কাজী খায়রুন নেছা কলি : কয়েকদিন ধরে চেষ্টা করছি করোনাকালীন শিক্ষকদের অবস্থা লিখব। হঠাৎ গত সপ্তাহে আপনজনদের ছবি পরিবর্তন হওয়ার কারণ দেখে মনটা ভীষণ ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। আমি নিজেই ছবি পরিবর্তন করতে (profile picture) দেরি করছিলাম বলে, অনেক মেসেজ এসে ভরে গেল ইনবক্সে। কতটুকু পরিবর্তন হলে সমাজ বলবে ‘মেয়েরা মানুষ।’ প্রতি পদে পদে চলার পথে কতটুকু পথ পাড়ি দিলে বলতে পারবে- সামনে বিপদের সম্ভাবনা কম।
প্রতিবাদ ছাড়া কখনো প্রতিরোধ হয়নি। যেখানে কোনও প্রতিবাদ হয়নি সেখানে কোনও অস্বাভাবিক পরিস্থিতির স্বাভাবিক গতি আসেনি। আওয়াজ তুলতে হবে একসাথে।একসময় এসিড সন্ত্রাসীর ভয়ে এরকম তটস্থ হয়ে উঠেছিল পুরো দেশ। কোনও ঘরের সুন্দরী যুবতী মেয়েকে অপাত্রের হাত থেকে বাঁচাতে গেলে অবশ্যই কোনও না কোনওভাবে এই সন্ত্রাসের কবলে পড়তে হয়েছে। কেউ ছবি কালো করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। আমি দু’কলম লেখার চেষ্টা করছি প্রতিবাদের ভাষা হিসাবে। জানি না এটাকে কীভাবে নেবেন কিন্তু সবার সাথেই আছি। তবু চোখের সামনে কিছু কথা তুলে ধরার চেষ্টা!
মনে হচ্ছে নিজেদের ভিত্তি এত নড়বড়ে। কালো হয়ে গেল তো সেটা আরও অন্ধকার হয়ে গেল। এটা আমার অভিমত। এক একটা ঘটনার পর নিজের গা বাঁচিয়ে চলি। যাক, বাবা এটা আমার বেলায় হয়নি।
বিচারব্যবস্থা এত দেরি কেন? সেটা নিয়ে আলোচনা সমালোচনায় যাইনি। আমার না, সেজন্য! এভাবে আর কত? আমি সবসময় যেটা বলি, যেটা অনুভব করি, পরিবার থেকেই ছেলেমেয়েগুলোকে যেন ঠিকমতো শিক্ষা দেওয়া হয়।
আপনার মেয়েটা ঘর থেকে বের হলে যেমন চিন্তা হয়?ছেলেটাকে ও সেই শিক্ষা দিয়েছেন কিনা চিন্তা করুন। পথেঘাটে কজন মেয়েকে সে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে চলে। তার দৃষ্টিতে কোনও কুমতলব আছে কিনা।
একজন পুরুষ, আমার প্রতিপক্ষ নয়। পুরুষ তিনি আমার বাবা, আমার জগৎ, আমার বেড়ে ওঠা। যাকে দেখে আমার, আমার জন্য পছন্দের মানুষটি কেমন হবে এই চিন্তা করতে খুবই ভালো লাগত। একজন পুরুষ আমার ভাই, যাকে ছাড়া কখনো আমার ছোটবেলা, যার হাসিখুশি, যার সাথে খুনসুটি ছাড়া কখনো এত সুন্দর হতো না।
একজন পুরুষ, আমার স্বামী যার ভালোবাসা, যার সাহায্য ছাড়া আমার কখনো সংসার হতো না। একজন পুরুষ আমার ছেলে, যাকে ছাড়া আমি কখনো মাতৃত্ব কী জিনিস অনুভব করতে পারতাম না। কখনোই আমার প্রতিপক্ষ নয় বরং পুরুষের সাহায্য ছাড়াই অসম্পূর্ণ আমি। এদের সবার ভিতর আমি আমাকে খুঁজে পাই।
যখন আমার কর্মক্ষেত্রে যাই, আমাকে আমার সহকর্মীদের সঙ্গে মিশতে হয়-সহকর্মী হিসাবে, সহযোদ্ধা নয়। সহকর্মী হচ্ছে সহযোগিতার সহমর্মিতার একটা স্থান। আমার বন্ধু। তাহলে প্রতিপক্ষ ভেবে হিংসা, বিদ্বেষ এনে লাভটা কী?
