রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

মানুষ জন্মাচ্ছে তাও রাজনীতি, মানুষ মরছে তাও রাজনীতি

প্রকাশিতঃ ২৪ ডিসেম্বর ২০২০ | ৬:১৬ অপরাহ্ন


শান্তনু চৌধুরী :

প্রিয়তমা,
পূর্ণিমায় সমুদ্র দেখেছো কখনো? কিংবা বৃষ্টি ঝরতে? হুমায়ূন আহমেদের দারুচিনির দ্বীপ পড়ে মনে হয়েছিল এক দুর্দান্ত বন্ধু সার্কেল হবে আমার। এরপর পুরো বাংলাদেশ, পুরো পৃথিবী চষে বেড়াবো। নিশ্চয় আমার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক দেখে বুঝতে পারো কী যে ঘোরার নেশা আমার।

মহেঞ্জোদারো, পূর্ণিমায় সেন্টমার্টিন, চা বাগান, দুর্দান্ত বগালেক, তাজিংডং বা আলুটিলা। পাশের দেশে ডুয়ার্সের জঙ্গল, রাজা রাজড়ার গন্ধমাখা কোনো পোড়াবাড়ি? পাহাড়টাকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝেই। আল্পস ছোঁয়া যাবে কখনো, হিমালয়ের এভারেস্ট? অন্নপূর্ণায় সূর্যোদয় দেখেছিলাম নেপালে গিয়ে। সেই থেকে মুগ্ধতা লেগে আছে চোখেমুখে। এমন সব মাতাল স্বপ্ন আমার হাওয়াতেই ভাসে। মহামারি করোনা এসে পাল্টে দিয়েছে পুরো পৃথিবী। কতো কতো কী দেখার বাকি আছে, এক জীবনে সব কি আর দেখা সম্ভব?

তবে আশার কথা, করোনা ভ্যাকসিন এসে যাচ্ছে। দ্রুত টিকা নিয়ে মানুষ হয়তো আবার ফিরে যাবে স্বাভাবিক জীবনে। সারাবিশ্ব আজ অপেক্ষায় একটি কার্যকর করোনা টিকার জন্য। অথচ ভাবতে অবাক লাগে, পৃথিবীতে প্রথম ভ্যাকসিন আসার দিন পরিস্থিাতি ছিল উল্টো। ডাক্তার এডওয়ার্ড জেনার তাঁর তৈরি ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পরও, লন্ডনে দোরে দোরে ঘুরেও প্রথমে কাউকে রাজি করাতে পারেননি ভ্যাকসিন নিতে।

একে গেঁয়ো ডাক্তারের তৈরি ভ্যাকসিন, আর তার উৎস গরুর শরীরের বসন্তের পুঁঁজ। ভয়ঙ্কর এক অসুখের প্রতিবিধান নাকি পাওয়া গেছে সামান্য গোয়ালিনিদের গল্পকথার মধ্যে! বিতৃষ্ণা, তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সবাই। মজার ব্যাপার, জেনারের কাঁটা-বিছানো পথে ফুল ছড়িয়ে দিতে এগিয়ে এসেছিলেন ইংল্যান্ডের রোম্যান্টিক যুগের কয়েকজন কবি! যখনই কোনও বাধা আসে, ছেদ ঘটে অভ্যাসে। খুলে যায় অন্য দিক। মুক্তি ঘটে একঘেঁয়েমি থেকেও। আশা-নিরাশার মধ্যে মানুষের আত্মশক্তি তৈরি হয়। কঠিন সময়ে তা ঝলক দিয়ে ওঠে।

পশ্চিমবঙ্গের বাউল শিল্পী সুভদ্রা শর্মা তাই সরল রসিকতা মিশিয়ে এই সময়েই লেখেন, ‘ও সোনা ও মনা ও করোনা/এই কথাটি শোনো না, জীবন নিয়ে টানাটানি আর কোরো না।’ এটা হয়তো মজা করে লেখা। কিন্তু জীবন মানেইতো আর জি বাংলা নয়, জীবন নিয়ে টানাটানি।

তোমার কী খবর বলো? চট্টগ্রামের এক হাটহাজারী মাদ্রাসাইতো বেশ আলোচনায়। এখন প্রথমত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ ইস্যুতে তারা বেশ সরব। মূর্তি আর ভাস্কর্যকে তারা এক করেছে ফেলেছে। অথচ এই দেশটা এতো উগ্র এক দুইযুগ আগেও ছিল না। ধর্মকে হাতিয়ার করলে এবং তার উপর ভিত্তি করে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা হতে চাইলে, ক্ষমতায় যেতে চাইলেই সম্ভবত উগ্রবাদীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এবং তার খেসারত দিতে হয় রাষ্ট্র তথা জনগণকে।

বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখনো ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছি। একদিকে রেমিটেন্স বাড়ছে অন্যদিকে উগ্রবাদ বাড়ছে। অথচ পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে যারা আধুনিক ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী তারা উগ্রবাদকে বিদায় জানাচ্ছে। আর যারা জানাতে পারছে না তাদের পরিণতি হচ্ছে পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মতো। সহজেই তাদের পরবর্তী টার্গেট যে বাংলাদেশ এটা বোঝা যায়। তারা ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে বলে, অথচ সভ্য মুসলিম দেশগুলো ভাস্কর্যের ছড়াছড়ি। তারা এটা বোঝে না ভাস্কর্য কোনো পূজার জিনিস নয়, সম্মান জানানো এবং সভ্যতার স্মারক।

এই যে দেখ, ইন্দোনেশিয়ার বালিতে এতো এতো হিন্দু দেবতার ভাস্কর্যের ছড়াছড়ি সৌদি যুবরাজ যখন সেই দেশটিতে গিয়েছিল তখনো কিন্তু তারা সেগুলো ঢেকে দেয়নি। আর আমাদের দেশের মৌলবাদীরা সবকিছু ঢেকে দিয়ে পুরো দেশকে নিয়ে যেতে চায় অন্ধকারের দিকে। তুরস্কের মতো মুসলিম সভ্যতার দেশ তাদের দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ করতে চায় আর আমাদের মৌলবাদীরা নিষিদ্ধ করার মতো সাহস দেখায় শাড়িকে। অথচ শাড়িতে বাঙালি নারী কতোটা সুন্দর সেটাতো তোমাকে দেখলেই বোঝা যায়। আর তাদের নাকি চোখ যায়, নারীর তলপেটের দিকে! আবার এদের গুরু আহমদ শফীর মৃত্যু নিয়েও ঘোলাটে হয়ে উঠেছে পরিস্থিাতি। তাকে মেরে ফেলা হয়েছে এমন অভিযোগে মামলা হয়েছে ইতোমধ্যে।

তবে আশার কথা মৌলবাদের বিরুদ্ধে মানুষ জাগছে। প্রতিরোধ, প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে উঠছে। বিজয়ের এই মাসে এসে তাদের আস্ফালন আর কতোটুকু মেনে নেওয়া যায়। তবে এই জেগে উঠাকে বোধহয় একটু ভিন্নভাবে দেখছেন নাগরিক ঐক্যের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি সম্প্রতি বলেছেন, ‘মানুষ যে রকম করে জাগছে। আমি এটা আশা করি, এটা অলীক আশা করছি না। আপনারাও দেখছেন, মানুষ প্রতিবাদমুখর হচ্ছে, মানুষ এটা চায় না। মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে চায়। আমাদেরকে তাদের নিয়েই ঘুরে দাঁড়াতে হবে। আমরা জিতে ফেলব’।

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতার একটি লাইন মনে পড়ে গেল, ‘গাঁজা খাওয়ার অভ্যাস বোধহয় করেনি। মাইরি! ওটা বড় চমৎকার জিনিস’। গাঁজার প্রসঙ্গ যখন এলোই তোমাকে একটু জ্ঞান দেই। গাঁজা নিয়ে প্রথম লেখেন চিনা স¤্রাট শেন নুং। ২৭৩৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তিনি গাঁজার ভেষজ গুণ নিয়েই লিখেছিলেন। আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আশপাশে লেখা অথর্ব বেদ, গাঁজাকে স্বীকৃতি দিয়েছে পবিত্র ঘাস হিসেবে। সমুদ্র মন্থনকালে অমৃত থেকে গাঁজা গাছের উৎপত্তির উল্লেখ রয়েছে। বাংলায় গাঁজার আনুষ্ঠানিক বা সরকারি কৃষিকর্ম শুরু হয় ১৯০৬ সালে বাংলাদেশের ‘নওগাঁ গাঁজা সোসাইটি’র মাধ্যমে। টেকচাঁদ ঠাকুরের ‘মদ খাওয়া বড় দায়, জাত থাকার কী উপায়’ গ্রন্থের শুরুটাই তো মদ নয়, সেই গ্রামীণ গাঁজা বচনে।

প্রিয়তমা, আবুল হাসানের সেই কবিতাটার কথা মনে আছে, ‘মানুষ চাঁদে গেল, আমিও ভালোবাসা পেলাম, পৃথিবীতে তবুও হানাহানি থামল না।’ চীনের চ্যাং’ই-৫ মিশন চাঁদ থেকে পৃথিবীতে ফিরেছে। চাঁদ থেকে পাথর ও মাটির নমুনা নিয়ে এসেছে। চন্দ্র অভিযানে চীন বেশ এগিয়েছে বলা যায়। কিন্তু পরকীয়া প্রেমের অভিযানে কতোটা এগিয়েছি আমরা? মানে আমি আর তুমি। ভারতীয় আদালত কিন্তু পরকীয়াকে সমর্থন করে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

অনেকে এটিকে নারীকে সম্মান দেওয়া হিসেবে দেখতে চান। কারণ স্বকীয়া বা পরকীয়া কোনো ব্যাপার নয়, প্রেম বা আকর্ষণটাই বড়। রাধাকৃষ্ণের প্রেমের কাহিনী আমরা আদর করে পড়ি, তাহলে পরকীয়াতে আপত্তি করব কেন? তবে মূল কথা হলো নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, স্বাবলম্বন ও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা ছাড়া মুক্তি সম্ভব নয়। পরকীয়াতে তো আর নারীর মুক্তি হতে পারে না।

আমাদের দেশে এখন সমস্যা হচ্ছে যে কোনো বিষয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে রাজনীতি। সেটা অন্দরমহল থেকে যেন শুরু। ভারতীয় মেগা সিরিয়াল ইথারে ভেসে ঘরের রাজনীতিতে নাক গলাচ্ছে। আর দেশের রাজনীতির কূটকচালে জেরবার আমাদের কূটনীতি। নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়, ‘গোলাপ ফুটছে তাও রাজনীতি, গোলাপ ঝরছে তাও রাজনীতি! মানুষ জন্মাচ্ছে তাও রাজনীতি, মানুষ মরছে তাও রাজনীতি’!

কিন্তু রাজনীতির শক্র মিত্র কারা এটা জানা বেশ জরুরি দেশের পক্ষে। বিজয়ের এই মাসে বলতে হয়, শত্রুরা ঐক্যবদ্ধ। আর আমাদের চলছে নানা মতে, নানা পথের দলাদলি। ওরা দিচ্ছে কূটকচাল। আমরা করছি কূটতর্ক। একাত্তরে যারা এক সঙ্গে ছিল এখন তারা একসঙ্গে নেই। পরাজিতরা জেতার জন্য ক্রমাগত কৌশল বদল করে ঘায়েল করছে। দৃশ্যপট পাল্টাতে হবে। যেমন টিকে থাকার জন্য পাল্টাচ্ছে করোনা ভাইরাস আর নিজেদের অস্তিত্ব, সভ্যতা আর ইতিহাস রক্ষায় আমাদেরও পাল্টাতে হবে মৌলবাদের বিপক্ষে লড়তে।

লেখক: শান্তনু চৌধুরী : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক