চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা লীগের সদ্য ঘোষিত কমিটির সভাপতি হয়েছেন হাসিনা মহিউদ্দিন। তিনি চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী।
অন্যদিকে নগর মহিলা লীগের পাল্টা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার রেখা আলম চৌধুরী। তিনি নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের চাচি শাশুড়ি।
নারায়ণগঞ্জের মেয়ে রেখা আলম চৌধুরী চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা মধ্যম ভূমিরখীল গ্রামের শাহ আলম চৌধুরীকে বিয়ে করেন। শাহ আলম চৌধুরী হচ্ছেন আ জ ম নাছির উদ্দীন চৌধুরীর স্ত্রীর আপন চাচা। সেই সুবাদে রেখা চাচি, আ জ ম নাছিরের চাচি শাশুড়ি।
অভিযোগ আছে, রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান না থাকা সত্ত্বেও সদ্য ঘোষিত দুই কমিটির শীর্ষ পদে আসীন হয়েছেন এই দুইজন। এক্ষেত্রে আত্মীয়তার ‘তকমা’ ছাড়া নিজ যোগ্যতায় উঠে আসা ত্যাগী ও পুরনো নেত্রীদের করা হয়েছে অবমূল্যায়ন। এ নিয়ে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক মহলে গত দুদিন ধরে চলছে কানাঘুষা, নানা কথা।
জানা যায়, মহিলা লীগের কখনো কোনো সদস্য পদে না থেকেও শুধু মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী- এই যোগ্যতায় ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মহিলা লীগের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্বঘোষিত সভাপতি হন হাসিনা মহিউদ্দিন। মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী বলে এই প্রত্যাবর্তনকে মেনে নিয়ে মহিলা লীগের ত্যাগী নেত্রী-কর্মীরা তাকে বরণও করে নিয়েছিলেন। হাসিনা মহিউদ্দিনকে সামনে রেখে একসঙ্গে কাজ করেন কিছুদিন। কিন্তু যে সকল ত্যাগী ও প্রবীণ নেত্রী, যারা হাসিনা মহিউদ্দিনের কথায় উঠবস করতে পারেন না, গালাগাল শুনতে পারেন না তারা ছিটকে পড়েছেন, পাননি কাক্সিক্ষত পদ।
অন্যদিকে রেখা আলম চৌধুরীও কখনো মহিলা লীগের সদস্য ছিলেন না। ২০০৫ সালে গৃহবধূ থেকে সরাসরি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়ে কমিশনার নির্বাচিত হন। কমিশনার নির্বাচিত হন ২০১০ সালেও। ২০১৫ সালে সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করে হেরে যান। সর্বশেষ চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ নির্বাচনে সদস্য পদে নির্বাচন করেও হারেন। জরুরি অবস্থায় সেনা সমর্থিত সরকারের আনুকূল্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র হন।
রাজনৈতিক মহলে প্রতিষ্ঠিত যে, ওই সময়ে সেনাসমর্থিত সরকারের একটি অনুষ্ঠানে জরুরি অবস্থাকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি রাজনীতিবিদদের আবর্জনা পরিস্কার করতে জরুরি অবস্থা এসেছে মর্মে বক্তৃতা দিয়ে প্যানেল মেয়রের পদ বাগিয়ে নিয়েছিলেন রেখা আলম চৌধুরী।
সেই রেখা আলমই আ জ ম নাছির সমর্থিত পাল্টা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হলেন তার শাশুড়ি হওয়ার সুবাদে। সূত্র মতে, রেখা আলমকে পাল্টা কমিটির সভাপতিই করতে চাওয়া হয়েছিল। আর সেটি মহিলা লীগের সর্বশেষ কমিটির (‘৯৮) সহ সভাপতি নমিতা আইচকে দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দিতে চেয়েছিলেন আ জ ম নাছিরের পক্ষে মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা নেতারা। কিন্তু আগমুহূর্ত্বে বিষয়টি আঁচ করতে পেরে নমিতা আইচ বেঁকে বসেন। মূলত এই বেঁকে বসার কারণেই বিদ্রোহ থামাতে শেষ পর্যন্ত তাকেই সভাপতি করতে হয়। সেক্ষেত্রে রেখা আলমকে করা হয় সাধারণ সম্পাদক।
এর আগে আ জ ম নাছির উদ্দীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ফজিলাতুন্নেছা ইন্দিরাকে হাসিনা মহিউদ্দিনের কমিটিতে রেখা আলমকে সাধারণ সম্পাদক করতে অনুরোধ করেছিলেন। হাসিনা মহিউদ্দিনের একতরফা সম্মেলন, নিজের পছন্দের লোকদের নিয়ে কমিটি গঠন, সেই সম্মেলনে একটি বড় অংশকে ঢুকতে না দেওয়া, উল্টো পুলিশ লেলিয়ে তাদের হেনস্তা করার বিষয়টি রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। অবশ্য একতরফা ওই সম্মেলনে হাসিনা মহিউদ্দিনের বিরোধেী গ্রুপের তপতী সেনগুপ্তকে সহ সভাপতি ও রেখা আলম চৌধুরীকে যুগ্ম সম্পাদক পদ দেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে হাসিনা মহিউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘রেখা আলম আমাদের মাননীয় মেয়রের (নাছির) প্রাণপ্রিয় চাচি শাশুড়ি। মেয়র মহোদয় ইন্দিরা আপার কাছে বিশেষভাবে অনুরোধ করেছিলেন তার শাশুড়িকে (রেখা) যেন সাধারণ সম্পাদক করি। মেয়র ও মেয়রের শাশুড়ির সম্মান বলে কথা। তাদের সম্মান তো রাখতেই হয়। সেকারণে রেখা আলমকে যুগ্ম সম্পাদক করা হয়েছে।
হাসিনা মহিউদ্দিনের এই বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর চাচি শাশুড়ির প্রতি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের প্রচ্ছন্ন দুর্বলতাটি জনসম্মুখে উন্মোচিত হওয়ার পরদিন তার কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে চাচি শাশুড়ির (রেখা) নাম দেখে রাজনীতিতে `আত্মীয়করণ’ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আবারও প্রমাণিত হয়েছে রাজনীতিতে যোগ্যতার চেয়ে, কে কার স্ত্রী, কার শাশুড়ি কিংবা কে কত অর্থ ও শক্তিশালী সেটাই বড় যোগ্যতা। আর এই যোগ্যতা না থাকায় বঞ্চিত হন ’৯০-এর গণআন্দোলন থেকে জরুরি অবস্থায় দলীয় নেত্রীর মুক্তির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া, তিন থেকে চারবার জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়া শিক্ষিত, সজ্জন, ত্যাগী নেত্রীরা।
রাজনীতিতে আত্মীয়করণের এই সংস্কৃতিতে ক্ষুব্ধ চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা লীগ নেত্রী মরজিনা আকতার লুসি দলীয় বৈঠকে, স্বজন-শুভার্থীদের গত কদিন ধরে বলে বেড়াচ্ছেন যে করেই হোক তার পদ দরকার। এজন্য প্রয়োজনে মহিউদ্দিন চৌধুরীদের মতো কোনো নেতাকে বিয়ে করতেও রাজি আছেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোমবার রাতে একুশে পত্রিকাকে মরজিনা আকতার বলেন, আমি নই, আমাদের আরেক নেত্রী ক্ষুব্ধ হয়ে এমন কথা বলেছেন। তবে নেতার বউ, নেতার শাশুড়ি, নেতার সন্তানদের দিয়ে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কঠোর সমালোচনা করেন লুসি।
তিনি বলেন, মহিউদ্দিন চৌধুরী নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি, তার ছেলে ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, স্ত্রী হাসিনা মহিউদ্দিন নগর মহিলা লীগের সভাপতি। এক পরিবারে তিনটি শীর্ষ পদে থাকলে গায়ে আত্মীয়তার লেবেল নেই, কিন্তু তৃণমূল থেকে তিল তিল করে উঠে এসেছেন রাজনীতিতে এমন নেত্রীদের জায়গা কোথায়।
আত্মীয়করণের নেতৃত্ব প্রসঙ্গ জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা লীগের সভাপতি হাসিনা মহিউদ্দিন বলেন, মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী হিসেবে রাজনীতিতে এলেও রাজনীতিতে টিকে আছি আমার যোগ্যতা দিয়ে। আর এই যোগ্যতার কারণেই দলের নেত্রী-কর্মীরাই আমাকে সভাপতির পদে বসিয়েছেন।
আত্মীয়করণের কারণে পদ পাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রেখা আলম চৌধুরী বলেন, মেয়রের আত্মীয় এটা আমার একমাত্র পরিচয় না। এখন আমি শিক্ষকতা করি, চট্টগ্রাম ওমেন চেম্বারের পরিচালক। ২০ বছর ধরে মহিলা আওয়ামী লীগ করে এসেছি। শ্রম দিয়ে আজকের এ অবস্থানে এসেছি। শুধু মেয়রের আত্মীয় বলে পদ পাচ্ছি- এমন কেউ বললে তো আর হবে না।
এরপর মহিলা লীগের কখন, কোন পদে ছিলেন জানতে চাইলে রেখা আলম নিরুত্তর থাকেন।