রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

খোয়াজনগর থেকে আজিমপাড়া পোস্ট অফিস…

প্রকাশিতঃ ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০১৭ | ৩:৪৪ অপরাহ্ন

আজাদ তালুকদার : কর্ণফুলির ডুবসাঁতার, গায়ে সুধামাটির ঘ্রাণ-জন্ম থেকে পেয়েছেন কর্ণফুলির দক্ষিণপাড়ের (খোয়াজনগর) মানুষ আজিম আলী। বাড়ি থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে একটি মাত্র স্কুল, হাজী উমরা মিয়া হাইস্কুল। দূরের পথ, ইচ্ছা থাকলেও অনেকে স্কুলে পড়তে পারেননি। আবার কেউ স্কুলে ভর্তি হয়েও অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে অঙ্কুরেই ঝরে পড়েন। খানাখন্দ পেরিয়ে রোজ স্কুলে যাওয়ার সেই কষ্টসহিষ্ণু পরীক্ষায় টিকে যাওয়াদের একজন আজিম আলী। নিজের স্কুলে পড়ার আনন্দ ছাপিয়ে অন্যদের ঝরে পড়ার কষ্টটাই তার কাছে বেশি বাজত। এজন্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের সঙ্কট, যোগাযোগের ভগ্নদশা-সেই কিশোরকালেই ভর করে আজিম আলীর ভাবনায়।

সত্তরের দশকের স্কুলছাত্র আজিম আলী ‘লুঙ্গিপার্টি’। ‘লুঙ্গি’ তার স্কুল ড্রেস। স্কুল-প্রতিষ্ঠাতা হাজী উমরা মিয়া চৌধুরীর নাতিরা জুতা-মোজা, হাফপ্যান্ট আর বেল্টপেছানো শার্ট পরে স্কুলে যেতেন। এই দৃশ্য আজিম আলীর মনটা খারাপ করে দিতো। ভাবতেন- যারা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন তাদের সন্তান-নাতি-নাতনিদের চালচলন, বেশভুষা বোধহয় এমনই হয়। তাই শিশুবেলায় স্বপ্ন দেখেন বড় হয়ে স্কুল বানাবেন।

স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে দেখতেন মুদি দোকানিরা গদিতে বসে টাকা গুণছেন। টাকা গোণার এই দৃশ্যটাই অনন্য মনে হতো তার কাছে। ইস! যদি সওদাগর হতে পারতাম, তাহলে এমন করে টাকা গুণতে পারতাম! সেই থেকে স্থির করলেন- চাকরি-বাকরি নয়, ব্যবসাই করবেন। টাকা গুণবেন, অনেক টাকা।

৪০ বছরের ব্যবধানে আজিম আলীর সব আশা, স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। বরং তার প্রাপ্তি, অর্জন স্বপ্ন-সাধকেও ছাড়িয়ে গেছে বহুদূর। একটা নয়, পাঁচটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করেছেন নিজ এলাকায়। টাকা গুণতে গুণতে ক্লান্ত হয়েছেন বহু আগেই। তার গড়া প্রতিষ্ঠানের লোকজনই এখন টাকা গোণেন। এলাকার যোগাযোগব্যবস্থায় এখন আর খানাখন্দ, কর্দমাক্ত পথের অস্তিত্ব নেই। কখনো ব্যক্তিগত উদ্যোগে, কখনো বা সরকারের কর্তাব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে পুরো গ্রামের চেহারাটাই পাল্টে দিয়েছেন, বিস্তীর্ণ গ্রামজুড়ে এখন পিচঢালা পথ। সে কারণে এলাকাবাসীই তাদের গ্রামের নাম পাল্টে রেখেছেন ‘আজিমপাড়া’। খোয়াজনগর হয়ে গেলো আজিমপাড়া, পোস্ট অফিসও আজিমপাড়া।

এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে। আজিম আলীও বোঝেন- অর্থ, ধনসম্পদ অর্জনের চেয়ে ‘ভালোবাসা’ অর্জন করা কঠিন। আজিম আলীর সেই ‘কঠিন’ অর্জনের পথ ধরে চলুন আমরা ফিরে যাই আজীম আলীর শিশু-সন্ধিক্ষণ, জন্ম ও বেড়ে উঠার সময়গুলোতে।

১৯৫৫ সালের অক্টোবরে কর্ণফুলির খোয়াজনগর গ্রামে এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে আজিম আলীর জন্ম। আইয়ুব আলী ও রমজান বিবি দম্পতির বড় সন্তান তিনি। জন্মের পর থেকে প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে। সেই যুদ্ধে অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছেন বাবা-মার। ছেলের জন্য তারা দোয়ার ভা-ার নিয়ে বসেছিলেন। সেই দোয়া আর প্রেরণাকে সঙ্গী করেছেন জীবনের প্রতিটি বাঁকে। যেখানেই বাধা সেখানেই অসীম শক্তি হিসেবে কাজ করেছে তাদের দোয়া।
উমরা মিয়া হাই স্কুল থেকে ১৯৭৩ সালে এসএসসি, চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে ১৯৭৫ সালে এইচএসসি পাশ করে একই প্রতিষ্ঠানে বিএ-তে ভর্তি হন আজিম আলী।

মূলত ব্যবসার ভুতটা ছাপলো তখনই। এরপর বিএ পরীক্ষা না দিয়ে বেরিয়ে যান। দূর সম্পর্কের এক চাচার সাহায্যে কর্ণফুলি পেপার মিলসে (কেপিএম) সরবরাহকারী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। বছর দুয়েকের মতো করেন সে কাজ। একপর্যায়ে সেখানে লোকসান গুণে বেরিয়ে যান।

চলে যান ঢাকায়। কোনো কাজ নয়, বসে বসে খাওয়া, ঘুরে বেড়ানো, আড্ডাবাজিতেই সময় কাটাতে থাকেন। আড্ডা দিতেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় হলে কলেজ জীবনের বন্ধু আকতার হোসেন কিরণের (সংগীতশিল্পী ও কাস্টমস কর্মকর্তা) সঙ্গে। সেই আড্ডা স্বপ্নগুলোকে যেমন তাতিয়ে দিয়েছিলো তেমনি কিছুটা উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপনেও ধাবিত করেছিল আজিম আলীকে। উচ্ছৃঙ্খল, দুর্দান্ত, দুরন্তপনার সেই স্মৃতি রোমন্থনের সময় তার কাছে জানতে চাওয়া হয় ওই সময়টাতে প্রেম করেছেন কিনা।

স্মিত হাসিতে ‘না’ সূচক উত্তর আজিম আলীর। বললাম, এই উত্তরের মাঝেও কিন্তু অন্য কোনো সত্য লুকিয়ে আছে। আপনি ‘প্রেম’ না করার মানুষ নন-শুনে এবার অট্টহাসি। বলি, এমন হাস্যোজ্জ্বল, কোমল মনের মানুষ বিয়ের আগে ‘প্রেম’ করেনি- একথা বিশ্বাস করতে বললেই কি হলো?

দারুণ এক রোমান্টিকতার পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে প্রবেশ করি আজিম আলীর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট, কঠোর সাধনার দিনগুলোতে। আজিম আলী বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আড্ডাবাজি আর উচ্ছৃঙ্খলতার মাঝেই মনে হলো এই কাজ আমার নয়। বেঁচে নিতে হবে জীবনের আসল গতিপথ। ছুঁতে হবে স্বপ্নগুলো।

সেই স্বপ্ন ছোঁয়ার আশায় এবার ফিরে এলেন কর্ণফুলির কাছে। কী করবেন, কোথায় যাবেন ভাবতে ভাবতেই দুই বছর শেষ। ভাবনা শেষে যুক্ত হলেন মাছব্যবসায়। চকরিয়া, পেকুয়া থেকে বাসের ছাদে করে চিংড়ি মাছ এনে রেয়াউদ্দিনবাজার আড়তে দিতেন। প্রথম কিছুদিন টুকটাক লাভ হলেও পরে লোকসানই গুণতে হয় বেশি। ছেড়ে দিলেন সেই ব্যবসাও।

এরপর বাবার দেয়া ৪৫ হাজার টাকায় মাদারবাড়িতে সিমেন্টের দোকান খোলেন। বাড়ি থেকে মাদারবাড়ির দূরত্ব মাঝখানে একটি কর্ণফুলি নদী। কখনো কাঠের নৌকা, কখনো বা ডিঙ্গি নৌকায় দিনে কয়েকবার কর্ণফুলি পাড়ি দিয়ে দোকানে আসা-যাওয়া করতেন। বস্তাপ্রতি ৫০ পয়সা লাভে সিমেন্ট বিক্রি, তাই দৈন্যতাও কাটে না। সেই ৫০ পয়সা লাভের ব্যবসায় লেগে থাকেন ভালো কিছুর আশায়।

১৯৮৩ সালের কথা। লে আউট হয়ে যাওয়া পতেঙ্গার ন্যাশনাল কটন মিলের চুন-সুড়কি, টিন লটে বিক্রি করে দেওয়া হবে। এ জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এক বন্ধুসহ সেখানে টেন্ডার দিলেন। ১৬ লাখ টাকায় পেলেন সেই কাজ। টেন্ডার পেয়েই চেপে বসে ভয়। টাকা তুলতে পারবো তো! ভয় আর শঙ্কা নিয়ে শুরু করেন ভাঙার কাজ। দেখেন চুন-সুড়কি আর টিনে মোড়ানো ১৫ ইঞ্চি গাঁথুনির পরতে পরতে সব জয়েস, গার্ডার আর লোহা। যেন ডায়মন্ড আর সোনার স্তূপ। খুলে যায় ভাগ্য, ঘুরে যায় জীবনের মোড়।

১৬ লাখ টাকায় লাভ করেন কয়েক কোটি টাকা। আর সেই টাকায় একের পর পর গড়ে তুলেন লাভজনক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু যা-ই করেছেন কর্ণফুলির বাইরে কিছুই করেননি। কর্ণফুলির মায়া ছেড়ে যেতেও চাননি কোথাও। ১৯৯৪ সালে ২৮ কানি জায়গা কিনেন কর্ণফুলির পাড় ঘেঁষে। সেখানে গড়ে তুলেন ডায়মন্ড সিমেন্ট। ১৯৯৭ সালে উৎপাদনে যাওয়া ডায়মন্ড সিমেন্ট কারখানায় এখন দৈনিক উৎপাদন হয় সাড়ে তিন হাজার মেট্রিক টন সিমেন্ট।

এছাড়াও গড়ে তুলেন লাইটারেজ জাহাজ-ব্যবসা, হ্যাচারি, ব্রিক্স, রিয়েল এস্টেটসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। তার গড়া প্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্তমানে কাজ করছে এক হাজারেরও বেশি মানুষ। আজিমপাড়া গ্রামের মানুষই বেশিরভাগ নিয়োগ পেয়েছেন সেসব প্রতিষ্ঠানে। তার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আইয়ুব-বিবি হাই স্কুল, আইয়ুব-বিবি কলেজ, আজিম-হাকিম স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আজিম আলী প্রাথমিক বিদ্যালয় আজিমপাড়ার ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে। কিছুদিন আগে একটি মাতৃসদন প্রতিষ্ঠার কাজও শুরু করেছেন তিনি।

আজিম আলীর জীবনে প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তি অনেক বেশি। এজন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তিনি বিশ্বাস করেন বাবা-মা’র দোয়া পৃথিবীতে অনেক বড় শক্তি। বাবা-মা’র দোয়া অর্জনের প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হতে পারলে তার জন্য পৃথিবীতে কোনো কিছুই দুর্ভেদ্য নয়। পাশাপাশি থাকতে হয় সততা, কমিটমেন্ট আর অধ্যবসায়। এমনও দিন গেছে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২০ ঘণ্টাই কাজ করেছি। রমজানের দিনে সারারাত কাজ করে সেহেরী খেয়েছি। সেহেরী খেয়ে আবার কাজে নেমে পড়েছি।’- যোগ করেন আজিম আলী।

৬২ বছর বয়স, এখনো ১৬ ঘণ্টা কাজে নিমগ্ন থাকেন আজিম আলী। তার মতে, সময়জ্ঞান নিয়ে চলে জীবনের প্রতিটি সময়কে কাজে লাগাতে পারলে জীবনে সফলতা আসবেই।