সবাই গোলাপ পছন্দ করে। কার গোলাপটা ধরে তার অনুভব পেতে ইচ্ছা করে না, কিন্তু সেই গোলাপটাকে যদি আমি পদপিষ্ট পদদলিত করি। তাহলে, গোলাপটার সৌন্দর্য কি রক্ষা পায়?
আমি সবসময়ই গর্ববোধ করি, আমার বাবা, আমার ভাই, আমার স্বামী, আমার ছেলে শুধু আমার আপনজন নন, তারা আমার বলয়, তাদের ঘিরে আমার শক্তি। তারা আমার প্রাণ। এই চারজন পুরুষের ব্যাপারে আরেকটা বিষয় জানিয়ে রাখি, প্রতিটি মুসলিম পরিবারে এই চারজন পুরুষের জবাবদিহিতা আছে তাদের পরিবারের মেয়েদের ব্যাপারে। সুতরাং চাইলে সহজে পার পাওয়া যায় না।
এতকিছুর পরও, এত স্নেহ, আদর ভালোবাসার এই পৃথিবীতে তবুও আমরা প্রতিপক্ষ কেন? কেন আমরা সমব্যথী নই। তাহলে কার জন্য আমি গর্ববোধ করি, কার অনুশাসন আমরা মেনে চলি।
আজ সত্যিই শাসনের বড়ই অভাব। নীতিকথা, নৈতিকতা বড়ই দুষ্প্রাপ্য বিষয়-শুধুই মুখের বুলি। তবুও মনে হয় ধর্মীয় অনুশাসন কখনো মানুষকে ছোট করেনি। কেবল আমরা মনে করি ধর্ম মেনে চললে, আমরা মনে হয় গেঁয়ো হয়ে গেলাম।অতি আধুনিকতার মুখোমুখি হতে পারব না, যদি ধর্মকে বড় জানি।
সত্যি বলতে এমন কোনও ধর্ম নেই-মিথ্যা বা পাপাচারকে প্রশ্রয় দিয়েছে। তাহলে এসব অন্যায়ের কোনও দিন ডালপালা শেকড় বের হত না। আজ সময় এসেছে, আবার ধর্মীয় মূল্যবোধকে জাগ্রত করার। মুসলিম হিসাবে বলতে পারি-পর্দা শুধু মেয়েদের জন্য নয়, ছেলেদের জন্যও আবশ্যক।
একজন পুরুষকেও পর্দা মেনে চলতে বলা হয়েছে। তাই পর্দা শিক্ষার বেলায় মেয়ের সাথে সাথে আপনার আমার ছেলেটাকেও এ ব্যাপারে শিক্ষা দিন।
আজ আমার বা আপনার বলে আর নিজেকে বাঁচিয়ে চলার সময় নেই। আজ যদি পূজার বিচার হতো, আজ যদি তনুর বিচার পেতাম, আজ যদি নুসরাতরা অবহেলিত না হতো, তাহলে এতো সুযোগ বা সাহস বেড়ে যেত না। তখন খুব জোরালো বক্তব্য ছিল এসিড ছুঁড়েছেন তো মরবেন।
আজ আবার বলি যেখানে ধর্ষণ, সেখানেই সাথে সাথে বিচার।বিচারের জন্য নীরবে-নিভৃতে অপেক্ষায় যেন আরেকবার ধর্ষণ না হই।
আমার বাগানের ফুলটা আমার ঘরের। আপনার ঘরের সৌন্দর্য হয়ে বেড়ে ওঠুক। কোন মহান মালির পরশে জীবন প্রষ্পুটিত হোক। তারপর সেই ঠিক করবে সেই ড্রইং রুমে বসে দেশের কথা দশের কথা ভাববে, নাকি থাকবে কোনও ফুলদানিতে অপার সৌন্দর্যে। বা এটাও তো হতে পারে প্রতিদিন নিত্য নতুন আয়োজনে বা উদ্ভাবনী দিয়ে সবার একজন হয়ে অজানাকে জয় করবে।
উপায় অনেক, শুধু দরকার পরিকল্পিত ব্যবস্থার যথাসময়ে সঠিক প্রয়োগ। আপনার-আমার সন্তানকে যেন এই বিপদের সম্মুখীন হতে না হয়, এক সুন্দর পৃথিবীতে ওরা কন্টকবিহীন পথ আর নির্মল আনন্দে বেচেঁ থাকুক।
কাজী খায়রুন নেছা কলি : সিনিয়র প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, ওমর গণি এমইএস বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ।