শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ৫ মাঘ ১৪৩১

জীবনের লক্ষ্য সানি লিওন হওয়া

| প্রকাশিতঃ ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২১ | ৮:৪০ অপরাহ্ন

শান্তনু চৌধুরী : শিক্ষক ক্লাসের শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করলেন, বড় হয়ে কী  হতে চাও? নচিকেতার ভাষায় বলতে গেলে, ‘কেউ হতে চায় ডাক্তার, কেউ বা ইঞ্জিনিয়ার, কেউ হতে চায় ব্যবসায়ী, কেউ বা ব্যারিস্টার। কেউ চায় বেঁচতে রূপোয় রূপের বাহার চুলের ফ্যাশন। আমি ভবঘুরেই হবো, এটাই আমার অ্যাম্বিশন।’ মানে জীবনের লক্ষ্য। প্রতিটি মানুষই হয়তো একটা লক্ষ্য নিয়ে এগোতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উপলক্ষ লক্ষ্যকে হারিয়ে দেয়। চাওয়া-পাওয়ার হিসেব মেলে না বলে। এই যেমন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অমলকান্তি চেয়েছিলেন রোদ্দুর হতে।

তার কবিতা বলছে, ‘আমরা কেউ মাস্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল। অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি। সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল! ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর, জাম আর জামরুলের পাতায়, যা নাকি অল্প-একটু হাসির মতন লেগে থাকে।’

কিন্তু কেউ যদি বলেন তার জীবনের লক্ষ্য পর্নস্টার হওয়া। যিনি শুনবেন একটু ধাক্কা খাবেন বৈকি! ছোট্ট বসার ঘর। সাজানো, টিপটপ। এক কোণে গোছানো ডাইনিং টেবিল। কোনও এক রঙিন সকালে সেই টেবিলে বসে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মেয়ে বলল, ‘আমি সানি লিওন হতে চাই।’

প্রিয়তমা, ঠিকই পড়েছ তুমি। যেমন ঠিকই শুনেছিলেন টিনএজার মেয়েটির আঁতকে ওঠা বাবা। দরজায় দাঁড়িয়ে হতবাক মা প্রথমে কী বলবেন বুঝেই উঠতে পারছিলেন না। এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত! মেয়ের অ্যাম্বিশন কিনা ‘সানি লিওন’ হয়ে ওঠা! এ মেয়ে বলে কী? ঠিক এখানেই প্রশ্ন তুলেছেন ভারতের পরিচালক রামগোপাল ভার্মা। সেই পরিচালক যিনি আন্তর্জাতিক নারী দিবসে (৮ মার্চ) টুইট করেছিলেন, ‘আমি চাই পৃথিবীর সব নারী পুরুষদের ততটাই আনন্দ দিন, যতটা সানি লিওন দেন।’

এ নিয়ে তুমুল সমালোচনার ঝড় ওঠে। সেই রামগোপালই এখন প্রশ্ন তুলেছেন, বাড়ির মেয়ে যদি ‘সানি লিওন’ হতে চায়? পর্ন ইন্ডাস্ট্রিকেই বেছে নিতে চায় কেরিয়ার হিসেবে? সেটা কেন কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না কোনও অভিভাবক? এই বিষয়টিকেই তাঁর প্রথম শর্টফিল্মে তুলে এনেছেন রামগোপাল। ফিল্মের নাম ‘মেরি বেটি সানি লিওন বন্না চাহতি হ্যায়’। ইউটিউবে মুক্তি পেয়েছে ছবিটি। শুধু ছবি নয়, এ নিয়ে টেনিস তারকা সানিয়ার টেনিস খেলার একটি মুদ্রার ছবি পোস্ট করেও আলোচনার ঝড় তুলেছেন তিনি। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, শট খেলার সময়ে সানিয়ার পোশাক উড়ে গিয়েছে। সানিয়ার ছবিটির ক্যাপশনে রামগোপালের বক্তব্য ঘিরেও তৈরি হয়েছে নতুন বিতর্ক।

সানিয়ার ছবির নিচে নিজের শর্ট ফিল্ম ‘মেরি বেটি সানি লিওন বন্না চাহতি হ্যায়’ এর বর্ণনা করেছেন স্বল্প কথায়। তুলে ধরেছেন সিনেমার বিষয়বস্তু। রামগোপালের ছবির মেয়েটি ভালো টেনিস খেলতে পারত। কিন্তু মেয়েটির বাবা তাকে টেনিস খেলতে দেবেন না। কারণ টেনিস খেললে মেয়েটির স্কার্ট উঠে গিয়ে শরীরের অন্যান্য অংশ দেখা যাবে। মেয়েটি বাবাকে যুক্তি দেয়, দুনিয়াতে সবাই কিছু না কিছু বিক্রি করছে। মেহনত, বুদ্ধি। আর সানি লিওন বিক্রি করছে তার যৌন আবেদন।

তবে একথা ঠিক আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, সমাজ হয়তো এতোটা অগ্রসর হয়ে উঠতে পারেনি। এছাড়া ব্লু-ফিল্ম বা নীল ছবিতো মারাত্মক বিষয় বলে ধরা হয় এখনো। সেটা ফুটপাত থেকে চটি কেনার যুগ হোক বা হাল আমলে ইন্টারনেট দেখা হোক। আর তার নায়িকা সানি লিওন। একবার বাংলাদেশে সানি লিওন আসার কথা ছিল। এ নিয়ে বড্ড পেরেশান হেফাজতে ইসলামের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। তারা যে কোন উপায়ে সানি লিওনের বাংলাদেশ আগমন ঠেকাতে ছিল মরিয়া। বিমানবন্দর আক্রমণের হুমকিও দিয়েছিল তারা। তবে এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাবেক পর্নতারকা সানি লিওন সম্পর্কে হেফাজত ইসলামের নেতারা কীভাবে অবগত হয়েছিলেন এ সম্পর্কেও প্রশ্ন ওঠেছিল। অনেকেই বলেছিলেন, সানি লিওন কেবল বলিউডের সিনেমাতেই অভিনয় করছেন। পর্নফিল্ম তিনি ছেড়ে দিয়েছেন, তার সে সিনেমার কথাগুলে কেবল পর্ন দর্শকদেরই জানার কথা। হেফাজতে ইসলামের নেতারা কীভাবে সেটা জানেন?

