মহান একুশে’র মর্মার্থ জাগর চেতনার নবায়ন

আবু মুসা চৌধুরী : চেতনার চির-স্ফুলিঙ্গ অমর একুশে প্রতিনিয়ত আমাদের সকল সংকট, সংগ্রাম, দ্রোহে আলোকের প্রোজ্জ্বল বর্তিকা হয়ে বার বার ফিরে ফিরে আসে। ‘একুশে মানে মাথা নত না করা’- এই অমোঘ মন্ত্র এই জনজাতির রক্তস্নাতে, আন্তঃপ্রবাহে বিরাজিত সত্য। পলাশ-শিমুল, কৃষ্ণচূড়ার রঙের বন্যায় প্লাবিত নিসর্গের বাসন্তিক রূপেও যেন ভাই হারানোর রোদন-বেদনা বাতাস বিদীর্ণ করে। এই ফাগুন-মর্মার্থই যেন শোক আর শক্তির সমন্বয়।

সালাম-রফিক-বরকত-জব্বারের রক্তস্নাত একুশে যদিও প্রায় ৭ দশক পরও নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত, তবুও, ৫২-’র চেতনালব্ধ আমাদের মাতৃরূপ বাংলাভাষার বিশ্বজনীন প্রতিষ্ঠা, মানে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালন জাতিসংঘ কর্তৃক নিঃসন্দেহে সকল বাঙালির জন্যেই শ্লাঘার বিষয়।

আমরা জানি – বাংলা ভাষা পৃথিবীর মধ্যে ৭ম স্থান অধিকার করে আছে। আমাদের বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামসহ সারা পৃথিবীতে ছড়ানো প্রবাসী বাংলাভাষীরা, এই ভাষার মহিমা বহন করছেন আবিশ্ব। ওপার বাংলায় হিন্দির আগ্রাসনে কুপোকাৎ হওয়ার কারণে আজ সারা কলকাতায় দোকানগুলোয় বাংলা সাইনবোর্ড দুর্লভ। নতুন প্রজন্ম ইংরেজি ও হিন্দি লিখন-পঠন-কথনে-শ্রবণে যতোটুকু সিদ্ধহস্ত, ততোটা দূর নির্বাসনে আমাদের প্রাণের ‘আ-মরি বাংলা ভাষা।’ এজন্যেই প্রখ্যাত কবি ও লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন, আগামীতে বাংলা ভাষার রাজধানী হবে কলকাতা নয়, ঢাকায়।’

এ উক্তি শতভাগ সত্য। কিন্তু তবুও প্রশ্ন থেকে যায়। ঔপনিবেশিক চাপিয়ে দেওয়া জগদ্দল ইংরেজি ভাষা এবং এর আগ্রাসন আজ রূঢ় ও অপ্রিয় সত্য, বাস্তবতা। যদিও এই সময়ের গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়নের কারণে সমস্ত পৃথিবী ‘বিশ্বগ্রাম’ অভিধায় অভিহিত এবং মার্কেট ইকোনমি, কর্পোরেট বাণিজ্য ইত্যকার অভিঘাতে প্রাণের ভাষা বাংলাটাও আজ অসহায়, নাজুক।

দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমাদের প্রিয় এই শৈল-শহর চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ইংলিশ মিড়িয়ামের একটি কেতাদুরস্ত নামকরা কিন্ডারগার্টেনে নক্ষত্রের মতো জলজ্বল করে বিরাজ করছে একটি সাইনবোর্ড- ‘এখানে বাংলায় কথা বলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’

ইচ্ছে হয় বলি- হে মা বসুন্ধরা, বিদীর্ণ হও। ওই জ্বালাতপ্ত মনে-প্রাণে প্রশান্তির প্রলেপ লাগানোর নিমিত্তে তোমার বুকেই প্রবিষ্ট হই। আমরা এমনই অদ্ভুত জাতি। রফিক-জব্বার-সালাম-বরকতের অতৃপ্ত আত্মা কি কবর থেকে ওঠে আসবে? এদের জন্যেই বুঝি মধ্যযুগে আমাদের সন্দ্বীপের কবি আবদুল হাকিম লিখেছিলেন-

যে জন জন্মে বঙ্গে
হিংসে বঙ্গবাণী,
সে জন কাহার জন্ম
নির্ণয় ন-জানি।

তো, কবি রচিত চরণের প্রেক্ষিতে তাহাদের বেজন্মা নামে নিঃসন্দেহে আখ্যায়িত করা যায়। এরাই তো ময়ূরপুচ্ছধারী কাকের দল। এই কিসিমের বাঙালি (?) ভাইদের জন্যেই হয়তো আজ সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন নিছক কথার কথা হয়েই থাকলো। বাস্তবতার মুখ দেখলো না। এর প্রায়োগিক রূপ এখনো দূর অস্ত। এই সেদিন মাত্র আদালতের রায় বাংলাভাষায় লেখার পরিপত্র জারি করা হয়েছে, তার কি যথার্থ প্রয়োগ হচ্ছে?
‘এক একটি বাংলা বর্ণ এক একজন বাঙালির প্রাণ’- এই স্লোগান আজ কেবল ফাঁকা বুলি, নিষ্প্রাণ উচ্চারণ। বাংলাভাষাকে নির্বাসনে পাঠাতে পারলেই যেন কেউ কেউ বাঁচে। ‘আ-মরি বাংলাভাষা’- তাদের গাত্রদাহের কারণ। প্রতি বছর একুশে এলেই আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। আমি কি ভুলিতে পারি। ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রুগড়া এ ফেব্রুয়ারি। আমি কি ভুলিতে পারি…।

প্রাণ-মন অবশ করে দেওয়া এই অমর গান কণ্ঠে নিয়ে, লাখো মানুষের নগ্নপায়ে প্রভাতফেরির সপুষ্পক শোকার্ঘ্য নিবেদন হয়তো এখন যান্ত্রিক ও আনুষ্ঠানিকতার পর্যায়ে।

তবুও দেশ ও জাতির কখনো কোনো দুঃসময়ে ক্রান্তিলগ্নে- তা হোক সামরিক উর্দিপরা স্বৈরশাসকের একদলীয় ক্ষমতা দখল, অথবা অগণতান্ত্রিক, মৌলবাদী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী কোনো বেগম সাহেবার দুঃশাসন; সর্বক্ষেত্রেই একুশের চেতনা অগ্নিমশাল হয়ে সমস্ত অপচ্ছায়া বা দমন-পীড়ন-নির্যাতনের প্রতিপক্ষ হয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম-বিস্ফোরণের সলতে জ্বালানোর বিস্ফোরক উৎস হয়ে আবির্ভূত হয়েছে- তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। আমরা বজ্রকণ্ঠে গেয়ে উঠি- ‘একুশ আমার… হৃদয়ের চেতনায় একুশ আমার’। স্মৃতির মিনার ভেঙে দিলেও, কোটি পরিবারের জেগে থাকার উদ্দীপনা-সংগীত একুশে ফেব্রুয়ারি, মহান ভাষা দিবস বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

আমরা সেই গর্বিত জাতি, যারা ভাষার জন্যে রক্ত দিয়েছে। পৃথিবীতে এরকম আর কোনো দৃষ্টান্ত নেই। একুশের সংগ্রামী চেতনার পথ বেয়েই বাঙালির যাবতীয় অর্জন। ৬২’র ছাত্র আন্দোলন, ৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান, ৭৫-এর রক্তাক্ত ট্রাজিডি- সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ড- তৎপরবর্তী দুঃশাসন এবং এর বিরুদ্ধে জন আন্দোলনের বিস্ফোরণ- সমস্ত কিছুর উৎস বা বীজতলা একুশের চেতনা।

বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা। আমাদের আত্মার আলো, আমাদের অহংকার। কেবল মাতৃভাষাকে বাহন করে পৃথিবীতে অনেক জাতির উন্নতির-এগিয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। চীন ও জাপানের দিকে চোখ রাখলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। আমরা এমন দুর্ভাগা জাতি, মাতৃভাষাকে দূরে ঠেলে, ঘৃণা করে এই নব্য পুঁজিবাদী বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে চাই। এখনকার সাম্রাজ্যবাদ কেবল আর্থ-সামাজিক আগ্রাসন নয়, নগ্ন ভাষাগ্রাস মিশনেও তৎপর। এর ফসল হিসেবে হিন্দি সিরিয়ালের পর্বতপ্রমাণ জনপ্রিয়তা এবং আমাদের সমাজব্যবস্থায় এর নেতিবাচক প্রভাব দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।
আমরাও কি নিজেরা কম অপরাধী?

বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে ‘বাংলিশ’ চর্চা হালের লোকপ্রিয় বাতিক। আর আঞ্চলিকতার নামে প্রমিত বাংলার ওপর বলাৎকারও আমাদের এখানকার টিভি নাটকের সংলাপে সহ্য করতে হচ্ছে। এর পরিণতি নিশ্চয়ই জগাখিচুড়ি, দো-আঁশলা এক বিকৃত ভাষা। এ থেকে উদ্ধারের নিমিত্তে কেবল শুভচেতনা আবশ্যক। কবে কোন্কালে আমাদের মধুকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বেদনামথিত উচ্চারণ করেছিলেন প্যারিসের ভার্সাই নগরীর দূর প্রবাস থেকে-

‘হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন,
তা সবে অবোধ আমি অবহেলা করি
পরধন লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ,
পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি.. ‘

কবির এই সত্যগাথা এখনো প্রাসঙ্গিক। তাই মহান একুশের মর্মার্থ হোক বাংলা ও বাঙালির জাগর চেতনার নবায়ন।

আবু মুসা চৌধুরী কবি-সাহিত্যিক