শরীফুল রুকন : ‘আইন পেশায় এসেছি ২২ বছর। এই সময়ে প্রায় ২২ হাজার মামলা করেছি বিনামূল্যে। সব তথ্য রেজিস্ট্রারে সংরক্ষণ করা আছে। মানুষের জন্য কাজ করার চেষ্টারই অংশ এটি। মানবতাবোধ সমুন্নত রাখার তাগিদ থেকেই মূলত এ কাজ। অসহায়, দরিদ্র, ঠিকানাহীন মানুষের জন্য কাজ করার মধ্যে একটা তৃপ্তি আছে। আমার কাছে এটাই জীবন।’
অকপটে এসব কথা বলছিলেন ‘শেল্টার ওমেন’ হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের আইনজীবী তুতুল বাহার। বাঙালি নারীর মতোই তিনি সহজ-সরল ও মার্জিত। কিন্তু তার কিছু বিশেষ গুণ আছে। তিনি সংগ্রামী, পরোপকারী এবং পরিশ্রমী। অসহায়, দরিদ্র ঠিকানাহীন মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারলেই তার আনন্দ। অসংখ্য অসহায়ের সহায় হয়েছেন। তাদের দেখাচ্ছেন সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন।
ঘটনাটা গত ১৫ জানুয়ারির। শৈত্য প্রবাহের দিনে নগরের চাকতাই লোহার পুলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তুতুল বাহার। শুনতে পেলেন রাস্তার পাশে পড়ে থাকা এক বৃদ্ধার গোঙানির শব্দ। এরপর মরিয়ম নামের এক নারীর বাসায় অসুস্থ ওই বৃদ্ধাকে নিয়ে যান তিনি। এরপর দেখা যায় ওই বৃদ্ধার শরীরের একপাশ অবশ। নিজের নাম ‘আনু’ বলতে পেরেছেন শুধু। ১৮ জানুয়ারি আনুকে নেয়া হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগে। কিন্তু সেখানে পায়খানা-প্রস্র্রাবে একাকার করে ফেলেন আনু। এরই এক ফাঁকে বিভাগের বাইরে নাজমা নামে এক গৃহবধূকে কাঁদতে দেখেন তুতুল বাহার। কাঁদার কারণ জিজ্ঞেস করতেই স্বামীর মারধরের শিকার হয়ে কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামে আসার কথা জানান নাজমা। শেষ পর্যন্ত খাওয়া-পরার বিনিময়ে নাজমাকেই রাখা হয় আনুর দেখভালের জন্য।
মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চতুর্থ তলায় সার্জারি ওয়ার্ডের বারান্দায় গিয়ে দেখা যায়, আগের চেয়ে কিছুটা সুস্থ বৃদ্ধা আনু। তবে অনেক চেষ্টার পরও তার সাথে কথা বলা যায়নি। আনুকে দেখভালের দায়িত্বে থাকা নাজমা জানালেন, পরিবারের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে আনু তাকে জানিয়েছেন; সোহাগ, শরীফ ও সুলতান নামের তার তিন ছেলে রয়েছে। এর মধ্যে ছোট ছেলে সুলতান মারা গেছে বলেও ‘ইশারায়’ ইঙ্গিত দেন। স্বামীর নাম মৃত সালাম বলেও জানান। গ্রামের বাড়ির বিষয়ে কোন সময় সিরাজগঞ্জের দায়িরগাঁ ও বিলুনিয়া এবং কোনো সময় ময়মনসিংহের গফরগাঁও এবং খুলনার কথা বলেন।
এ প্রসঙ্গে তুতুল বাহার বলেন, ‘রাস্তায় চলতে চলতে হঠাৎ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন আনু। তার যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ঔষধপত্র ও সিটি স্ক্যান বাবদ ৬০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে। গত ১০ ফেব্রুয়ারি হাসপাতাল থেকে তাকে ডিসচার্জ করা হয়েছে। এখন তার জায়গা হয়েছে হাসপাতালের বারান্দায়। কিন্তু এখনো তার স্বজনদের খোঁজ পাচ্ছি না। এভাবে কতদিনইবা রাখতে পারবো আমি জানি না।’
নগরের পাঁচলাইশে এক তরুণীকে চার বছরে অসংখ্য মানুষের সাথে অসামাজিক কার্যকলাপ করতে বাধ্য করেন নিজের বাবা-মা, মামা ও দুই গৃহশিক্ষক। এ ঘটনায় ২০১৩ সালের ১৫ মে আদালতে মামলা দায়েরের পর জুডিশিয়াল তদন্তে ঘটনার সত্যতা মিলে। ওই তরুণীকে বিনামূল্যে আইনী সহায়তা দিয়ে আসছেন তুতুল বাহার।
