভেতরে ডুবে গেলেন মা। মায়ের কাছেই থাকতাম। কিন্তু জীবনে তীব্র নিঃসঙ্গতাবোধ। সেই নিঃসঙ্গতা কাটাতেই লেখক হয়েছি। শৈশবে কথা বলার মতো বাসায় কেউ ছিল না বলে এখন যেখানে যাই, সবার সঙ্গে কথা বলি। প্রাচ্যের বড় পরিবারগুলো আমাকে খুব টানে। একটি পরিবারে কত কত মানুষ! খাবার টেবিল ঘিরে অনেকে খাওয়া-দাওয়া করছে, হইচই আর হাসি-ঠাট্টা করছে! এটা ভাবাই যায় না আমাদের পশ্চিমের জীবনে। আজ তাই আমি যেখানেই যাই, আমার পরিবার সঙ্গে নিয়ে যাই। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে আমার পরিবার’।
কিন্তু যতোই নিঃসঙ্গতা অবসাদের দিকে ঠেলে দিক, করোনা থেকে বাঁচতে এর বিকল্প নেই। দূরে থাকাই সমাধান!
শান্তনু চৌধুরী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক