তোমার কুকুর ‘টমি’ আমার কুকুর ‘কুত্তা’


শান্তনু চৌধুরী : কয়েক দিন আগে এক ভদ্রলোক বলছিলেন, তার তিনটি কুকুর ‘গুম’ হয়ে গেছে। আশ্চর্য কথা! কুকুর তো ‘অমুক নেতা’ বা ‘তমুক সন্ত্রাসী’ না যে গুম হবে! কিন্তু তার কথায় মনে হলো ঘটনা সত্য। তিনি বলছিলেন, তিনি পাঁচটি কুকুরকে রোজ খেতে দিতেন। সপ্তাহখানেক ধরে তাদের মধ্য থেকে তাঁর ‘টাইগার’ ও ‘বাহুবলী’ খেতে আসছে না, দেখছেন না আরেকটিকেও। এমন ঘটনা ঘটেছে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের লোকজন কুকুর ধরে নিয়ে যাওয়ার পর।

এ নিয়ে রাজধানীতে পক্ষে-বিপক্ষে মানববন্দনও হয়েছে। কুকুরের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় কেউ কেউ বিরক্ত আবার কুকুর নিধন বা কুকুরকে গুম করে ফেলার বিপক্ষে অনেকে। তবে একথা ঠিক যে প্রভুভক্তির দিক দিয়ে কুকুরের তুলনা মেলা ভার। আবার কুকুর নিয়ে বিভিন্ন ভিডিও যেমন ভাইরাল হয়, তেমনি কুকুরের আয়েশী জীবনের কথাও নানা সময় সংবাদ শিরোনাম হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান নিবাসী কুকুর টাকার বুদজেনকে পাওয়া যাবে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, টিকটক, ইউটিউবসহ প্রায় সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কখনো তাকে দেখা যায় সিংহ সাজতে, কখনোবা আয়েশি ঢঙে গরুর মাংস খেতে। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে গানের তালে তালে ফ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে তার চুল ওড়ানোর ভিডিওগুলো। টাকারকে ইনস্টাগ্রামে অনুসরণ করে ২৬ লাখেরও বেশি মানুষ। এই কুকুরের মালিক কোর্টনি বুদজেন।

আবার যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকি শহরের কথাই যদি ধরি, সেখানকার মেয়র একটি কুকুর। নাম উইলবার। বয়স ৬ বছর। এটি একটি ফ্রেঞ্চ বুলডগ। কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া নির্বাচনে আগামী চার বছরের জন্য মেয়র হয়েছে সে। কুকুরটিকে কেন্টাকি অঙ্গরাজ্যের র‌্যাবিট হ্যাশ শহরের মেয়র পদে নির্বাচিত করা হয়েছে। উইলবারের মুখপাত্র অর্থাৎ তার মালিক এমি নোল্যান্ড এনবিসিকে জানান, পাঁচশর কম অধিবাসীর ছোট্ট এই শহরে কখনই কোনো মানুষকে মেয়র পদে বসানো হয়নি। ১৯৯০ সাল থেকে এই চল সেখানে। ১৯৯০ সালে র‌্যাবিট হ্যাশ শহরে প্রথম যে কুকুরটি মেয়র নির্বাচিত হয় তার নাম গুফি। এরপর ৫ বার ওই শহরে কুকুরের নেতৃত্বকে বরণ করা হয়েছে।

এতো গেল বিখ্যাত কুকুরের গল্প। আবার বিখ্যাতদের কুকুরও সংবাদ শিরোনাম হয়। তাদের সুখে-দুঃখেও রাজা বাদশারা হাসেন কাঁদেন। ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রিয় কুকুর মারা গেছে বলে জানিয়েছে ট্যাবলয়েড পত্রিকা দ্য সান। ডর্গি প্রজাতির ভালকান নামের এই কুকুরটি উইন্ডসর প্রাসাদে মারা যায়। এর ফলে ব্রিটিশ রানির কাছে আর মাত্র একটি ডর্গি থাকলো। সেটির নাম ক্যান্ডি। প্যালেসের একটি সূত্র সংবাদপত্রটিকে জানিয়েছে, প্রিয় পোষা প্রাণি হারিয়ে স্পষ্টত হতাশ হয়েছেন রানি। এতো সাধারণ মৃত্যু। কিন্তু পোষা প্রাণিকে যদি উপকারের প্রতিদান এভাবে দিতে হয় তবে সেটি কতোটা হৃদয়বিদারক।

শুনুন তাহলে গল্পটি- অনেক অনেক কাল আগে উত্তর ওয়েলসের বেডগেলার্ট নামে একটি গ্রামে লিওয়েলিন নামে এক রাজপুত্র ছিলেন। তারই পোষা কুকুরের নাম গেলার্ট। মনিবের জন্য সর্বদা নিজের জীবন দিতেও প্রস্তুত থাকতো গেলার্ট। আর তাই তো রাজপুত্র কখনও তাকে কাছছাড়া করতেন না, করতেন অসম্ভব আদর। গেলার্টকে ইংল্যান্ডের রাজা জন লিওয়েলিনকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। লিওয়েলিনের অবশ্য আরও অনেক কুকুর ছিল, কিন্তু রাজার দেওয়া এই হাউন্ডটি কেন যেন তিনি অনেক বেশি পছন্দ করতেন। রাজপুত্র ছিলেন খুব ভাল মাপের একজন শিকারি। শিকারে যাওয়ার সময় কখনোই গেলার্টকে রেখে যেতেন না। প্রতিটি শিকারে যাওয়ার সময় তিনি বিশেষ এক ধরনের ভেঁপু বাজাতেন, আর সেই শব্দে তার সবগুলো কুকুর বুঝে ফেলত যে, এটি শিকারে যাবার সংকেত। তৎক্ষণাৎ সবাই ছুটে আসতো, সেই সাথে গেলার্টও।

যে দুর্ভাগ্যজনক দিনটির কথা বলছি, সেদিনও রাজপুত্র শিকারে যাওয়ার জন্য ভেঁপুতে আওয়াজ করেন। সেই আওয়াজ পেয়ে তার সব কুকুর ছুটে এল, কিন্তু কেন যেন গেলার্ট ভেঁপুর আওয়াজ খেয়াল করতে পারলো না। রাজপুত্র খানিকক্ষণ তাকে এদিক-ওদিক খুঁজে মন ভার করে তাকে ছাড়াই শিকারে চলে গেলেন। প্রাসাদে রয়ে গেল তার স্ত্রী ও এক বছর বয়সী ছোট্ট ছেলে। শিকার শেষে রাজপুত্র সন্ধ্যায় প্রাসাদে ফিরলেন। সবার প্রথমেই গেলার্ট তাকে স্বাগত জানাতে দৌড়ে এল। হঠাৎ রাজপুত্র খেয়াল করলেন, গেলার্টের সারা শরীরে আঁচড়ের চিহ্ন।

চোয়াল রক্তমাখা, লাল টকটকে তাজা রক্ত ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ছে দাঁত বেয়ে নিচে। গেলার্ট মহা উত্তেজিত আর উৎফুল্ল। অজানা আশংকায় রাজপুত্রের মন ভারি হয়ে গেল, তিনি দৌড়ে নিজ কামরায় এলেন, গেলার্টও তাকে অনুসরণ করল। কামরায় এসে তিনি আঁতকে উঠলেন। তার ছোট ছেলেটির বিছানা উলটানো, সমস্ত কামরা লণ্ডভণ্ড। কিন্তু ছোট বাচ্চাটির কোনো চিহ্নই নেই কোথাও। রাজপুত্র গেলার্টের দিকে তাকিয়ে ভয়ঙ্কর রেগে উঠলেন। নিশ্চয়ই তার অনুপস্থিতিতে জানোয়ারটা তার বাচ্চাকে মেরে ফেলেছে, হয়তো খেয়েও নিয়েছে।

