একুশে প্রতিবেদক
চট্টগ্রাম: রাষ্ট্রের ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্স বা ‘অগ্রগণ্যতা পরোয়ানা’ যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালায় ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত হচ্ছে। কখনো জেনেশুনে আবার কখনো অজ্ঞাতপ্রসূত এটি করা হচ্ছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে এই লঙ্ঘনের প্রবণতা বেশি।
রাষ্ট্র-সরকারের পদ-পদবী অনুযায়ী স্বাধীনতার পর থেকে গুরুত্ব কিংবা অগ্রগণ্যতা বিবেচনায় বাংলাদেশে পঁচিশটি ‘পদমর্যাদা’ নির্ধারণ করা হয়। সর্বশেষ ২০০৮ সালের ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সে দেখা যায়, মন্ত্রীর মর্যাদায় থাকা ঢাকার মেয়রগণ রাষ্ট্রের ৬ নম্বর ব্যক্তি অর্থাৎ টেকনোক্রেট কোটায় নিয়োজিত একজন মন্ত্রীর সমান। কিন্তু রাষ্ট্রের ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সে ঢাকার বাইরের সিটি করপোরেশনের মেয়রদের রাখা হয়েছে রাষ্ট্রের ১৮ তম ব্যক্তি হিসেবে।
ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সে ১৬ তম ব্যক্তি সচিব, মেজর জেনারেল ও অন্য দুই বাহিনীর এক্ই পদমর্যাদার কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান, ১৭ তম অবস্থানে সচিব পদমর্যাদার যেমন পুলিশের আইজিপি, জাতীয় অধ্যাপক, এনএসআইয়ের মহাপরিচালক এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যবৃন্দ। মেয়রের ১৮ তম অবস্থানের পরে আছেন সরকারের অতিরিক্ত সচিব ও এই পদমর্যাদার ব্যক্তিগণ। তাদের দেখানো হয়েছে রাষ্ট্রের ১৯তম ব্যক্তি হিসেবে। আবার নিজ সিটি করপোরেশনের বাইরে বাংলাদেশের অন্য অঞ্চলে গেলে পদমর্যাদা হৃাস পেয়ে চট্টগ্রামসহ অন্যান্য বিভাগীয় সিটির মেয়রগণ রাষ্ট্রের ২৩ তম ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত হবেন। এটি সরকারি মেডিকেল কলেজ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের সমান পদমর্যাদার।
আবার সবসময় ২২তম মর্যাদায় আছেন চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা উন্নয়ন কর্র্র্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানগণ। একই পদমর্যাদায় আছেন ডিআইজি, আইজি প্রিজন, বিভাগীয় কমিশনারবৃন্দ (নিজ কর্মস্থলের বাইরে)। অর্থাৎ নিজ সিটি করপোরেশনের বাইরে একজন মেয়রের পদমর্যাদা এই তিন পদেরও পরে। আর ২৪ তম পদমর্যাদা ভোগ করছেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানগণ। একই পদমর্যাদায় আছে মেরিন একাডেমির কমান্ড্যান্ট, জেলা ও সেশন জজ, লেফট্যানেন্ট কর্নেল এবং দুই বাহিনীর এই পদের সমান কর্মকর্তারা।
সবশেষ অর্থাৎ ২৫ তম ব্যক্তি জেলা প্রশাসক, উপ সচিব, পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জন, মেজর ও অন্য দুই বাহিনীর সমান পদের কর্মকর্তাবৃন্দ, উপজেলা চেয়ারম্যান এবং প্রথম শ্রেণীর পৌরসভার মেয়রগণ।
বাস্তবে দেখা যায়, এসব পদমর্যাদাগুলো মানা হচ্ছে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। যেমন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র যেসব অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হচ্ছেন সেই একই অনুষ্ঠানে দিব্যি বিশেষ অতিথি হচ্ছেন সংসদ সদস্য, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য এমনকি সচিব পদমর্যাদার লোকজনও। দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশনের মেয়রদের বেলায়ও প্রতিনিয়ত এমন লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে বলে জানা গেছে। অথচ ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্স অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা সবসসময় রাষ্ট্রের ১৩ তম ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত হন। ১২ তম অবস্থানে থাকা তিনবাহিনী প্রধানের পরই মূলত সংসদ সদস্যের অবস্থান।
প্রসঙ্গত, সাদেক হোসেন খোকা মেয়র থাকাকালে ২০০২ সালে বিএনপি সরকার ঢাকার মেয়রকে মন্ত্রীর পদমর্যাদা আর দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশনের মেয়রদের প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল। সে থেকে ঢাকার মেয়রগণ মন্ত্রীর পদমর্যাদা আর ঢাকার বাইরের সিটি মেয়ররা প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা ভোগ করছিলেন। কিন্তু ২০১০ সালে চট্টগ্রামে বিএনপি সমর্থিত এম মনজুর আলম মেয়র নির্বাচিত হলে ঢাকার বাইরের মেয়রদের প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা বিলোপ করা হয়। সেই থেকে ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্স অনুসারে ১৮ তম মর্যাদা ভোগ করেন এম মনজুর আলম। এ নিয়ে নতুন কোনো প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়ায় এখনো সেই মর্যাদাতেই আছেন চট্টগ্রামের নতুন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনসহ অন্য সিটি করপোরেশনের মেয়রগণ।
এ বিষয়ে মতামত জানতে চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। এসএমএস পাঠিয়েও জানা যায়নি তার বক্তব্য। তবে নির্বাচিত হওয়ার পর চট্টগ্রামের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেছিলেন, শপথ গ্রহণের সময় প্রধানমন্ত্রী নিজেই চট্টগ্রামের মেয়র পদটিকে মন্ত্রীর পদমর্যাদা দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেছিলেন তাকে। প্রধানমন্ত্রী যে কোনো মুহূর্তে সেই প্রজ্ঞাপন জারি করবেন বলে তিনি আশাবাদী।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে ‘সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট’র জন্যই মূলত ‘ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্স’। কিন্তু সেটা পুরোপুরি পালন বা প্রয়োগ হচ্ছে না। একজন মেয়রের ক্ষমতা আছে, অর্থ আছে তাকে মানুষ পূজা করে। তিনি প্রধান অতিথি হলে, সংসদ সদস্যরা বিশেষ অতিথি হচ্ছেন। সংসদ সদস্য বা সমমর্যাদার ব্যক্তিরা বিষয়টি স্বাচ্ছন্দ্যে মেনে নিচ্ছেন বলেই এমনটি হচ্ছে। তারা যদি আপত্তি জানান, মেয়রের সঙ্গে বিশেষ অতিথি বা মেয়রের পরে নাম ব্যবহার তারা মানবেন না সেক্ষেত্রে সেটিই স্বাভাবিক। উন্নত বিশ্বে মেয়রদের মর্যাদার কথা উল্লেখ করে তোফায়েল আহমেদ বলেন, মেয়র হচ্ছেন একটি শহরের প্রধান নাগরিক। প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী কোনো শহরে প্রবেশ করলে সেই শহরের মেয়ররাই তাদের অভ্যর্থনা জানান, বরণ করে নেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সভাপতি অধ্যাপক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে কে কোথায় বসবে, কার পরে কে আসবে সেটা নির্ধারণের জন্যই ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্স করা হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানমালায় এটি পালন করা হলেও প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্স মানা হচ্ছে না। তবে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের উপরেই মেয়র কিংবা বড় পরিসরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের স্থান হওয়া উচিত বলে মনে করেন অধ্যাপক বদিউল আলম মজুমদার।
স্থানীয় সরকারব্যবস্থা ও গবেষণার সঙ্গে যুক্ত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তিনবারের নির্বাচিত কাউন্সিলর অ্যাডভোকেট রেহানা বেগম রানু বলেন, মেয়রের পদমর্যাদা নিয়ে বিভাজন সঙ্গত নয়। একটি দেশে মেয়রদের স্থানভেদে একেক মর্যাদা কোনোভাবেই মানা যায় না। রাষ্ট্র হচ্ছে আমাদের অভিভাবক। অভিভাবক-প্রতিষ্ঠানই যদি চরম বৈষম্য তৈরি করে রাখে তাহলে সমাজের সবক্ষেত্রেই বৈষম্যর বিষয়টি উৎসাহ পাবে।তাই ঢাকার মতো বিভাগীয় শহরের মেয়রদেরও মন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করার দাবি জানান তিনি।