ছিনতাই করে ছাত্রদল নেতা, ছাড়িয়ে নিতে থানা ঘেরাও করে যুবলীগ নেতা

শরীফুল রুকন : অভিনব কৌশলে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে চট্টগ্রামে। সাধারণত ভোর ও রাতে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটলেও এখন দিনদুপুরেও এ ঘটনা ঘটছে। ছিনতাইয়ের সব হিসাব পুলিশের নথিতে নেই। এরপরও গত দুই মাসে ছিনতাইয়ের ঘটনায় হয়েছে ২৮টি মামলা।

অভিযোগ রয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মামলা হলেও আসামি গ্রেফতার ও টাকা উদ্ধার হয় না। অন্যদিকে পুলিশ বলছে, ছিনতাইচক্রে প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা জড়িয়ে পড়েছে। এতে ছিনতাইকারীদের পুরোপুরি দমন করা যাচ্ছে না।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের পরিদর্শক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ছিনতাইয়ের প্রাথমিক তদন্তে অনেক সময় দেখা যায়, জড়িতরা বিভিন্ন প্রভাবশালী নেতাদের ছত্রছায়ায় থাকে। দলের কোন পদে না থাকলেও ওই অপরাধীরা নেতাদের ছবি দিয়ে এলাকায় পোস্টার ও ব্যানার ঝুলায়। ফলে নেতাদের সাথে ঝামেলা এড়াতে এ ধরনের মামলার তদন্ত এগিয়ে নিতে চান না অনেক কর্মকর্তা।’

তিনি আরও বলেন, ‘আবার অনেক সময় জড়িতরা গ্রেফতার হয়। তখন ছিনতাইকারীদের ছেড়ে দিতে রাজনৈতিক পরিচয়ধারী লোকেরা তদবিরও করেন। পাঁচলাইশ, কোতোয়ালী ও চকবাজার এলাকায় দলীয় পরিচয় নিয়ে এ ধরনের অপরাধের প্রবণতা বেশি। এসব ঘটনা প্রকাশ করে দিলে পুলিশ ও নেতা দু’পক্ষের জন্য বিব্রতকর হবে।’

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি দিনদুপুরে নগরের কাতালগঞ্জ বৌদ্ধমন্দিরের সামনে পাঁচ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে পুলিশ কর্মকর্তারা দেখতে পান, টাকার ব্যাগ নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে সটকে পড়ছেন চকবাজার থানা ছাত্রদলের সভাপতি নুরুল আলম। এরপর নুরুলকে এক লাখ টাকাসহ গ্রেফতার করে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ। পরে নুরুলকে ছাড়িয়ে নিতে তার ছোট ভাই যুবলীগ নেতা নুরুল মোস্তফা টিনুর নেতৃত্বে প্রায় দুই ঘণ্টা থানা ঘেরাও করে রাখেন ছাত্রলীগ-যুবলীগের একদল নেতাকর্মী।

পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, ছিনতাইয়ের ঘটনায় চট্টগ্রাম নগরীতে ২০১১ সালে মামলা হয় ৬৬টি, ২০১২ সালে ৬৬টি, ২০১৩ সালে ৫৫টি, ২০১৪ সালে ৬৩টি। এর পরের বছর থেকে হঠাৎ করে বেড়েছে ছিনতাই। ২০১৫ সালে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ১২৮টি মামলা হয়েছে; এর মধ্যে ৬৭টি মামলা হয়েছে দ্রুতবিচার আইনে। ২০১৬ সালে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ১২১টি মামলা হয়েছে; এর মধ্যে দ্রুত বিচার আইনে হয়েছে ৬৩টি মামলা। সর্বশেষ চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ২৮টি মামলা হয়েছে; এর মধ্যে ১৫টি মামলা দ্রুতবিচার আইনে।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (জনসংযোগ) আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ছিনতাইয়ের ঘটনাস্থলে অপরাধী ধরা পড়লে দ্রুতবিচার আইনে মামলা হয়। অন্যথায় ছিনতাইয়ের মামলা দায়ের হয়। ছিনতাইয়ের মামলার আসামি ধরতে ও টাকা উদ্ধারে তৎপর রয়েছে পুলিশ। তবে ঘটনা ঘটলেও বেশিরভাগ ভুক্তভোগী মামলা না করায় পুলিশ জড়িত ব্যক্তিদের সহজে শণাক্ত করতে পারে না।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ সূত্র জানায়, গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৯ জন ব্যক্তি। তারা নগরীর খুলশী, চান্দগাঁও, আকবর শাহ, পুরাতন রেলস্টেশন, বিশ্বকলোনি, লালখান বাজার, বাদুরতলা ও সিআরবি এলাকার বাসিন্দা।

এদিকে ছিনতাইয়ের শিকার হলেও পুলিশি ঝামেলা এড়াতে থানায় অভিযোগ করেন না অনেকেই। বেশিরভাগ ছিনতাই হয় হুন্ডির টাকা। এ কারণে ভুক্তভোগীরা থানায় অভিযোগ দেওয়ার সাহস পান না।

বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ‘হুন্ডি ব্যবসায়ীদের প্রতি নজর রেখে হুন্ডির টাকা বহনের সময় সুযোগ বুঝে ছিনতাই করে ছিনতাইকারীরা। কারণ হুন্ডি ব্যবসা এবং হুন্ডির টাকা বহন বেআইনি। ফলে টাকা ছিনতাই হলেও কেউ থানায় অভিযোগ দেন না। এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে কিছু ছিনতাইকারী চক্র।’

চট্টগ্রামের চকবাজারের বাসিন্দা নাছির উদ্দিন বলেন, ‘১০ মার্চ সন্ধ্যায় রিক্সাযোগে বাসায় ফেরার পথে চট্টগ্রাম কলেজের প্রধান গেটের অদূরে চারজন যুবক সালাম দিয়ে কথা বলতে চান। পরে তারা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে মুঠোফোন ও টাকা নিয়ে চলে যান। ঝামেলামুক্ত থাকতে মামলা করেননি। এখন পথে নামলেই ছিনতাই-আতঙ্কে ভুগতে হচ্ছে।’

এদিকে পুলিশের করা তালিকাতেই চট্টগ্রাম নগরের ছিনতাইপ্রবণ এলাকা ১৬০টি। এর মধ্যে অন্তত ২০টি এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটে। পুলিশ বলছে, নগরীর ওয়াসা মোড়, লাভ লেন, নেভাল অ্যাভিনিউ, এম এ আজিজ স্টেডিয়াম, সিআরবি, টাইগারপাস মোড়, কদমতলী, ডিসি হিল, রাইফেলস ক্লাব, শহীদ মিনার এলাকা, সার্সন রোড, আসকার দিঘির পাড়, গণি বেকারি মোড়, রহমতগঞ্জ এলাকা, নিউমার্কেট, বিআরটিসি মোড়, অক্সিজেন রোড এলাকাকে ছিনতাইপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় পুলিশের নজরদারি বাড়ানোর কথা বলা হলেও থেমে নেই ছিনতাই।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে ১০২ জন ছিনতাইকারীর তালিকা তৈরী করা হয়। এরপর তালিকাটি আর হালনাগাদ করা হয়নি। ওই তালিকার কতজন গ্রেফতার হয়েছেন, কতজন জামিনে আছেন, সে তথ্য পুলিশের কাছে নেই।

জানতে চাইলে মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) সালেহ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, ‘ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন। কিন্তু জামিনে বের হয়ে তারা আবার ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ছে। বর্তমানে নগরীকে ১৪৫টি বিটে ভাগ করা হয়েছে। বিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যরা ছিনতাইকারীদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করছেন।’

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ অভিজাত পরিবারের সন্তানেরা ছিনতাইয়ের ঘটনায় গ্রেফতার হচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের কর্মকান্ডে আমরা বিস্মিত হই। সন্তানেরা কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, সে বিষয়ে অভিভাবকদের বিশেষ খেয়াল রাখা উচিত।’