সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

কিশোরীর ‘রহস্যজনক’ মৃত্যু: পিবিআইয়ের প্রতিবেদন নিয়ে অনেক প্রশ্ন

প্রকাশিতঃ ৭ জানুয়ারী ২০২১ | ৭:১৯ অপরাহ্ন


মোহাম্মদ রফিক : চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে এক কিশোরীর ‘রহস্যজনক’ মৃত্যু নিয়ে তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন তার মা-বাবা। তাদের দাবি, মেয়ে আত্মহত্যা করেনি। তাকে আসামিরা ধর্ষণের পর হত্যা করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিয়েছে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটের উপ-পরিদর্শক মো. হারুন আসামিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাদের মেয়ে ‘আত্মহত্যা’ করেছে মর্মে আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছেন বলেও অভিযোগ বাবা-মায়ের।

মামলার বাদি ওই কিশোরীর মা বিলকিছ বেগমের অভিযোগ, আসামিদের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে মামলা তুলে নিতে চাপ দিয়েছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. হারুন।

এদিকে এক বছর আগে অভিযুক্ত তিন আসামির বিরুদ্ধে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও পুলিশ তাদের ধরছে না বলে অভিযোগ করেছেন মৃত কিশোরীর বাবা মো. আউয়াল।

এর আগে ২০১৭ সালের ২৬ এপ্রিল হাটহাজারী উপজেলার জঙ্গল দক্ষিণ পাহাড়তলীর হামজা কলোনির বাসা থেকে মো. আউয়ালের মেয়ে ঝুমা আকতারের (১২) মরদেহ উদ্ধার করে হাটহাজারী থানা পুলিশ।

ঝুমা আক্তারের মৃত্যু ‘আত্মহত্যা জনিত’ উল্লেখ করে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের একজন চিকিৎসক। কিন্তু এ প্রতিবেদন প্রত্যাখান করে ২০১৯ সালের ৫ মে চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এ মামলা করেন মৃত কিশোরীর মা বিলকিছ বেগম।

মামলায় প্রতিবেশী আল আমিন ও তার মা ফরিদা ইয়াছমিন এবং মো. এনামকে আসামি করা হয়। পরিকল্পিতভাবে ঝুমাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে বলে মামলায় অভিযোগ আনা হয়।

আদালত অভিযোগ গ্রহণ করে পিবিআইকে তদন্তের আদেশ দেন। চার মাস তদন্ত শেষে একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই’র সাব-ইন্সপেক্টর মো. হারুন।

এ প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে ২০১৯ সালের ২০ নভেম্বর আদালতে নারাজি দেন বিলকিছ বেগম। নারাজি গ্রহণ করে ২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি তিন আসামি আল-আমীন, তার মা ফরিদা ইয়াছমিন ও মো. এনামের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত।

নারাজি আবেদনে বাদী অভিযোগ করেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই’র সাব-ইন্সপেক্টর মো. হারুন আসামিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ঘটনার তদন্ত করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন।

বাদীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট তুতুল বাহার জানান, ঘটনার পরপর গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় ভিকটিমের ছবি তোলা হয়েছিল। এতে আত্মহত্যার কোনো আলামত পরিলক্ষিত হয়নি। ছবিতে দেখা গেছে, ভিকটিমের পা দুটি মেঝের সাথে লাগানো। জিহ্বা বের হয়ে মাথা একদিকে কাত অবস্থায় ছিল না। মুখমণ্ডল উপরের দিকে। হাত ছিল মুষ্টিবদ্ধ। তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদনে ভিকটিমকে ‘মানসিক প্রতিবন্ধী’ বলে উপস্থাপন করেছেন। মানসিক প্রতিবন্ধী কিশোরীর পক্ষে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহনন করার জন্য এত উপাদান জোগাড় করা কি সম্ভব? প্রশ্ন রাখেন এ আইনজীবীর।

অ্যাডভোকেট তুতুল বাহার জানান, ঘটনার সময় ভিকটিমের বয়স ১২ বছর হলেও তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন ৯ বছর। তিনি (তদন্ত কর্মকর্তা) আরও উল্লেখ করেন যে, “বাদিনীর বড় মেয়ে ঘরে এসে গলায় ফাঁস লাগানো ছোট বোনকে ঘরের চালা থেকে ওড়না কেটে নিচে নামান।” একজন মেয়ের পক্ষে কি গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় একটি মরদেহ নিচে নামানো সম্ভব? প্রশ্ন আইনজীবী তুতুল বাহারের।

নারাজি দরখাস্তে ভিকটিমের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনও প্রভাবিত বলে উল্লেখ করে বলা হয়, ভিকটিম ঝুমাকে পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণের পর হত্যা করা হলেও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করা হয়নি। পিবিআই’র তদন্ত কর্মকর্তা মো. হারুনও বিষয়টি বিশ্লেষণ করেননি। ঘটনার পরপর আসামিরা কেন আত্মগোপনে চলে গিয়েছেন, কিংবা ঘটনার পর চট্টগ্রামে দাফন করতে না দিয়ে আসামিরা কেন নিজ খরচে ভিকটিমের লাশ তার গ্রামের বাড়ি সিলেটের হবিগঞ্জে পাঠিয়ে দিলেন?

তদন্তকালে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেননি তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ হারুন। বিলকিছ বেগম অভিযোগ করে একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তা মামলার তদন্ত করতে ঘটনাস্থলে প্রকাশ্যে ও গোপনে একাধিকবার আসার কথা তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করলেও মূলত তিনি ঘটনাস্থলে এসেছেন একবার। তাও আসামিদের গাড়িতে চড়ে। বাদী পক্ষে ৮ জন সাক্ষ্য দিতে চাইলেও তাদের সাথে কথা বলেননি তিনি। তাদের কাছ থেকে সাদা কাগজে সই নিয়েছেন।’

তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঝুমা আক্তারের বাবা মো. আউয়াল অভিযোগ করে একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘পিবিআই’র এসআই হারুন সাহেব আসামিদের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা নিয়ে মামলা প্রত্যাহার করার জন্য চাপও দিয়েছেন। কিন্তু আমি তা প্রত্যাখ্যান করায় তিনি আসামিদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে আমার মেয়ে আত্মহত্যা করেছেন মর্মে মনগড়া প্রতিবেদন দিয়েছেন।’

এদিকে আসামিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া এবং ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে আসামিদের সাথে আপস-মিমাংসার জন্য বাদীকে চাপ দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পিবিআই চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটের এসআই মোহাম্মদ হারুন।

আজ বৃহস্পতিবার বিকাল তিনটার দিকে নগরের খুলশীতে পিবিআই কার্যালয়ে এসআই মোহাম্মদ হারুন একুশে পত্রিকাকে বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন বাদীর বিপক্ষে গেলে তদন্ত অফিসারের বিরুদ্ধে এ ধরণের কথা উঠা স্বাভাবিক। ঝুমা আত্মহত্যা করেছে। আমার তদন্তে এটাই উঠে এসেছে৷

এদিকে এক বছর আগে আসামিদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারির পরও এ পর্যন্ত একজন আসামিও গ্রেপ্তার হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাটহাজারী থানার ওসি রফিকুল ইসলাম একুশে পত্রিকাকে বলেন, পরোয়ানাভুক্ত যে কোনো মামলার আসামি ধরতে আমরা দিনরাত কাজ করছি। আসামি ধরতে বাদীর সহযোগিতাও দরকার। এ ব্যপারে বাদী যদি থানায় আসেন তাহলে তাকে শতভাগ সহযোগিতা করা হবে।