সাতকানিয়ায় পরিবেশের মৃত্যুপরোয়ানা!

ফয়সাল করিম, সাতকানিয়া ঘুরে এসে : চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বনাঞ্চল, কৃষি জমি আর জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে গড়ে উঠছে একের পর এক ইট ভাটা। এসবের অধিকাংশের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না নেয়ার পাশাপাশি কেবল অনুমতির আবেদন জমা দিয়েই ইটভাটা স্থাপন করে উৎপাদনে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় প্রভাবশালীদের মালিকানায় গড়ে উঠা এসব ইটভাটার দখলে-দূষণে এখন সাতকানিয়ার বিভিন্ন গ্রামের সাধারণ মানুষ নিরুপায়।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, গেল কয়েক বছরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশে সাতকানিয়ার বিভিন্ন ফসলিজমিতে গড়ে ওঠেছে ৬০টিরও বেশি ইটভাটা। বিশেষ করে উপজেলার মৌলভীর দোকান থেকে কেরানিহাট পর্যন্ত তিন থেকে চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এসব ইটভাটার অধিকাংশের অবস্থান।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এসব ইট-ভাটার অনেকগুলোই স্থাপন করা হয়েছে ডজনখানেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গা ঘেঁষে। এতে সাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে জাফর আহমদ চৌধুরী ডিগ্রি কলেজ, রসুলাবাদ সিনিয়র মাদ্রাসা, সৈয়দ মক্কী রা. কিন্ডারগার্টেন, রসুলবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মরফলা আর এম এন উচ্চ বিদ্যালয়সহ অন্তত ডজনখানেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।

সরেজমিনে সাতকানিয়ার মরফলা, এওচিয়া, কেরাণীহাট ও আশপাশের বেশ কিছু এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন-২০০১ অনুযায়ী লোকালয়ের তিন মাইল দূরত্বে ইটভাটা স্থাপনের নিয়ম থাকলেও তার কোনো তোয়াক্কা না করেই যত্রতত্র গড়ে উঠেছে ইট-ভাটা। এসব ভাটা স্থাপন করা হয়েছে অসংখ্য পাহাড়, টিলা, বনাঞ্চল আর ফসলি জমি দখলে নিয়ে। নিষিদ্ধ প্রযুক্তির ড্রাম চিমনি ব্যবহার ছাড়াও এসব ইট-ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে পার্শ্ববর্তী বনাঞ্চলের কাঠ।

মরফলা আর এম এন উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন জানান, ইট-ভাটার চিমনি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ার প্রভাবে বনাঞ্চলের গাছগুলো যেমন মরতে শুরু করেছে তেমনি ইটপোড়ার ঝাঁজালো গন্ধে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে বসা কষ্টকর হয়ে পড়ে। এতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যাসহ নানা ধরনের রোগ আক্রান্ত হচ্ছে গ্রামবাসী। তিনি আরও জানান, নির্বিচারে পাহাড়ী এলাকার গাছ নিধনের ফলে বন্যপ্রাণিরা বনাঞ্চল ছেড়ে লোকালয়ে হানা দিচ্ছে।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশে কেরাণীহাট এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ফসলি জমির ওপরের অংশ কেটে কেটে ইটভাটাগুলোর জন্য মাটি সংগ্রহ করা হচ্ছে। এজন্য ব্যবহার করা হচ্ছে বড় বড় এক্সকেভেটর। যেসব দিয়ে নিয়মিত মাটি খোঁড়ার ফলে ফসলি জমি বিলীন হয়ে সৃষ্টি হয়েছে ২০/৩০ ফুট গভীর গর্তের। স্থানীয় কৃষকরা জানান, এভাবে মাটি কেটে কেটে জমি ধ্বংস করায় এসবে আর কখনো ফসল ফলানো সম্ভব হবে না। মাটি উত্তোলন ও সংগ্রহ প্রক্রিয়ার কারণে পুরো এলাকায় ধুলোর রাজত্ব তৈরি হওয়ায় আশপাশের গাছপালা বিনষ্ট হয়ে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে ফসলি জমিও। মাটি সংগ্রহের এমন চিত্র দেখা যায় আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে।

উপজেলার মরফলা গ্রামের বাসিন্দা ও জাফর আহমদ চৌধুরী ডিগ্রি কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী শাহাদাত হোসেন অভিযোগ করেন, নলুয়া গ্রামের নয়াখালের বাঁধ আর সরকারি খাসের জমি দখল করে কোনো ছাড়পত্র ছাড়াই তাদের এলাকায় গড়ে উঠেছে সোনার বাংলা নামের একটি ইট-ভাটা। এই ইট-ভাটার মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় এলাকাবাসীর বাঁধার মুখেও তা বন্ধ করা যায়নি।

পরিবেশদূষণ ও সরকারি খাসজমি দখলে নেয়ার অভিযোগ তুলে তা বন্ধের জন্য সম্প্রতি এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে প্রশাসন বরাবর চিঠি দেয়া হলেও তা নিয়ে খুব একটা তৎপরতা দেখা যায়নি বলে অভিযোগ করেন তিনি। তবে পরিবেশ ছাড়পত্রসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে না পারায় গেল সপ্তাহে এ ইট-ভাটাটিকে এক লাখ টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আসিফ ইমতিয়াজের নেতৃত্বে এ ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালিত হয়।

এসময় তিনি এলাকাবাসী ও সাংবাদিকদের সোনার বাংলা নামের ওই ইটভাটার বিরুদ্ধে সরকারি খাস জমি দখলের অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্তের আশ্বাস দেন।

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, মরফলার নলুয়ার একাংশসহ সাতকানিয়ার তিন কিলোমিটার এলাকাতেই ইটভাটা রয়েছে ৬০টি, যেসবের মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র রয়েছে মাত্র এক-তৃতীয়াংশের। স্থানীয়রা জানান, অনুমোদন আর নিয়মের তোয়াক্কা না করে এভাবে প্রশাসনের নাকের ডগায় প্রভাবশালীরা এভাবে একের পর একে ইট-ভাটা বানিয়ে যাচ্ছে। ইটভাটা এলাকায় অধিকাংশ গরিব কৃষক হওয়ায় তাদের ধান চাষের পাওয়া মুনাফা থেকেও অধিক মুনাফা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে জমিগুলো অগ্রিম বন্ধকের মতো করে চুক্তিতে নেওয়া হয়।

এছাড়াও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভাটায় একটু বেশি বেতনে তাদের কাজের ব্যবস্থা করে দেন ভাটা মালিকরা। এতে প্রলুব্ধ হয়ে জমি দিতে বাধ্য হয় অনেক কৃষক ও স্থানীয় বাসিন্দা। অন্যদিকে সাতকানিয়ার সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গা-ঘেঁষে ভাটা গড়ে ওঠার একমাত্র কারণ সরকারি বন বিটের সংরক্ষকদের হাত করে অবৈধ কাঠ পোড়ানোর সুযোগ হাতিয়ে নেয়া। এই সুযোগটি কাজে লাগাতেই স্বল্প দূরত্বে বনের কাঠ আহরণের সুবিধামতো স্থানে গড়ে উঠছে একের পর এক ইটভাটা।

এতসব অনিয়মের বিরুদ্ধে সুফল মিলছে না বলে অভিযোগ করেন নলুয়া গ্রামের বাসিন্দারা। এমন অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ উল্যাহ জানান, অভিযোগ পেলেই সাথে সাথে তারা অভিযানে বেরিয়ে পড়েন নয়তো স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তা নিয়ে অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে ব্যবস্থা নেন। অনুমোদনহীন ইটভাটা ও দখল-দূষণ ঠেকাতে এখন থেকে অভিযান আরো জোরদার করা হবেও বলেও আশ্বাস দেন তিনি।

এদিকে প্রতিবছর নতুন নতুন ইটভাটা গড়ে ওঠায় সাতকানিয়ায় কমে যাচ্ছে কৃষি জমির পরিমাণ। কৃষি বিভাগ জানিয়েছে ইট-ভাটা, সাথে পরিবেশের এমন দখল-দূষণ বেড়ে চললে আগামী পাঁচ বছরেই এ অঞ্চলে ফসল উৎপাদন আশঙ্কাজন হারে কমে আসবে।