নীল ছবি।  ব্লু-ফিল্ম। পর্ন মুভিকে সাধারণ মানুষ এ ভাবেই ডাকেন। কিন্তু কেন? পর্ন ছবির সঙ্গে নীল রঙের কী যোগ? নানা মুনির নানা ব্যাখ্যা আছে এ নিয়ে। প্রথম দিকে বি-গ্রেড ছবি বা পর্নোগ্রাফিক মুভি দেশের নানা প্রান্তেই স্থানীয় হলগুলোয় দেখানো হত। সেই সময় এই ছবিগুলির প্রচারের জন্য যে পোস্টার ছাপা হতো, সেগুলো থাকত অন্য ছবির পোস্টারের চেয়ে আলাদা। শুধু নীল-সাদা রঙে ছাপা হতো এই পোস্টার। অন্যান্য ছবির থেকে আলাদা করে বোঝাতেই ছিল এই কৌশল। কারও কারও মতে, এই নীল রঙের পোস্টারের থেকেই পর্ন ছবি পরিচিত হয়ে ওঠে ব্লু-ফিল্ম নামে। বিশ্ব জুড়েই পর্ন ছবির রমরমা বাণিজ্য শুরু হয় ভিডিও ক্যামেরা আসার পর। এ দেশেও তাই। ভিএইচএস (ভিডিও হোম সিস্টেম) ক্যামেরা খুবই জনপ্রিয় ছিল ভিডিও যুগের আদিপর্বে। সস্তার এই ক্যামেরা আর সস্তার ক্যাসেট আমজনতার নাগালে এনে দেয় চলচ্চিত্র তোলার সুযোগ। সস্তার পর্ন নির্মাতারাও হাতে চাঁদ পেলেন। রমরমিয়ে তৈরি হতে শুরু করলো ভিডিও পর্নগ্রাফি। কিন্তু ভিএইচএস-এ তোলা ছবির মান ফিল্ম ক্যামেরার মানের ধারেকাছে ছিল না। ইনডোর শুটিংয়ে কম খরচে আলোর ব্যবস্থার কারণে ভিএইচএস-এ তোলা ছবি আরও খারাপ হতো। কিছুটা ব্লুইশ বা নীলচে ভাব থাকতো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই।

অনেকের মতে, এই থেকেই জনপ্রিয় হয়েছে ব্লু-ফিল্ম শব্দটা। ফিল্মের কাছাকাছি না হলেও, পরবর্তীতে ইউম্যাটিক বা বিটাক্যাম ভিডিও ফরর্ম্যাটে ছবির গুণগত মান বেড়েছে। নীলচে ভাব কমেছে। কিন্তু ব্লু ফিল্ম নামটা ততদিনে প্রতিষ্ঠিত। কেউ কেউ অবশ্য ব্লু ফিল্মের নামের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে আরও পেছনে যাওয়ার পক্ষপাতী।

১৯৬০-এর দশকে যখন বিদেশে ‘গোল্ডেন এজ অফ পর্ন’ সূচিত হচ্ছে, তখন বেশির ভাগ ছবিই ছিল অত্যন্ত স্বল্প ব্যয়ে নির্মিত। প্রধানত সাদা-কালোয় ছবি শুট করে তাতে রঙয়ের বিভ্রম সৃষ্টির জন্য একটা নীল টিন্ট দেওয়া হতো। সেই থেকেই এমন নাম বাজারে চালু হয় বলে অনেকের মত। সস্তায় ছবি নির্মাণের জন্য পরিচালকরা অনেক সময়েই কম দামে ছাঁটাই রিল কিনতেন। সেই রিল-এ তোলা ছবি রঙিন হলেও তাতে নীলচে একটা ভাব থেকে যেত। সেটাই ব্লু ফিল্ম নামের কারণ বলে অনেকে মনে করেন।

অন্য গল্পও প্রচলিত আছে নীল ছবিকে ঘিরে। ছবির খরচ কমাতে নির্মাতারা যে ছাঁটাই রিল কিনতেন, বিক্রেতারা সেগুলির বিশেষত্ব বোঝাতে নাকি নীল রঙয়ের চিহৃ দিয়ে রাখতেন। এ ছাড়া ক্যাসেটের দোকানে পর্নগ্রাফির ক্যাসেট আলাদা করে রাখতে তা নীল প্যাকেটে রাখার বিধি ছিল। সেই থেকেও পর্নগ্রাফির নীল ছবি নাম হতে পারে বলে মনে করেন অনেকে। ডিজিটাল ফরম্যাট চলে আসার পর ফটোগ্রাফির দুনিয়ায় বিপ্লব ঘটে গিয়েছে। অনেক সস্তায় ভালো মানের ঝকঝকে ছবি এখন হাতের ফোনেই তুলছেন আমজনতা। পর্ন মুভিতেও এখন অনেক উন্নত মানের ছবি। কিন্তু অতীতের নীলচে তকমাটা এখনও লেগেই রয়ে গেছে এর গায়ে।

শান্তনু চৌধুরী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক