বঙ্গবন্ধুর ‘চরিত্রহনন’ করে সরকারি টাকায় জাদুঘর!


জসিম উদ্দীন, কক্সবাজার : ইতিহাস বলছে, ১৯৫৮ সালের ১২ অক্টোবর থেকে ১৯৬০ সালের ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা ২৫ মাস ২৬ দিন, এরপর ১৯৬৬ সালের ৮ মে থেকে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত কারাগারেই ছিলেন স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে সময় কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্টে বসেই জাতির জনক স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনা করেছিলেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।

কিন্তুু বর্ণিত সময়ে কারাগারে থাকা বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ কারাবাস অস্বীকার ও দেশের স্বাধীনতা, সংগ্রামের ইতিহাসকে ক্ষতবিক্ষত করে প্রচার করা হচ্ছে ওই সময়ে বঙ্গবন্ধু পালিয়ে আত্মগোপন করেছিলেন কক্সবাজারের ইনানীর চেনছড়িতে।

অভিযোগ ওঠেছে, এসব মনগড়া গল্পের উপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রহনন ও ইতিহাসকে ক্ষতবিক্ষত করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে উখিয়ার ইনানীর চেনছড়িতে নির্মাণ করা হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর’। চলমান জাদুঘরের অধিকাংশ কাজ এরইমধ্যে শেষ হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধা-ইতিহাসবিদরা বলছেন, প্রকৃত ইতিহাস এড়িয়ে মনগড়া বিকৃত ইতিহাস প্রচারের মাধ্যমে একদিকে বঙ্গবন্ধুর ‘চরিত্রহনন’ করা হয়েছে, অপরদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অবদান বিতর্কিত করার লক্ষ্যে অস্বীকার করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ কারাবাস।

তাদের দাবি, পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা বানোয়াট গল্পের স্থায়ীরূপ দিতে জাদুঘর নির্মাণ করে নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুকে ভিন্নভাবে পরিচিত করার উদ্যোগ নিয়েছে একটি চক্র। সেখানে জেলা প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

যে গল্পের ভিত্তিতে জাদুঘর নির্মাণ হচ্ছে
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৯ সালের ১৫ আগস্ট দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিবেদক পরবর্তীতে দৈনিক কালেরকন্ঠে যোগ দিয়ে একই প্রতিবেদক ২০১০ সালে ১৭ মার্চ ‘ইনানীতে বঙ্গবন্ধুর অজ্ঞাতবাস’ শিরোনামে পৃথক দুটি প্রতিবেদন করেন।

সেখানে প্রতিবেদক লিখেন, ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান রাজনীতির উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে। এ সময় ভিন্ন একটু সময় কাটানোর জন্য বঙ্গবন্ধু কক্সবাজারে এসেছিলেন।

উক্ত সংবাদে জনৈক লোকমান হাকিমকে (যিনি পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হাকিম মাস্টার নামে পরিচিতি পান) তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে উপস্থাপন করে তার উদ্ধৃতি দেওয়া হয় এবং ছকিনা নামের এক মহিলা বঙ্গবন্ধুর জন্য রান্নাবান্না করতেন বলে দাবি করা হয়।

একই গল্প নিয়ে ২০১৩ সালের ১৮ মার্চ দৈনিক জনকণ্ঠে কক্সবাজার সংবাদদাতার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আসামি হয়ে বঙ্গবন্ধু কক্সবাজার এসেছিলেন আত্মগোপন করতে। একই প্রতিবেদক ২০১৬ সালের ২৭ আগস্ট আবার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসনের সময় কক্সবাজার এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু।

এখানে শেষ নয়, রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশনে কক্সবাজার জেলা সংবাদদাতার বরাতেও একই ধরনের বিতর্কিত ইতিহাসে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

প্রথম প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে বন্ধ করল প্রকাশ্য রাজনীতি। স্বৈরশাসক বঙ্গবন্ধুকে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিলেন। বঙ্গবন্ধু আত্মগোপন করতে এলেন ফেলারম চাকমার বাড়িতে। এখানে থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু বেশির ভাগ সময় কাটাতেন কাঁঠাল গাছের নিচে।

পরের বছর প্রচার করা দ্বিতীয় প্রতিবেদনে প্রতিবেদক উল্লেখ করেন, আত্মগোপনে বা হুলিয়া এড়াতে নয়, এখানে বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন গোপন বৈঠক করতে। এখানে থাকাবস্থায় আমগাছের নিচে বঙ্গবন্ধু সময় কাটাতেন (প্রতিবেদন দুটি একুশে পত্রিকার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে)।

প্রকাশিত এসব প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করা দেখা গেছে, প্রতিবেদনগুলোতে যে সময়কালে বঙ্গবন্ধু ইনানীতে আত্মগোপন করেন বলে দাবি করা হয়েছে ওই সময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন কারাগারে। এরপরও এসব গল্পের সূত্র ধরে একেকজন একেক রকম কল্পনাপ্রসূত তথ্য উপস্থাপন করে ইনানীতে বঙ্গবন্ধুর আত্মগোপন নিয়ে স্ব স্ব গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রচার করেই যাচ্ছেন।

বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত ইতিহাস

ইতিহাস বলছে, ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসন (জরুরি অবস্থা) জারি করেন। এর চারদিন পর শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হন। সেই সময় টানা ২৫ মাস ২৬ দিন কারাভোগের পর ১৯৬০ সালের ৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদনের পর তিনি মুক্তিলাভ করেন।

এরপর ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণার কয়েক দিন পর নারায়ণগঞ্জে মিটিং শেষে ঢাকায় ফিরে ১৯৬৬ সালের ৮ মে মধ্যরাতে গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু। সে থেকে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত কারাগারেই কেটেছে বঙ্গবন্ধুর দিনকাল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ের ভূমিকাতে বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, ১৯৫৮ সালে ১২ অক্টোবর তৎকালীন সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। প্রায় ১৪ মাস জেলখানায় বন্দি থাকার পর তাকে মুক্তি দিয়ে পুনরায় জেল গেটে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬০ সালের ৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদনের পর তিনি মুক্তি লাভ করেন।

এরপর ১৯৬৬ সালে নারায়ণগঞ্জে সর্বশেষ মিটিং করে ঢাকায় ফিরে এসেই ৮ মে মধ্যরাতে গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু। দেশের মানুষের ন্যায্য দাবি তুলে ধরে জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ায় সরকার তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে গ্রেফতার করে। ১৯৬৮ সালে ৩ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে এক নাম্বার আসামি করে মোট ৩৫ জন বাঙালি সেনা ও সিএসপি অফিসারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ এনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে (পৃষ্ঠা নং-৬)।

একই তথ্য উল্লেখ রয়েছে, অসমাপ্ত আত্মজীবনী (পৃষ্ঠা- ২৯৪), মহাপুরুষ (পৃষ্ঠা-৩৩ ও ৮৯), মূলধারার রাজনীতি : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬ (পৃষ্ঠা-৭১ ও ১০৪), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতি ও জীবনধারা- ১৯২০-১৯৭৫ (পৃষ্ঠা-৫৭ ও ১১৫) বাংলাদেশের আরেক নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (পৃষ্ঠা- ৪০-৪৫), বঙ্গবন্ধু : কারাজীবন ও সংগ্রাম স্বাধীনতা (পৃষ্ঠা-৪০-৪৮), বাংলাদেশের রাজনীতি আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতি (পৃষ্ঠা-৩৬), বঙ্গবন্ধুর হত্যার দলিল (পৃষ্ঠা- ২৬৮-৭০), স্বাধীনতার বিপ্লবী অধ্যায় : বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য- ১৯৪৭-১৯৭১ (পৃষ্ঠা- ৫৭), আমি বঙ্গবন্ধুর কথা বলছি (পৃষ্ঠা-৩০, ৫৩-৫৫), জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড অনুমোদিত সিলেবাসের আলোকে ‘পৌরনীতি ও সুশাসন (পৃষ্ঠা-৫৯), বঙ্গবন্ধু কোষ (পৃষ্ঠা-৩৯২-৯৫) বইয়েও। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু নিজেও কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এসব কথা বলে গেছেন।

এদিকে বন্দী অবস্থায় কীভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কক্সবাজারের ইনানীতে আত্মগোপন করেছিলেন এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলেও বিকৃত ইতিহাসের পক্ষে অনড় সংশ্লিষ্টরা।

ইনানীতে বঙ্গবন্ধুর অজ্ঞাতবাস বিষয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের বয়ান আরও ভয়াবহ। ২০১২ সালের ৬ মার্চ তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. রুহুল আমিনের সভাপতিত্বে জেলা প্রশাসনের বৈঠকে ২১ নাম্বার সিদ্ধান্তে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু উখিয়ায় অবস্থানকালীন সময়ে তাকে আপ্যায়ন ও আশ্রয়দানকারী লোকমান হাকিম ও ছকিনা বেগমকে শুভেচ্ছা উপহার দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। যা ৭ মার্চ ২০১৬. ২০.২২০০.১১০. ১০.০০৫. ১৩.১৭৮ স্মারকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে পাঠানো হয়। পরবর্তী বছরও একই সময়ে একই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে সরকারের উর্ধ্বতন মহলে চিঠি দেয় জেলা প্রশাসন।

এর ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশুদিবস এবং ১৪ নভেম্বর মহান বিজয় দিবস উদযাপনের লক্ষ্যে পৃথক দুটি প্রস্তুতি সভায় তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) কাজী আবদুর রহমানকে আহ্বায়ক করে ইনানীর চেনছড়িতে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত স্থান সংরক্ষণ বিষয়ে পৃথক দুটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই সিদ্ধান্ত মতেই সামনে এগোচ্ছে জেলা প্রশাসন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জেলা প্রশাসনের আবেদনের প্রেক্ষিতে ইনানীতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণের জন্য ২০১৭ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে ‘মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থানসমূহ সংরক্ষণ ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জাদুঘর’ প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ৩৪ লাখ ৯০ হাজার ৯২৯ টাকা বরাদ্দ দেন। এর মধ্যে চলমান বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের অধিকাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

এর আগে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধু যার কাছে আশ্রিত ছিলেন বলে দাবি করা হয়েছে, সেই ফেলারাম চাকমার নাতি রবি অং চাকমা ২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসক বরাবরে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত জাদুঘর প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন ও অবৈধ দখল উচ্ছেদের আবেদন করেন।

আবেদনে উল্লেখ করেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেনছড়িতে আত্মগোপনে এসে আমাদের কাছে ছিলেন। আর প্রচার পাওয়া ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে জেলা প্রশাসনও উদ্যোগ নেয় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত হিসেবে চেনছড়িতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর স্থাপনের। সেখানে ইনানী মৌজায় ৫৭০৭ দাগে বসবাস করা বেশকিছু পরিবারকে উচ্ছেদ করে পাঁচ একর জমি দখলমুক্ত করে জাদুঘর নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু গবেষক ও কক্সবাজার সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ইনানীর বাসিন্দা ওয়াহিদুর রহমান রুবেল একুশে পত্রিকাকে বলেন, ১৯৫৮ সালে শামরিক শাসন জারির পর কক্সবাজারের ইনানীতে বঙ্গবন্ধু আত্মগোপন করেছিল বলে একটি কাল্পনিক, ভুয়া, মিথ্যা ও পিতা মুজিবের চরিত্রহননের গল্প প্রচার করেছে একটি স্বার্থন্বেষী মহল। তারা পরিকল্পিতভাবে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। বিষয়টি আমার গোচরে আসার পর বঙ্গবন্ধুকে হেয় করার কথিত ইতিহাস বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছি। প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে শুরু করে দায়িত্বশীল জায়গায় অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তুু পিতা মুজিবের চরিত্রহননের অপচেষ্টা বন্ধে কেউ এগিয়ে আসেনি।

প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোতে দেখা গেছে, ১৯৫৮ সালে তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে আবিষ্কার করা হয় লোকমান হাকিমকে। অথচ কক্সবাজার মহকুমা ছাত্রলীগের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৬১ সালের শেষের দিকে। এ কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কামাল হোসেন চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মোস্তফা (বর্তমানে কক্সবাজার জেলা বারের আইনজীবী)।

জয় বাংলা বাহিনীর কমান্ডার ও কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা কামাল হোসেন চৌধুরী একুশে পত্রিকাকে বলেন, কক্সবাজারে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ এটি আমারও দাবি। তবে যে গল্পের ভিত্তিতে ইনানীতে বঙ্গবন্ধুর নামে জাদুঘর নির্মাণ করা হচ্ছে তা মিথ্যাচার ও কল্পনাপ্রসূত। এমন উদ্ভট গল্প তৈরি করে মর্যাদাহানি ও বঙ্গবন্ধুকে ছোট করা হয়েছে। এটি কিছু মানুষের দুর্বিসন্ধি। নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা মনগড়া ইতিহাস তৈরি করেছেন। আমি এ বিষয়টি অনেকবার সংশ্লিষ্টদের নজরে দিয়েছি, তবে কোনও কাজ হয়নি।

তিনি আরও বলেন, ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি হলেও চেনছড়িতে গালগল্পের ইতিহাসে দেখলাম আমাদের আগেও লোকমান হাকিম নামে একজন ছাত্রলীগ নেতা রয়েছেন! অথচ তাকে চিনতামও না।

তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা কক্সবাজার জেলা বারের সদস্য অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ মোস্তফা বলেন, ১৯৬১ সালে আমি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হই। এরপর থেকে ২০০৯ সালের আগ পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক আড্ডায়ও বঙ্গবন্ধু আত্মগোপনে এসেছিলেন তা শুনিনি। ১৯৫৮ সালে যেখানে ছাত্রলীগের কার্যক্রমই ছিল না, সেখানে লোকমান হাকিম কীভাবে ছাত্রলীগের নেতা হন?

প্রবীণ সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা প্রিয়তোষ পাল পিন্টু বলেন, আত্মগোপনের বিষয়টি হাস্যকর। এই মিথ্যা ইতিহাসটি কিছু কিছু মানুষের অভিসন্ধি। তাই প্রকৃত ইতিহাস জেনে স্মৃতিসংরক্ষণ করলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ভালো হবে। আমার মনে হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জন্য বেশি প্রেম দেখাতে গিয়ে প্রকারান্তরে তাঁকে ছোট করা হচ্ছে।

কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক আইন বিষয়ক সম্পাদক ও কক্সবাজারের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, একজন মানুষ একই সময়ে কারাগারে ও কক্সবাজারে অজ্ঞাতবাসে থাকতে পারেন না। জেলা প্রশাসনের স্বাক্ষরেই জাদুঘরসহ সমস্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। তাই আমি আগেও অনুরোধ করেছিলাম এটি বাস্তবায়নের আগে প্রকৃত ইতিহাস জেনে নেওয়া দরকার ছিল।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্য রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই বার বার তাঁকে গ্রেফতার হতে হয়েছিল। রাজনৈতিক কারণে বঙ্গবন্ধু অনেকবার কক্সবাজারে আসেন। কিন্তুু তিনি ইনানীর চেনছড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন বলে যে ইতিহাস প্রচার করা হচ্ছে তা মোটেও সত্য নয়। কারণ যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মীর্জা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিয়ে যান। বঙ্গবন্ধুকে বির্তকিত করতে এ ধরনের কাল্পনিক কাহিনী প্রচার করে তাঁর নামে জাদুঘর করা হচ্ছে।

এটি বঙ্গবন্ধুর চরিত্রহননের শামিল ও ষড়যন্ত্রমূলক প্রচার বলে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৫৮ সালের ১৬ জানুয়ারি একবার ইনানীর রেস্ট হাউজে উঠেছিলেন। পরিদর্শন বইতে সফরসঙ্গীসহ তার স্বাক্ষর রয়েছে। তাই সংরক্ষণ যদি করতে হয় ইনানী রেস্ট হাউসকে স্মৃতি জাদুঘর করা যেতো।
বিতর্কিত গল্পের নেপথ্যে কী?

এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। স্থানীয়দের দাবি, ফেলারাম চাকমার নাতি রবি অং চাকমাসহ একটি চক্র মূলত জমি দখল করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে আশ্রয় দেওয়ার গল্পটি বানিয়েছে। এসব মিথ্যা গল্প বানাতে তাকে সহযোগিতা করেছেন কক্সবাজারের এক সাংবাদিক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক ব্যক্তি একুশে পত্রিকাকে জানান, চক্রটি জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে নুরুল হকের ৩০ বছরের পুরোনো বাড়ি উচ্ছেদ করে তিন একর জমি দখলে নিয়েছে। তার জমিতে একটি সুপারি গাছের বাগান রয়েছে। বাগানে ৫ হাজার সুপারি গাছ আছে। সেখান থেকে সুপারি বিক্রি করে প্রতিবছর ১০ লাখ টাকা আয় হতো নুরুল হকের। তাকে কোনও ধরনের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। বাগানটি এখন ভোগ করছে ওই চক্রটি। তবে রবি অং চাকমা দাবি করেন, ওখানে কারও জমি নেই, সব তার।

এদিকে, সেই ছকিনার মৃত্যু হলেও ভাই আবদুল হক স্বীকার করেছেন তার বোন ছকিনাকে টাকার বিনিময়ে বঙ্গবন্ধুর জন্য রান্নাবান্না করতেন বলে শেখানো কথাই বলিয়েছিল চক্রটি। আবদুল হক একুশে পত্রিকাকে বলেন, বঙ্গবন্ধু ইনানীর চেনছড়িতে কখনো আসেননি, আমার বোন ছকিনা বঙ্গবন্ধুকে চোখেও দেখেনি। ওইসময় আমার পরিবার ছিল বালুখালিতে। আমরা ইনানীতে এসেছি ৩০ থেকে ৩৫ বছর আগে।

আমার বোন ছকিনার বক্তব্য দেওয়ার বিষয়ে আমরা ভুল স্বীকার করে কক্সবাজার প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনও করেছিলাম। এরপরও মিথ্যা গল্পটি প্রচার করে বঙ্গবন্ধুকে ছোট করা হলে আমাদের দোষ কী? বলেন আবদুল হক।

কার নিয়ন্ত্রণে সে জাদুঘর?

ইনানীর চেনছড়িতে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে শর্তজুড়ে দেন ফেলারাম চাকমার নাতি রবি অং চাকমা। তিনি জানান, প্রথমত জাদুঘরে ঢুকার আগে অনুমতি লাগবে এক সাংবাদিকের। দ্বিতীয়ত তাদের বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর আশ্রয় ও জাদুঘর নিয়ে কোনও প্রশ্ন করা যাবে না। তবে তর্কের এক পর্যায়ে তিনি ওই স্থান ত্যাগ করেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, গহীন অরণ্যে চলমান জাদুঘরটির নির্মাণ কাজ প্রায় শেষের দিকে। তবে দীর্ঘদিন ধরে ঠিকাদারজনিত সমস্যার কারণে কাজ আপাতত বন্ধ রয়েছে। জাদুঘরের পাশেই একটি পুকুর রয়েছে। আর চারপাশে সুপারির বাগান ও একপাশে পাহাড়। সেখানে মাত্র তিনটি বসতি দেখা গেছে। ঘরগুলোয় আদিবাসী রবি অং চাকমা ও তার ভাইয়েরা থাকেন বলে জানা গেছে।

রবি অং চাকমার এক ভাইয়ের দেওয়া তথ্য মতে, বঙ্গবন্ধু যে তাদের বাড়িতে আশ্রয়ে ছিলেন সেটি তাদের বাবা এবং দাদার কাছে কখনো তারা শোনেননি। পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর ২০০৯ সাল থেকে তারা বিষয়টি জেনেছেন।

তবে রবি অং চাকমা দাবি করেন, তার ভাই এ ব্যাপারে কিছু জানেন না। কারাগারে থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু তাদের বাড়িতে কীভাবে এলেন জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিক তোফায়েল আহমেদের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন। স্থানীয়রা জানান, রবি অং চাকমার পরিবারের লোকজন জাদুঘরে কাউকে ঢুকতে দেয় না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিসি ও সাংবাদিকের ভয় দেখান বলে অভিযোগ তাদের।

ইনানীতে বঙ্গবন্ধুর আত্মগোপনের বিষয়ে কোনও ধরনের দালিলিক প্রমাণ তার কাছে নেই বলে স্বীকার করেছেন সেই প্রতিবেদক তোফায়েল আহমেদ। তিনি জেলা প্রশাসনের হলরুমে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবেও একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া বক্তব্যে জানিয়েছিলেন, শোনা কথার উপর ভিত্তি করে তিনি প্রতিবেদনটি করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত ইতিহাস নজরে আনার পরও

১৯৫৮ সালের জরুরি অবস্থা কিংবা ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার হুলিয়া নিয়ে পালিয়ে কক্সবাজারের ইনানীর তৎকালীন গহিন বন চেনছড়িতে বঙ্গবন্ধু আত্মগোপনে বা ‘অজ্ঞাতবাসে’ ছিলেন এমন একটি বানানো ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণে অবিচল কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন।

তিনি একুশে পত্রিকাকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে উপরের মহলে জানিয়ে সেখান থেকে একটি সমাধান আসলে ভালো হয়। এসময় মুক্তিযোদ্ধা কামাল হোসেনও উপস্থিত ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ক্ষতবিক্ষত ইতিহাসে আপত্তি নেই আওয়ামী লীগের?

এদিকে বঙ্গবন্ধুর ইনানীতে আত্মগোপন বিষয়টি মিথ্যা ও জাতির জনকের চরিত্রহনন করা হয়েছে স্বীকার করলেও রহস্যনজক কারণে এ বিষয়ে প্রতিবাদ বা উদ্যোগ নিতে রাজি নয় কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। এমনকি এ বিষয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য দিলে বিশেষ কারো ‘মনখারাপ’ হওয়ার ভয় অনেকের।

কক্সবাজার জেলা ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা ইনানীর বিষয়ে অবগত আছেন স্বীকার করে জানান, বিষয়টি নিয়ে দুটি পক্ষ হয়ে গেছে। এ জন্য তিনি এ ব্যাপারে বক্তব্য না দেওয়া উচিত মনে করেন। বিতর্কিত ইতিহাস সংশোধনের বিষয়ে উদ্যোগ নেবেন কিনা এমন প্রশ্নও এড়িয়ে যান তিনি।

বিষয়টি আওয়ামী লীগের প্রবীণতম নেতা ও বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব (পিএস) তোফায়েল আহমদের নজরে আনা হলে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে একুশে পত্রিকাকে বলেন, বঙ্গবন্ধু কোনওকালে কোথাও আত্মগোপন করেননি। তিনি কক্সবাজারে আওয়ামী পরিবারের কেউ বেঁচে আছে কিনা উল্টো প্রশ্ন করলেও ইতিহাস বিকৃতিকারীদের থামাতে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হবে কিনা জানাননি।

এদিকে, মুক্তিযোদ্ধারা ইনানীতে জাতির জনকের চরিত্রহনন বন্ধ ও প্রকৃত ইতিহাস সংরক্ষণ করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। একই সাথে যারাই জাতির জনকের চরিত্রহনন মিথ্যা গল্পের সাথে জড়িত তাদের শাস্তিও দাবি করেন তারা।