বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১

‘এমন মহিউদ্দিন চৌধুরী’কে কখনো দেখিনি!

প্রকাশিতঃ ২০ ফেব্রুয়ারী ২০১৭ | ২:০২ অপরাহ্ন

আজাদ তালুকদার : ২০১০ সালে শিষ্য মনজুর আলমের কাছে পরাজিত হওয়ার পরও এক মুহূর্তের জন্য মাঠ ছাড়েননি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তিন তিনবারের মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। আরেকবার মেয়র হওয়ার ইচ্ছার সলতেটি জ্বালিয়ে রাখেন। নগরপিতার চেয়ারে বসে অপূর্ণ, অধরা স্বপ্নগুলোর ঘুড়ি উড়াবেন। কিন্তু ঘুড়ির নাটাই যে লাগবে! ধরতে হবে সেই নাটাই! সেজন্য প্রয়োজনের চেয়েও ঢের ব্যাকুল ছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। বলা চলে মরিয়া।

তাই দলীয় ঘোষণার আগেই চট্টগ্রাম ১৪ দলের মিটিংয়ে নিজেই নিজেকে মেয়রপ্রার্থী ঘোষণা করে দিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। নগরে আগাম নির্বাচনী অফিস খোলে বসেন। শেষতক সব আয়োজন, সব ঘোষণা আটকে গেলো গণভবনের কাছে।

মনোনয়নপ্রত্যাশীদের গণভবনে ডেকে নিয়ে কেন্দ্রীয় ও চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের সামনে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনকে মেয়রপ্রার্থী ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে অন্য দুই মনোনয়ন-প্রত্যাশী মহিউদ্দিন চৌধুরী ও নগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ সিডিএ চেয়ারম্যান আব্দুচ ছালামকে দলের মনোনীত প্রার্থীর (আ জ ম নাছির) পক্ষে কাজ করতে নির্দেশ দেন।

দলীয় প্রধানের সেই নির্দেশ মানতে বাধ্য হন। কিন্তু একবুক কষ্ট নিয়ে চট্টগ্রাম ফেরেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। একে তো জীবনের শেষ স্বপ্নের মৃত্যু, তার উপর রাজনীতির মাঠে আ জ ম নাছির তার প্রতিপক্ষ, সম্পর্কটা তাদের সাপে-নেউলে তিন দশক ধরে।

এসব কারণে অনেকেই ভেবেছিলেন শেষপর্যন্ত শেখ হাসিনার নির্দেশ না মেনে মহিউদ্দিন চৌধুরী বিদ্রোহ করতে পারেন, প্রার্থী হতে পারেন দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেরকম কিছু দেখতে হয়নি চট্টলবাসীকে।

এদিকে, দলের মনোনয়ন পাওয়ার দুইদিনের মাথায় মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসায় সদলবলে হাজির হন আ জ ম নাছির। সারাদেশের মানুষের দৃষ্টি তখন এই দুই নেতার দিকে।

মহিউদ্দিন চৌধুরী কীভাবে নিচ্ছেন নাছিরকে তাই-ই ছিল মূলত সবার কাছে কৌতূহল ও আগ্রহের বিষয়। মাঠের রিপোর্টার হিসেবে সেই দৃশ্য-পরিবেশের সাক্ষী হতে আমারও সকাল থেকে অপেক্ষা মহিউদ্দিন চৌধুরীর চশমা হিলের বাসভবনে।

নাছির যখন বাসায় পৌঁছেন তখনো শারীরিক, মানসিক বিধ্বস্ততার ছাপ মহিউদ্দিনের চোখেমুখে। মনে হচ্ছে এই বুঝি অগ্নিশর্মা হয়ে উঠবেন, উল্টাপাল্টা কিছু বলে ফেলবেন। কিন্তু না! শেষপর্যন্ত যথেষ্ট শান্ত ও সাবলীল থাকতে দেখা যায় মহিউদ্দিন চৌধুরীকে। মহিউদ্দিনের পা ছুঁয়ে সালাম করেন আ জ ম নাছির। মিষ্টি আর ফলমূলে আপ্যায়িত হলেন নাছির ও তার সহকর্মীরা।

মহিউদ্দিন চৌধুরী জানতে চাইলেন নির্বাচন পরিচালনা কমিটি কীভাবে করা হচ্ছে, কারা থাকছেন সেখানে। নাছির বললেন, আপনি (মহিউদ্দিন) চেয়ারম্যান। সদস্য সচিব ইসহাক মিয়া।

মহিউদ্দিন চৌধুরী বললেন, না, আমি নই। ইসহাক মিয়াকে চেয়ারম্যান করো। আমি সদস্য সচিব থাকবো। এসময় নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে রাজনীতিবিদ ছাড়াও নানা শ্রেণীপেশার প্রতিনিধিত্ব অন্তর্ভুক্তির বিষয়টিও উঠে আসে দুই নেতার আলোচনায়। আর এসব আলোচনার পুরোটাই সবার আগে ‘লাইভ’ সম্প্রচার করে একাত্তর টেলিভিশন। টিভির কল্যাণে দেশের মানুষ মুহূর্তেই জানতে পারে মহিউদ্দিন শান্ত আছেন, বিদ্রোহ আপাতত করছেন না।

এরপর মহিউদ্দিন চৌধুরী নির্বাচন সংক্রান্ত দলীয় অনুষ্ঠানগুলোতে নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে অংশ নিচ্ছেন, টুকটাক কথাও বলছেন দলের প্রার্থীর পক্ষে। কিন্তু সেই অংশগ্রহণে যেন ‘প্রাণ’ নেই। কোথায় যেন সঙ্কট, ঘাটতির বিষয়টি স্পষ্ট আমার কাছেও।

নির্বাচনী ডামাঢোল আর প্রচার-প্রচারণায় উৎসবের আমেজ পুরো নগরজুড়ে। আওয়ামী লীগ-বিএনপির দুই প্রার্থীর পক্ষে কখনো সমন্বিত কখনো ব্যক্তিগত গণসংযোগে মাঠ-ঘাট চষে বেড়াচ্ছেন স্ব স্ব দলের কেন্দ্রীয় ও শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ।

নির্বাচনের বাকি মাত্র ৭ দিন। কিন্তু একটিবারের জন্যও আ জ ম নাছিরের পক্ষে গণসংযোগে যাননি মহিউদ্দিন চৌধুরী। রাজনীতি-সচেতনজনদের মতো আমার মাঝেও তৈরি হয় এই প্রশ্ন। প্রতিদিনই নিত্য নতুন নির্বাচনী স্টোরির ভিড়ে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ‘নিউজটি’ আমার মাঝে ঘুরপাক খেতে থাকে। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে নিশ্চিত ক্ষেপে যাবেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। করতে পারেন গালমন্দও। তাই একটা যুঁৎসই পরিবেশ খুঁজছিলাম।

নির্বাচনের ৬ দিন আগে ২২ এপ্রিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে আ জ ম নাছির উদ্দীনের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করা হবে। সেখানে উপস্থিত থাকবেন কেন্দ্রীয় এবং চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ। মহিউদ্দিন চৌধুরীও থাকবেন তাতে। আমি সুযোগটির অপেক্ষায় থাকলাম।

সকাল ১১ টায় শুরু হবে অনুষ্ঠান। ক্যামেরা, টাইপড, লাইভ ডিভাইস নিয়ে আগেভাগেই অবস্থান নিই অনুষ্ঠানস্থলে। ১১টা বাজতেই দেখি ডজনখানেক কেন্দ্রীয় নেতা, মেয়রপ্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দীন, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ চট্টগ্রামের শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতাদের উপস্থিতিতে পুরো মঞ্চজুড়ে যেন আলোর বিচ্ছুরণ হচ্ছে। ১০ হাজার মানুষে গিজগিজ করছে হলরুম। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের বাইরের আঙ্গিনা, রাস্তায়ও ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের ভিড়।

আ জ ম নাছির তার নির্বাচনী অঙ্গীকার উপস্থাপন করলেন নগরবাসীর সামনে। এরপর সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরপর্ব। তার কাছে অন্য সাংবাদিকদের দুটি প্রশ্নের পর তৃতীয় প্রশ্নকর্তা হিসেবে মাইক্রোফোন হাতে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম।

বললাম, আমার প্রশ্নটি সাবেক মাননীয় মেয়র, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কাছে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ায় পুরো হল। মুহূর্তেই পিনপতন নীরবতায় মনে হলো আমার দিকেই পুরো হলভর্তি মানুষের মনোযোগ।
‌‌
-‘আমরা জানি, আপনি মেয়র পদে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। এজন্য চেষ্টাও অনেক করেছেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত দলের মনোনয়ন পান আ জ ম নাছির উদ্দীন, যার সঙ্গে আপনার বিরোধ-বিসম্বাদ দীর্ঘদিনের। মনোনয়ন না পাওয়ার কষ্ট, চির রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-বিবাদ ছাপিয়ে আপনি আ জ ম নাছির উদ্দীনের পক্ষে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। নির্বাচনের আর মাত্র ৬ দিন বাকি। কিন্তু এখনো পর্যন্ত আপনি তার পক্ষে কোনো গণসংযোগ করেননি, মাঠে নামেননি। এই অবস্থায় জনমনে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। এই প্রশ্নে আপনার বক্তব্য কী হবে?’

প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই হলজুড়ে করতালির ধুম। অনেকটা বিব্রত, ভ্যাচাচেকা খেয়ে যান মহিউদ্দিন চৌধুরী। এরপরও উত্তরটা নিজেকে সামলিয়ে, গুছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। বলেন, ‘এটা আমাদের একধরনের রাজনৈতিক কৌশল। সবাইকে মাঠে-ময়দানে গণসংযোগ করতে হবে এমন কথা নেই। কেউ মাঠে থাকবে, আর কেউ অভ্যন্তরীণ কৌশলগুলো ঠিক করবে। আমি গণসংযোগে না থাকলেও দলীয় ফোরাম ও মিটিংয়ে দলের প্রার্থীকে জেতানোর জন্য কাজ করছি।’

মহিউদ্দিন চৌধুরীর এই উত্তরে অভ্যাগতরা যতটা না খুশি, তার চেয়ে বেশি খুশি এবং উচ্ছ্বসিত মনে হলো আমার প্রশ্নে। বিষয়টা আরও বেশি বুঝতে পারি অনুষ্ঠান শেষ করে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন থেকে বের হওয়ার সময়। আওয়ামী পরিবারের শতাধিক মানুষ আমাকে ঘিরে তাদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিলেন; কেউ জড়িয়ে ধরে কেউ বা কাধে তুলে। কেউ কেউ সাহসের প্রশংসা করলেন। বললেন, অত্যন্ত সাহসী ও প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। এটা নাকি তাদেরও মনের প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা।

মজার ব্যাপার হলো, প্রশ্নের উত্তরে গণসংযোগ না করাটা ‘কৌশল’ দাবি করলেও পরদিনই মহিউদ্দিন চৌধুরী আ জ ম নাছিরের পক্ষে গণসংযোগ করতে মাঠে নামেন। মিডিয়ায় নিউজ হলো- অবশেষে আ জ ম নাছিরের জন্য মাঠে নামলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী।

প্রশ্ন করার সময় মহিউদ্দিন চৌধুরী তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও পরবর্তীতে আমাকে নিয়ে তাঁর ক্ষোভ প্রকাশের কথা ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সংবাদর্মীর মাধ্যমে আমার কানে আসে। মহিউদ্দিন চৌধুরীর দরজা কি তাহলে আমার জন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে গেলো?

নিউজের প্রয়োজনে তাকে দরকার। কী করেই বা সহসা তার মুখোমুখি হই? পড়লেই তো মহাপ্যাঁচাল বাঁধবে। মুখে একগাদা গালাগাল নিয়ে চড়াও হতে পারেন আমার উপর। তাই ভাবি, কিছুদিন তাকে এড়িয়ে চলতে পারলেই বাঁচি।

মাত্র ৫ দিন পরই নির্বাচনের আগের রাতে ৮টার টক শো একাত্তর সংযোগে মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে তার বাসা থেকে কানেক্ট হতে চায় একাত্তর টেলিভিশন। আর সেই দায়িত্বটি একপ্রকার জোর করে আমার উপর চাপিয়ে দেয় অফিস। তাঁর পিএ ওসমানের মাধ্যমে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে ধুরু ধুরু বুকে হাজির হলাম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসায়। দেখা হতেই সালাম দিলাম। তিনি গম্ভীর ও রাশভারি হয়ে আছেন।

কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে বললেন, চলো উপরে বসি। বসা থেকে উঠেই লিফটে করে চারতলায় নিয়ে গেলেন আমাদের। তখন শো শুরু হওয়ার বাকি মাত্র ৫ মিনিট। তাই দ্রুত কানেক্ট করে দিলাম ঢাকা স্টুডিওর সঙ্গে। তখনো শঙ্কা কাটেনি। না জানি কখন কী বলে বসেন।

এদিকে বিরতির ফাঁকে ফাঁকে সমানে চলছে চা-নাশতা আর রকমারি ফল-মিষ্টির আতিথেয়তা। খেতে না চাইলে জোর করে খাওয়াচ্ছেন চৌধুরী। কখনো ঠাট্টা-মশকারায় মেতে ওঠছেন।

শো শেষ হলো। মনে হচ্ছে এই যাত্রায় রক্ষা পেয়ে গেছি। সেই প্রশ্ন’র কথা হয়তো ভুলে গেছেন তিনি। কিন্তু যে-ই বিদায় নেবো তখনই বলে উঠলেন- ‘মাস্টরি এক্কানা হম গইজ্জ্যু, এক্কানা গরয়ি জান-অ ফানলার, জিয়ুত ইয়ুত বডর বডর গর-অন বালা নঅ।’ অর্থাৎ- ‘মাস্টারি একটু কম কইরো, একটুখানি জানো মনে হয়, তাই বলে যেখানে-সেখানে মাতবরি করা ভালো নয়।’

আমার আর বুঝতে বাকি নেই- সেই প্রশ্নের রেশ, ক্ষোভ রয়ে গেছে। এরপর আরও কঠিন কিছু শোনার অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু না। আর কিছুই বলেননি। লিফট বেয়ে নিচে নামতেই ভাবছি, পান থেকে চুন খসলে দুনিয়াদারি একজায়গায় করেন যিনি, সেই মহিউদ্দিন চৌধুরী একটুও গালমন্দ করলেন না, ঝাড়ি দিলেন না! এমন মহিউদ্দিন চৌধুরীকে সাংবাদিকতা জীবনে আমি আর কখনো দেখিনি।

[আজাদ তালুকদারের প্রকাশিতব্য গ্রন্থ ‘রিপোর্টারের ডায়েরি’র অংশবিশেষ]