৯ বছর বয়সে বরিশালের তরুণী নাছিমা চট্টগ্রামে আসেন। কীভাবে এসেছেন মনে করতে পারেননি নাছিমা। এরপর নগরের বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে কেটেছে আরো ৯ বছর। ৭ মাস ছিলেন ফরহাদাবাদের সরকারি হেফাজত কেন্দ্রে। সেখান থেকে জিম্মায় নিয়ে স্বজনদের খুঁজে বের করে নাছিমাকে তুলে দেন তুতুল বাহার।
বাবা-মা হারানো কিশোরগঞ্জের তরুণী জেসমিনকে ২০০৬ সালে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে কুমিল্লায় এনে বিক্রি করে দেয় সাঈদ। ১৮ হাজার টাকায় বিক্রির পর অন্ধকার জগতে বসবাস জেসমিনের। ২০০৮ সালে সেখান থেকে পালিয়ে চট্টগ্রামে চলে আসেন জেসমিন। এরপর কোতোয়ালী থানা পুলিশ তাকে আদালতের মাধ্যমে হেফাজত কেন্দ্রে পাঠায়। দীর্ঘ পাঁচ বছর সেখানে থাকার পর ১৮ বছর বয়সী জেসমিনকে জিম্মায় নেন তুতুল বাহার।
২০০৮ সালে জাকির হোসেনকে ভালোবেসে বিয়ে করেন চন্দনা। ধর্মান্তরিত হয়ে চন্দনা হয়ে যান জেসমিন আক্তার। কোল জুড়ে আসে দুই সন্তান। বসবাস করতেন নগরীর চেয়ারম্যানঘাটা আবদুল হালিম কলোনী। ২০১১ সাল থেকে জেসমিনের উপর শুরু হয় নির্যাতন। স্বামী ঢুকে পড়েন নেশার জগতে। জাকিরের বড় ভাই জামাল জেসমিনের বড় ছেলে জাহেদকে বিক্রি করে দেন। ২০১৬ সালের শুরুতে আবারও অন্ত:স্বত্তা হয়ে পড়েন জেসমিন। এ অবস্থায় জাকির ও জামাল দুইজনেই তাকে ফেলে চলে যায়। ভাড়া বাকি থাকায় বাসার মালিক তাকে বের করে দেয়। খবর পেয়ে এগিয়ে যান অ্যাডভোকেট তুতুল। থানা পুলিশ ও আদালত ঘুরে মনসুরাবাদস্থ নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলে তাকে দিয়ে আসেন ২৩ জুন। কঠিন বাস্তবতায় ২৪ জুলাই নবজাতকের জন্ম দেন জেসমিন। সেই থেকে ওই নারীর দায়িত্ব নিয়েছেন তুতুল বাহার।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের কর্মকর্তা এরশাদুল ইসলাম বলেন, ‘অ্যাডভোকেট তুতুল বাহার প্রায় ৬ বছর আমাদের প্যানেল আইনজীবী ছিলেন। এই সময়ে তিনি বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া দূরের কথা মামলার খরচ বাবদ সরকারি টাকাও গ্রহণ করেননি।’
পাচার হয়ে যাওয়া ও বাবা-মা হারানো অনেক শিশুকে আদালতের মাধ্যমে দত্তক নেয়া অ্যাডভোকেট তুতুল বাহার বিয়ে করেননি। নগরের পাঁচলাইশের বাদুরতলা এলাকার বাসায় রেখে অন্যের সন্তানকে ‘মানুষ’ করার কঠিন সংগ্রামে অবতীর্ণ তুতুল বাহার। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বেশ কয়েকজনকে বড় করে বিয়ে দিয়েছি। তারা নিজেরা কর্মজীবনে প্রবেশ করে সংসারী হয়েছে। এখনও কয়েকজন আছে, যাদেরকে স্কুলে পড়াচ্ছি। তবে তাদের নাম প্রকাশ করতে চাই না।’
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি রতন কুমার রায় বলেন, ‘মানবসেবায় অনন্য নজির স্থাপন করেছেন অ্যাডভোকেট তুতুল বাহার। রাস্তার লোক নিয়ে বাসায় যায়, খেতে দেয়, থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। অথচ তেমন বিত্ত, সামর্থ্য নেই। অসহায়, নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারলেই আনন্দ পান তিনি। তিনি যা করেছেন, তার তুলনা নেই। তবে একজন হলে হবে না, আমাদের আরো অনেক তুতুল বাহার প্রয়োজন।’