চৈত্র সংক্রান্তি: বাঙালির প্রাণের স্পন্দন


তাপস কুমার নন্দী : পৌরাণিক সূত্রে জানা যায়, রাজা প্রজাপতির দক্ষের সাতাশজন কন্যার চন্দ্রদেবের সাথে বিয়ে হয়। তাদেরই একজনের নাম চিত্রা। চিত্রার নামানুসারে চিত্রানক্ষত্রা এবং চিত্রানক্ষত্র থেকে চৈত্র মাসের নামকরণ করা হয়।

আর চৈত্র মাসের শেষ দিনটিকে বাঙালি চৈত্র সংক্রান্তি হিসেবে উদযাপন করে। এক অর্থে সংক্রান্তি এর ধারণাটি এমন যে কালের আবর্তে অসীমের মাঝে সাঁতরে সূর্য এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে গমন করে, ছুটে চলে সময়, দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর, অবিরাম চলে ক্রান্তির সঞ্চার। অর্থাৎ এক ক্রান্তি বা কিনারা থেকে আরেক প্রান্ত বা কিনারায় যাওয়া। এ দিনকে সূর্য সংক্রান্তিও বলা হয়।

তবে অনেকবেশি ভাববাদী এই চিন্তার পাশাপাশি বছরের শেষ মাস হিসেবে চৈএ’র যাত্রা অনেকাংশে সম্রাট আকবরের বাংলা প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশে ফসল কাটার সময়কে মাথায় রেখে খাজনা আদায়ের বস্তুবাদী চিন্তার সাথে জড়িত বলে অনেকে মনে করেন। আর তাই ধর্ম যাই হোক, কৃষক তার স্বপ্ন পূরণে মেতে উঠে এই উৎসবে।

“যেমন বচন আছে
চৈতে গিমা তিতা,
বৈশাখে নালিতা মিঠা,
জ্যৈষ্ঠে অমৃতফল আষাঢ়ে খৈ,
শায়নে দৈ।
ভাদরে তালের পিঠা,
আশ্বিনে শশা মিঠা,
কার্তিকে খৈলসার ঝোল,
অগ্রাণে ওল।
পৌষে কাঞ্ছি, মাঘে তেল,
ফাল্গুনে পাকা বেল।”

চৈত্র সংক্রান্তিতে বিশেষ খাবার ছাতু, চিড়া, দই, মুড়ি, খই, তিল ও নারিকেলের নাড়ু ইত্যাদি খাওয়ার নিয়ম রয়েছ। তার সাথে দুপুর বেলার খাবারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘চৌদ্দ’ রকমের শাক খাওয়া। এর মধ্যে অন্তত একটি তিতা স্বাদের হতে হবে। যেমন গিমা শাক। চৈত্র মাসে গিমা শাক খেতেই হবে। গ্রাম বাংলায় প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে -“শাক শাক বারো শাক, পাতে দিলে জামাই রাগ”।এখানে বারো শাক বলা হলেও সাধারণত এর চেয়ে বেশি পরিমান শাকও রান্না হয়।

শহুরে ফাস্টফুড অভ্যস্ত মানুষের কাছে অদ্ভুত মনে হবে এতো শাক পাওয়া যায় কিনা। ছোট বেলায় দেখতাম চৈত্র সংক্রান্তিতে মেয়েরা ঘরের পাশে, রাস্তার ধারে, ক্ষেতের আইলে, অনাবাদি জায়গা থেকে শাক তুলতে বের হয়। লক্ষণীয় বিষয় হল আপাত অদরকারি শাক, লতাপাতা যদি বিলুপ্ত না হয়ে থাকে তবে বুঝতে হবে চারপাশের প্রকৃতি ঠিক আছে, অন্যথায় বুঝতে হবে বাস্তুসংস্থান ঠিক নেই।

দ্বিতীয়ত হল শাক তোলার কথা বলা হয়। আমরা শাক কাটি এটি সচরাচর বলি না। এর একটা কারণ হতে পারে গাছটি উপড়ে ফেললে বা কেটে ফেললে প্রাণ বৈচিত্র নষ্ট হবে। কিন্তু যদি চারপাশের প্রাণ ঠিক থাকে তাহলে আগামী বর্ষে প্রবেশ শুভ, পহেলা বৈশাখ শুভ।

তাই বুঝাই যাচ্ছে, চৈত্র সংক্রান্তি আসলে লোকজ জ্ঞানের পরিচয়। এখানে বাংলার জনগোষ্ঠির যাপিত জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গি হয়ে বিরাজ করে সংস্কৃতি।এমনকি বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর কাছে এটি একধরনের লোকজ চিকিসা ব্যবস্থা। তাঁদের জীবনাচরণের বিশ্বাস ঋতু পরিবর্তনের এই সময় বিভিন্ন শাক-সবজি দিয়ে রান্না পাঁচন খেলে পরবর্তী বছরে রোগ-ব্যাধী কম হবে।

দেখা যায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উৎসব বিঝুর দিনে বাড়ীতে টক, মিষ্টি, পাঁচন রান্না করা হয়। এটা আর কিছু নয় এই বিশ্বাস থেকেই যে বছরের শেষ দিন তিতা, মিঠা খেয়ে বছর বিদায় দিলে বিগত বছরের দুঃখ কষ্ট, আনন্দ বেদনা দূর হয়ে যাবে। শুধু তাই নয় সমতলের মতই তারাও দলবেঁধে নৃত্য করে ঘুরে বেড়ায় ও গঙ্গা দেবতার পুজো দেয়। এই পুজোও আসলে সেই কৃষি বা খাদ্য সংগ্রহ প্রক্রিয়ার সাথেই সম্পৃক্ত।

শত শত বছর ধরে এদেশের মানুষের এইযে প্রত্যাশা সেখানে অর্থনীতির একটি বিশাল যোগসূত্র রয়েছে। অর্থনীতির হিসাবে বলতে গেলে, একটি চক্রাকার হিসাবে সকল পর্যায়ে ধর্ম-বর্ণ, গোত্রের ও শ্রেণী-পেশার মানুষ এর সাথে সম্পৃক্ত।

তবে নগর সংস্কৃতির ডামাডোলে চৈত্র সংক্রান্তিকে সর্বজনীন মিলনমেলায় পরিণত করতে যেয়ে পুঁজিবাদী অর্থনীতির করাল গ্রাসে আবহমান গ্রামবাংলার চাষীর যে আনন্দঘন উৎসব আর জীবনাচরণের সাথে মিশে থাকা বিশ্বাস কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। তবে নীলকণ্ঠ শিব যেমন জগতের সব বিষ পান করেও মঙ্গলময় । ঠিক তেমনিভাবে এই উৎসব আপামর বাঙালির জন্য কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে এমনটিই বিশ্বাস।

এটি বাংলার মানুষের শেকড়ের সাথে মিশে থাকা এক উৎসব। এরসাথে মিশে আছে জীবনদর্শন।