জোবায়েদ ইবনে শাহাদত : সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সীমান্ত বাজার এলাকার পেট্রোল পাম্পের পাশে গত বুধবার (৯ ডিসেম্বর) মারা যায় একটি হাতি।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে হাতিটির মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করা হলেও হাতিটি আসলে কীভাবে বা কোন কারণে মারা গেছে এর সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারেনি বন বিভাগ ও প্রাণী সম্পদ বিভাগ।
৭০ বছর বয়সী হাতিটির সারা দেহজুড়ে ছিল দগদগে ক্ষত, যেখান থেকে খসে পড়েছিল চামড়া। হাতিটির মাথা ও কানের ক্ষতগুলো দেখে বোঝা যাচ্ছিল কোনো রোগ নয়, শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েই এসব ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, সংকটাপন্ন হাতিটিকে সুদূর নওগাঁ থেকে হাঁটিয়ে সিরাজগঞ্জে আনা হয়েছিল। আসার সময় পথের সকল দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে টাকাও তোলা হয়েছে হাতিটির মাধ্যমে। আর এই অভিযোগটি সত্যি বলে স্বীকার করেছেন হাতির মাহুত সোহেল রানা।
বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী, হাতি লালন-পালনের শর্তাবলীতে পোষা হাতি লালন-পালন সংক্রান্ত তথ্য একটি রেজিস্ট্রারে সংরক্ষণ করতে হবে। হাতি দিয়ে হাট-বাজার, রাস্তা-ঘাট, লােকালয় বা বালাদেশের অভ্যন্তরে কোনো স্থানে চাঁদা সংগ্রহ করা যাবে না এবং হাতির মালিককে তার হেফাজতে থাকা সকল হাতিকে মাইক্রোচিপস দিয়ে ‘টেগিং’ করতে হবে।
কিন্তু এই হাতিটির ক্ষেত্রে লঙ্ঘন করা হয়েছে উল্লেখিত আইনের সবকটি। হাতিটির মাহুত সোহেল হোসেন জানান, হাট-বাজার থেকে চাঁদা সংগ্রহ করতে করতে আসা হাতিটির ছিল না কোনো টেগিং। লালন-পালন সংক্রান্ত কোনো রেজিস্ট্রারে ছিলো না।
শুধু তাই নয়, হাতিটি মারা যাওয়ার পর থেকে সংরক্ষণের এই সময়কালে এর মালিকানা দাবি করেননি কেউই। তাই পোষা এই হাতির মালিকানা নিয়েও উঠেছে বেশকিছু প্রশ্ন। হাতির মাহুত সোহেল রানা জানান, হাতিটির লিজ গ্রহীতা নওঁগা ধামুরহাট এলাকার দুলাল হোসেন। তার থেকেই হাতিটি ভাড়া নিয়েছিলেন তিনি।
তবে দুলাল হোসেনের ভাষ্যমতে, হাতিটি তিনি লিজ নেননি, মৌলভীবাজার জেলার জুরী উপজেলার আব্দুল জলিল নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছেন। কানা মানিক ছাড়াও আর ৫টি হাতি দেখাশোনা করেন এই জলিল। কিন্তু হাতিগুলোর মালিক জলিল কিনা সেই বিষয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে হাতিটির কথিত মালিক আব্দুল জলিলকে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
এদিকে অভিযোগ উঠেছে, মৃত্যু রহস্য উন্মোচনে আগ্রহ না থাকলেও মৃত হাতিটির হাড় এবং চামড়া সংরক্ষণই সংশ্লিষ্টদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। হাতির দেহের হাড় ও চামড়া কোথায় যাবে তা সিদ্ধান্ত নেয়া ছিল অনেক আগে থেকেই। যার কারণে হাতিটির ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরির নির্দেশনা দেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
পরিবেশবাদী সেচ্ছাসেবী সংগঠন সেভ দ্যা ন্যাচার অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান আ. ন. ম. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, হাতিটি নওগাঁ থেকে সিরাজগঞ্জের জনমানবশূন্য এলাকায় আনা থেকে শুরু করে সেটির মৃত্যু পর্যন্ত সবকিছুই ছিল পরিকল্পিত। হাতির দেহটি জাদুঘরে সংরক্ষণ করতে এটি ছিল সাজানো নাটক।’
তিনি বলেন, ‘হাতিটির সারা দেহের ক্ষতবিক্ষত চিহ্ন কেন হয়েছিল এবং কিভাবে মারা গেল তা লুকাতেই এই সংরক্ষণের প্রক্রিয়া। হত্যাকারী বন বিভাগের পার্মিটধারী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও হবে না। সার্কাসের নামে পজিশন সার্টিফিকেট নিয়ে সারা দেশে ভিক্ষা করানোর কোনো শাস্তি হবে না, কারণ হাতি মরলেও লাখ টাকা।’
হাতিটি সংরক্ষণ করা হবে এই কথা জানলেও শেষ পর্যন্ত কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সেই বিষয়ে আর খোঁজ নেননি বলে জানান সিরাজগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আখতারুজ্জামান ভূঁইয়া। একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি হাতি মারা যাওয়ার বিষয়ে শুনেছিলাম। হাতিটির শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ সংরক্ষণ করা হবে বলে জেনেছি। শেষ পর্যন্ত কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা আমার জানা নেই।’
এদিকে, হাতিটির চামড়া ও হাড় সংরক্ষণ করা হয়েছে দুটি জাদুঘরে। বঙ্গবন্ধু সেতু আঞ্চলিক জাদুঘরে হাতিটির চামড়া আর পদ্মা সেতু জাদুঘরে হাড় রাখা হলেও এসব মূল্যবান অঙ্গ সংরক্ষণের অনুমতি কে দিয়েছে সেই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি দুটি জাদুঘরের কোনো কিউরেটর।
বঙ্গবন্ধু সেতু আঞ্চলিক জাদুঘরের কিউরেটর জুয়েল রানা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা হাতিটির মৃত্যুর খবর পেয়ে এটিকে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পদ্মা সেতু জাদুঘর ও আমাদের যৌথ প্রচেষ্টায় আমরা এই কাজ করতে সক্ষম হয়েছি। এই মূহুর্তে চামড়া সংরক্ষণের কাজ আমরা করছি।’
বন বিভাগের অনুমতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা অনুমতির বিষয়টি জানি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হাতিটি সংরক্ষণের অনুমতি নিয়েছে। আমরা শুধুমাত্র টেকনিক্যাল সহায়তা দিয়েছি।’
পদ্মা সেতু জাদুঘরের কিউরেটর আনন্দ কুমার দাশ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘৩০ জন ৩৬ ঘন্টার চেষ্টায় আমরা পঁচে যাওয়ার আগেই হাতিটির হাড় ও চামড়া সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছি। হাতিটি সংরক্ষণের অনুমতি আমরা নেইনি। বন বিভাগ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি নেয়ার মাধ্যমেই সংরক্ষণের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।’
এদিকে হাতির দেহ কেটে হাড় ও চামড়া সংরক্ষণের বিষয়ে সিরাজগঞ্জ সামাজিক বন বিভাগ কর্মকর্তা ও পাবনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমানকে একেবারেই অবগত করা হয় নি, এমনটাই দাবি তাদের।
সিরাজগঞ্জ সামাজিক বন বিভাগের কর্মকর্তা দেওয়ান শহিদুজ্জামান একুশে পত্রিকাকে বলেন, হাতির মৃত্যু থেকে শুরু করে পরে জাদুঘরে সংরক্ষণের কথা আমাদের কেউই জানায়নি। স্থানীয় বন বিভাগের কোনো কর্মকর্তাকে না জানিয়ে জাদুঘরে সংরক্ষণ কোন এখতিয়ারে হয় তা আমার জানা নেই। তবে আমি বিষয়টা নিয়ে এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
জানতে চাইলে পাবনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘হাতির মৃত্যু এবং জাদুঘরে সংরক্ষণের কথা আমি আপনার কাছেই প্রথম শুনেছি। এরকম হওয়ার কথা নয়। আমি খোঁজ নিয়ে এই বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’