সব ধর্মের ‘তীর্থস্থান’ ও একটি স্বপ্ন


আছিয়া খাতুন : বোয়ালখালীতে কাজ করতে গিয়ে জানার সুযোগ হয় উপজেলার শ্রীপুর-খরণদ্বীপ ইউনিয়নে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী শ্রীপুর বুড়া মসজিদ সম্পর্কে। ইউএনও হিসেবে অফিসিয়াল মোতোয়াল্লীর দায়িত্বে থাকায় সরেজমিন জানার পরিধি কিছুটা বিস্তৃত হয়। অপার বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল ধর্মের মানুষের কাছে মসজিদটি একধরনের তীর্থস্থান হিসেবে সমাদৃত।

প্রতি জুমায় দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য মুসল্লী নামাজ আদায় করতে ছুটে আসেন এ মসজিদে। বিভিন্ন মানত করে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষ এখানে ছুটে আসেন। কেউ মোমবাতি জালিয়ে, কেউ চুন লাগিয়ে, কেউ রশি বেঁধে, কেউ টাকা-পয়সা দান করে, কেউবা পশুপাখির সদকা দিয়ে মানত করেন। মনোবাসনা পূরণের জন্য এ মসজিদে মানত করলে তাৎক্ষণিক ফল পাওয়া যায় বলেও বিশ্বাস করেন অনেকেই।

মসজিদটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও বেশ তাৎপর্যময়। যতদূর জানা যায়, মোঘল আমলে শেখ নাছির উদ্দিন নামক একজন আলেম ভারতের গৌড় থেকে অমুসলিম অধ্যুষিত এ এলাকায় এসে দ্বীন প্রচারের মাধ্যমে মানুষজনকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।

প্রায় ৩শ’ বছর পূর্বে মোঘল আমলের শেষ দিকে তাঁর পৌত্র ওয়াসিন চৌধুরী এ মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন বলে কথিত আছে। ঝোঁপ-ঝাড়ের মাঝে শনপাতার বেড়া ও ছাউনি দিয়ে তৈরি এ মসজিদটিতে গায়েবী আজান শোনা যেত, বন্যপ্রাণী পশুপাখিরাও এ মসজিদে ইবাদত করত বলে জনশ্রুতি রয়েছে। কালের সাক্ষী হয়ে বিভিন্ন সময় সংস্কার ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে মসজিদটি বর্তমান পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।

ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ মসজিদটির পরিচালনায় নিযুক্ত ব্যক্তিদের অবহেলা ও অদক্ষতায় বহু বৎসর যাবত মসজিদটিতে অবকাঠামোগত কোনও উন্নয়ন করা হয়নি। সংস্কার ও পরিচর্যার অভাবে বর্তমান ভবনটি অত্যন্ত জীর্ণ ও ঝাঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে, বেশ কয়েক জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে, জুমাবারে মুসল্লীদের স্থান সঙ্কুলান কঠিন হয়ে পড়েছে।

২০০০ সালে ওয়াকফ এস্টেট হিসেবে ইসি তালিকাভুক্ত হওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে মোতোয়াল্লীসহ কতিপয় ব্যক্তিবর্গের যোগসাজশে মসজিদের দানবাক্সের টাকা আত্মসাৎ হয়। ২০১৪ সালে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার খন্দকার নূরুল হক স্যারের উদ্যোগে এ দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং সে প্রেক্ষিতে ওয়াকফ প্রশাসন কর্তৃক উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে মসজিদের অফিসিয়াল মোতোয়াল্লী নিয়োগ করা হয়।

প্রশাসনিক কাজে যতবারই মসজিদটি পরিদর্শনের সুযোগ হয়েছে আমি পবিত্র এ স্থানটি সংস্কার করার তাগিদ অনুভব করেছি তীব্রভাবে। স্বপ্ন দেখেছি যদি সুন্দর একটি পরিকল্পনা করে অনন্য স্থাপত্যশৈলী দিয়ে আধুনিক ল্যান্ডস্কেপসহ মসজিদটি পুন:নির্মাণ করা হয় তবে তা শুধু চট্টগ্রাম নয়, সারাদেশের মানুষের জন্য আকর্ষণীয় পূণ্যস্থান হিসেবে খ্যাতি লাভ করবে।

স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ হিসেবে দেশের স্বনামধন্য একটি ডিজাইন ফার্মের মাধ্যমে আমাদের আবেগ ও ভাবনার প্রতিফলনে পুরো মসজিদ কমপ্লেক্সের একটা মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয়েছে। যেখানে দৃষ্টিনন্দন ও আধুনিক স্থাপত্য নকশায় সুউচ্চ মিনারসহ চারতলা মসজিদ ভবন ছাড়াও রয়েছে সুপ্রশস্ত প্রবেশদ্বার, ঈদগাহ, কবরস্থান, এতিমখানা ও মাদ্রাসা সম্বলিত একাডেমিক ভবন, বৃহৎ পরিসরে ওযুখানা, মহিলা ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের জন্য পৃথক এবাদতখানা, রান্নাঘর, ডাইনিং হল, কার পার্কিং, সর্বোপরি মসজিদ সংলগ্ন পুকুরটি সংস্কার করে সুদৃশ্য পুকুরঘাট, ওয়াক ওয়েসহ অনন্য সাধারণ ল্যান্ডস্কেপ।

লেখক : বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম।