পরোয়ানা গায়েব, ঘুরে বেড়াচ্ছে পাঁচ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি!


মোহাম্মদ রফিক : শাহ আলম ওরফে রুবেল চৌধুরী নামে এক সাজাপ্রাপ্ত আসামির পাঁচ বছরের সাজা পরোয়ানা ‘গায়েব’ হয়ে গেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে; তিনি এখন চট্টগ্রাম শহরে বীরদর্পে ঘোরাফেরা করছেন।

২০১৫ সালের ৫ জুলাই মাদকের মামলায় তাকে সাজা দিয়েছিল কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত। তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানার রত্নপুর গ্রামে। বাবার নাম আবসুস সাত্তার ওরফে বাচ্চু ড্রাইভার।

জানা গেছে, শাহ আলম ওরফে রুবেল চৌধুরীর সাজা পরোয়ানাটি কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে ২০১৫ সালের ২ আগস্ট ১২২০ (১২-১৩) স্মারকমূলে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ কার্যালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু ‘রহস্যজনক’ কারণে রুবেলের সাজা পরোয়ানাটি চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে পৌঁছেনি প্রায় সাড়ে ৫ বছরেও।

অভিযোগ আছে, পুলিশের কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে নিজের সাজা পরোয়ানাটি ‘গায়েব’ করে দেন রুবেল চৌধুরী। সাজা পরোয়ানা মাথায় নিয়ে চট্টগ্রাম নগরে মাদকব্যবসা, মারামারি, হত্যাচেষ্টাসহ নানা গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়েন রুবেল। এর মধ্যে ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে গ্রেফতার হয়ে পৃথক মেয়াদে তিন মাস জেল খাটেন।

রুবেল পেশায় একজন গাড়ি চালক। সম্প্রতি, নির্বাচন করে নগরের ‘লালদিঘি পাড় কার-মাইক্রোবাস শ্রমিক ইউনিয়ন’-এর সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।

পেশায় গাড়ি চালক হলেও নিজের অপরাধ জগত আড়াল করতে নানা কৌশলও রপ্ত করেছেন রুবেল চৌধুরী। অভিযোগ আছে, নগরের ৩৫ নম্বর বক্সিরহাট ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর হাজী নুরুল হকের ছেলে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলম রুবেলকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় মাদকপাচারসহ নানা অপকর্ম করে বেড়াচ্ছেন রুবেল চৌধুরী।

পাঁচ বছরের সাজা পরোয়ানাভুক্ত এবং ৭ মামলায় অভিযুক্ত একজন আসামিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া প্রসঙ্গে মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘রুবেলের বিষয়ে আপনি আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছেন?’ এভাবে পাল্টা প্রশ্ন করে মোবাইলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি। পরে প্রতিবেদক তার মোবাইলে একাধিকবার কল করলেও তিনি ফোন ধরেননি।

৩৫ নম্বর বক্সিরহাট ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হাজি নুরুল হকের পক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি অংশ নিচ্ছেন। কখনো কখনো নিজেকে স্থানীয় যুবলীগ নেতাও পরিচয় দিচ্ছেন রুবেল। নিজের অপরাধ জগত থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরাতে কখনো ছবি তুলছেন রাজনৈতিক ব্যক্তির সাথে কিংবা কখনো পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে, যেগুলো ফেসবুকে আপলোড দিয়ে প্রচার চালাতেও দেখা যায়।

যাদের সঙ্গে রুবেল ছবি তুলেছেন তারা হলেন-শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এবং তার ছোটভাই বোরহানুল হাসান চৌধুরী সালেহীন, বাকলিয়া থানার সাবেক ওসি নেজাম উদ্দিন, কোতোয়ালী থানার সাবেক ওসি মোহাম্মদ মহসীন, সাবেক কোতোয়ালী থানার ওসি জসিম উদ্দিন। রুবেলের এসব ছবি একুশে পত্রিকার কাছে সংরক্ষিত আছে।

৭ মামলার আসামি এবং ৫ বছরের সাজা পরোয়ানাভুক্ত আসামি রুবেলের সাথে ছবি তোলা প্রসঙ্গে কোতোয়ালী থানার ওসি নেজাম উদ্দিন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি রুবেল নামে কাউকে চিনি না। কতজনই তো পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন। সবাইকে কি আর মনে রাখা যায়, চেনা যায়?

জানা গেছে, মাদকের মামলায় পাঁচ বছরের সাজা পরোয়ানাটি গত সাড়ে পাঁচ বছর ধরে ‘গায়েব’ রাখার বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় ১৪ জানুয়ারি কুমিল্লা জেলা আদালতের নেজারত শাখা থেকে ডাকযোগে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে ১৭(১) স্মারকমূলে পাঠানো হয়।

গত ১৮ জানুয়ারি সাজা পরোয়ানাটি বাঁশখালী থানা জিআরও’র কাছে (স্মারক-১২১৫) পাঠায় চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার অফিস। এ ব্যাপারে বাঁশখালী থানার ওসি শফিউল কবীর একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘৫ বছর সাজা পরোয়ানাভুক্ত কোনও আসামির নথিপত্র থানায় আসছে কিনা তা দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’

জানা গেছে, ২০০৯ সালে কুমিল্লা থেকে ৭০০ বোতল ফেনসিডিল চট্টগ্রামে আনার পথে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা এলাকায় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন আলোচ্য রুবেল চৌধুরী। এ ঘটনায় পুলিশ বাদি হয়ে তার বিরুদ্ধে চৌদ্দগ্রাম থানায় ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫-বি(২) ধারা এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা (নম্বর ১৮, জি আর ৩৮১/২০০৯) দায়ের করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫-বি(২) অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ওই মামলায় আসামিকে (শাহ আলম ওরফে রুবেল চৌধুরী) ৫ বছর কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের ৫ জুলাই এ মামলার রায় দেন কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের তৃতীয় অতিরিক্ত আদালতের বিচারক এম আলী আহমেদ।

পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, রুবেল চৌধুরীর বিরুদ্ধে ২০১২ সালের আগস্ট থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত নগরের কোতোয়ালী থানায় পাঁচটি এবং বাকলিয়া থানায় একটিসহ মোট ৬টি মামলা দায়ের হয়। মাদকদ্রব্যনিয়ন্ত্রণ আইন, হত্যাচেষ্টা, অপহরণ, মারামারি, ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করার অভিযোগে এসব মামলা দায়ের হয়। মামলাগুলোয় তিনি এজাহারে অভিযুক্ত।

এরমধ্যে নগরের কোতোয়ালী থানায় ২০১৭ সালের ২ জানুয়ারি দণ্ডবিধির ৩৯৯ ও ৪০২ ধারায় দায়ের হয় একটি মামলা (এফআইআর নম্বর-৩)। এ মামলায় তিনি চার্জশিটভুক্ত আসামি। একই থানায় একই বছর ৬ ফেব্রুয়ারি মাদ্রকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের হয় একটি মামলা (এফআইআর নম্বর-১৪)। ২০১৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি নগরের বাকলিয়া থানায় দণ্ডবিধির ১৪৩, ৩২৬ ও ৩০৭ ধারার আপরাধে দায়ের হয় আরেকটি মামলা। (এফআইআর নম্বর-৬)। ২০১৭ সালের ১২ জুন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে কোতোয়ালী থানায় দায়ের হয় একটি মামলা (এফআইআর নম্বর-৪৪)।

২০১৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি দণ্ডবিধির ৩৬৪/-ক/৩২৩/৩৭৯/৩৪ ধারায় কোতোয়ালী থানায় দায়ের হয় একটি মামলা। এর আগে ২০১২ সালের ৩০ আগস্ট একই থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন এবং ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়ের হয় আরেকটি মামলা।

রুবেল চৌধুরীর বক্তব্য
অভিযুক্ত শাহ আলম ওরফে রুবেল চৌধুরী একুশে পত্রিকার কাছে দাবি করেন, কুমিল্লা জেলা অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতের দেওয়া ৫ বছরের কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি উচ্চ আদালতে আপিল করে জামিন পেয়েছেন। চৌদ্দগ্রাম থানার ওই মামলায় তিনি ১১ মাস কারাভোগ করেছেন। এরপর ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালী থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলায় তিনি কারাগারে গেলে একটি প্রতিপক্ষ পুলিশকে বশে নিয়ে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে একের পর এক মামলা দেয়।

রুবেল চৌধুরী নিজেকে চট্টগ্রাম মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মী দাবি করে বলেন, আমার রাজনৈতিক অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিতে একটি পক্ষ আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে। আমি শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরীর কর্মী। রাজনৈতিক ব্যক্তি ও পুলিশ কর্তার সাথে ছবি তুলেছি ঠিক। কিন্তু এগুলো ‘বিক্রি’ করে আমি চলি না।’ ৫ বছরের সাজা হওয়া মামলায় উচ্চ আদালত থেকে পাওয়া জামিননামার ডকুমেন্ট চাইলে রুবেল চৌধুরী বলেন, ‘এগুলো তো এখন আমার কাছে নেই।’

আপনি (রুবেল) বলছেন, ২০১৭ সালের শুরুর দিকে চট্টগ্রামে জেলে যাওয়ার পর আপনাকে একের পর এক পেন্ডিং মামলা দেওয়া হয়েছে তাহলে ২০১২ ও ২০১৫ সালে আপনার বিরুদ্ধে কোতোয়ালী ও বাকলিয়া থানায় ফৌজদারি অপরাধে মামলা দায়ের হলো কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে নিরুত্তর থাকেন রুবেল চৌধুরী।