আর দেরি করলেন না, খাপ থেকে তলোয়ার বের করে তিনি উৎফুল্ল গেলার্টের হৃৎপি- বরাবর তীক্ষ্ম তলোয়ারটি ঢুকিয়ে দিলেন। পুরো সময়টা গেলার্ট অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মনিবের দিকে। গেলার্ট যখন কাতর শব্দ করতে করতে মৃতপ্রায়, ঠিক তখন রাজপুত্র কোথায় যেন বাচ্চার একটি আওয়াজ শুনতে পেলেন। কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে তিনি ছেলের বিছানাটি সরিয়ে দেখলেন, তার ছেলে হাসিমুখে শুয়ে আছে। আর ছেলেটির পাশেই বিশাল বড় এক নেকড়ে রক্তাক্ত অবস্থায় মরে পড়ে আছে। ঘটনাটি বুঝতে রাজপুত্রের এক মুহূর্তও দেরি হল না, তিনি বুঝলেন গেলার্ট আসলে নেকড়েটিকে মেরে বাচ্চাটিকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। আর সেই ঘটনাটি দেখাতেই মনিবের কাছে দৌড়ে গিয়েছিল সে। রাজপুত্র ছুটে গেলেন গেলার্টের কাছে, কিন্তু ততক্ষণে সে তার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে ফেলেছে।

প্রিয় কুকুরকে নিজ হাতে হত্যা করে রাজপুত্র শোকে প্রায়পাগল হয়ে গেলেন। তারপর ভগ্ন হৃদয়ে গেলার্টের মৃতদেহ তার রাজ্যের সবচাইতে উঁচু জায়গায় সমাধিস্থ করলেন, যাতে সবাই তার এই বিশ্বস্ত কুকুরের কথা জানতে পারে। এরপর থেকে গেলার্ট মানুষের মনে ও গল্পে স্থান করে নিয়েছে। যেমনটি মানবশিশুকে স্তনপান করিয়ে মনে স্থান করে নিয়েছে আরো একটি কুকুর। দুবছরের সন্তানকে একা রেখে চলে গিয়েছিল মা। খিদের জ্বালায় ঘরের বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল সেই দু’বছরের সন্তান। ছোট্ট শিশুর কান্না মন ছুঁয়ে যায়নি কোনও মানুষের। সবাই অবহেলা করলেও সে অবহেলা করতে পারেনি। হতে পারে সে কোনও মানুষ নয়, আসলে একটা কুকুর।

কিন্তু মানবিকতা যেখানে শেষ হয়, সেখান থেকেই অনেক সময় দেখা যায় অবলা জীবরা তাদের স্নেহ-ভালবাসার ছাপ রাখা শুরু করে। সেই কুকুরটি আবার ক’দিন পরেই মা হতে চলেছে। হবু সারমেয় মা বুকে টেনে নেয় মানুষের সন্তানকে। কুকুরটি নিজের বুকের দুধ খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখে সেই দু’বছরের শিশুটিকে। ঘটনাটি ঘটেছে চিলির রাজধানী স্যান্টিয়াগো থেকে ১,২৪০ মাইল দূরে। কিন্তু এসব ঘটনা হয়তো এক সময় হারিয়ে যাবে, কিন্তু হারাবে না মের্কেলের কাছে পুতিনের কুকুর নিয়ে যাওয়ার গল্পটি।

২০০৭ সালে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেলের সঙ্গে এক সংবাদ সম্মেলনে কুকুর নিয়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। একটি জার্মান গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পুতিন জানিয়েছেন, নয় বছর আগের ওই বৈঠকে তিনি মের্কেলকে কুকুরের ভয় দেখাতে চাননি। পুতিন বলেন, ‘আমি তার জন্য মজার কিছু করতে চেয়েছিলাম। তবে যখন জেনেছি, তিনি কুকুর ভয় পান, তখন আমি তার কাছে ক্ষমা চেয়েছি।’ ১৯৯৫ সালে একবার কুকুরের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন জার্মান চ্যান্সেলর। মূলত এরপর থেকেই তিনি কুকুরকে বেশ ভয় পান। কুকুরকে আমিও বেশ ভয় পাই। তবে সেটি যদি ‘কুত্তা’ হয়। বড় লোকের ‘টমি’ হলে একটু কোলে তুলে নেওয়াই যায়!

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক