দেড় যুগ পর চট্টগ্রাম মহিলা লীগের সম্মেলন : উদ্দীপনা নেই, আছে শংকা

চট্টগ্রাম: ১৮ বছর পর আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা লীগের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মীদের মাঝে যতটুকু উৎসাহ, উদ্দীপনা থাকার কথা তা নেই। বরং আছে শংকা, উৎকণ্ঠা। মহানগর মহিলা লীগের এক নেত্রী দলে আধিপত্য বিস্তার ও একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কারণে এই উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন মহিলা লীগের নেত্রী-কর্মীরা।

চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা লীগের তৃণমূল নেতৃবৃন্দের অভিযোগ, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী, কেবল এই পরিচয়ে মহিলা লীগে প্রবেশ করে সংগঠনকে ক্রমেই বিভক্তির দিকে ঠেলে দিয়েছেন হাসিনা মহিউদ্দিন। সংগঠনকে পৈত্রিক সম্পত্তি ভাবতে গিয়ে দলের দুঃসময়ের নেতাকর্মীদের দূরে ঠেলে দিয়েছেন। কথায় কথায় তার গালাগাল, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের কারণে দলের ত্যাগী ও প্রবীণ মহিলা লীগনেত্রীসহ তৃণমূলের একটি বড় অংশ হাসিনা মহিউদ্দিনের সঙ্গে নেই।

এই অবস্থায় তার কথায় প্রতিনিয়ত যারা উঠবস করতে পারেন, গালাগাল হজম করতে পারেন তাদের নিয়েই তিনি মহিলা লীগের কমিটি করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। স্বামীর পরিচয় কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন এলাকায় মহিলা লীগের অনুষ্ঠান করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন তিনি দলের সর্বেসর্বা। এক্ষেত্রে মহিলা লীগের ত্যাগী নেত্রীদের জানানো দূরের কথা, কেউ তার অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলে তিনি তাদের গালমন্দ করে বের করে দেন।

এ প্রসঙ্গে মহিলা লীগ নেত্রী নবুয়াত আরা সিদ্দিকি বলেন, সম্প্রতি চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ হলে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠনকল্পে দলে নতুন আসা কয়েকজনকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করেন হাসিনা মহিউদ্দিন। সেই অনুষ্ঠানে তিনি দলের দুঃসময়ে যারা মাঠে ছিলেন, তাদের কাউকেই ডাকেননি। খবর পেয়ে আমি সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলে তিনি ক্ষেপে যান। বলেন, তোমাকে তো আমি ডাকিনি। তুমি কেন এসেছো। এরপর সেই অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে যেতে তিনি আমাকে বাধ্য করেন।

মহিলা লীগ নেত্রী নাসরিন আকতার নাহিদা বলেন, একসময় হাসিনা মহিউদ্দিনের বাসায় যেতাম, মহিলা সংগঠিত করে তার কাছে নিয়ে যেতাম। কিন্তু তার মুখ খারাপ। এজন্য আমরা তার কাছে আমরা যেতে পারি না। তিনি মহিলা লীগ নেত্রীদের ঘরের চাকর মনে করেন। ন্যূনতম আত্মমর্যাদা থাকলে তারা কখনো তার সঙ্গে থাকতে পারবেন না। আমরাও পারিনি।

আরেক মহিলা লীগ নেত্রী দীপ্তি মজুমদার বলেন, হাসিনা মহিউদ্দিনের কাছে তৃণমূলকর্মীদের কোনো মূল্য নেই। তিনি কাউকেই পাত্তা দেন না। তার অন্যায়ের প্রতিবাদ যারা করেন তারা তার চক্ষুশূল। আসন্ন কমিটিতে তিনি ত্যাগীদের বঞ্চিত করার জন্য সব চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছেন। শুনেছি সম্মেলনের কার্ড ছাপিয়ে কেবল তার অনুসারীদের মাঝেই বিলি করছেন। দল তার পৈত্রিক সম্পত্তি নয় যে, তিনি যা ইচ্ছে তা করবেন।

জানা যায়, চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল ১৯৯৮ সালে নগরীর রিমা কমিউনিটি সেন্টারে। সম্মেলনে প্রয়াত নিলুফার কায়সারকে সভাপতি, নমিতা আইচকে সহ সভাপতি, তপতী সেনগুপ্তকে সাধারণ সম্পাদক ও অ্যাডভোকেট রেহানা বেগম রানুকে দপ্তর সম্পাদক করে ৭১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করা হয়।

মহিলা লীগের সেই সময়কার নেত্রী-কর্মীরা জানান, নিলুফার কায়সার মহিলাদের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারতেন। মানুষের সুখে-দুঃখে মিশে যাওয়ার অসাধারণ গুণ ছিল তার। তাই তার জনপ্রিয়তাও ছিল আকাশচুম্বী। ২০০৬ সালের দিকে বার্ধক্যজনিত রোগে অসুস্থ হয়ে পড়লে মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী হিসেবে হাসিনা মহিউদ্দিনকে দিয়ে মহিলা লীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করানোর জন্য ঘর থেকে নিয়ে আসা হয়। এভাবেই মহিলা লীগে অভিষেকের পর মাঠে কিছুদিন সক্রিয় থাকলেও জরুরি অবস্থার সময় নিজেকে গুটিয়ে নেন হাসিনা মহিউদ্দিন।

নেতাকর্মীদের মতে, এসময় একাই দলকে এগিয়ে নিয়ে যান দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রেহানা বেগম রানু। জরুরি অবস্থায় জাতীয় শোকদিবসসহ নানা কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে শত শত মহিলা নিয়ে শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন করে পুলিশের পিটুনিতে আহত হন রানু।

জরুরি অবস্থা কেটে যায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে মহিলা লীগে সক্রিয় হন হাসিনা মহিউদ্দিন। জরুরি অবস্থায় যারা কর্মসূচি পালন করেন, দলকে এগিয়ে নিয়ে যান তাদের কর্মসূচি নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। এরপর নিজেকে মহিলা লীগের স্বঘোষিত সভাপতি দাবি করে মহিলা লীগকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে মরিয়া হয়ে উঠেন। সেই থেকে মহিলা লীগের রাজনীতিতে শুরু হয় টানাপোড়েন। নেত্রীদের মধ্যে ক্রমেই বাঁধতে থাকে অসন্তোষের দানা।

চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও আ জ ম নাছির উদ্দীন শিবিরে বিভক্ত। এর প্রভাব পড়েছে মহিলা লীগের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডেও। ১৯৯৮ সালের পর বেশ কয়েকবার সম্মেলন করার উদ্যোগ নিয়ে নতুন কমিটি গঠনের চেষ্টা হলেও তা সফল হয়নি। এ পরিস্থিতিতে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি নগরীর দি কিং অব চিটাগাং এ মহানগর মহিলা লীগের সম্মেলন হতে যাচ্ছে।

হাসিনা মহিউদ্দিনের নেত্রী হয়ে উঠার সাক্ষী মহানগর মহিলা লীগের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রেহানা বেগম রানু। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পর সংগঠনের কার্যক্রমে নিস্তব্ধতা নেমে আসে, সম্মেলন পিছিয়ে যায়। একই সময় মহানগর সভানেত্রী নিলুফার কায়সার অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি সংগঠন গোছাতে আমাকে দায়িত্ব দেন, বলেন সংগঠনকে তুমি এগিয়ে নাও। এরপর ২০০৬ সালের দিকে হাসিনা মহিউদ্দিনকে গিয়ে বলি আপনি আমাদের মিটিংগুলোতে সভাপতিত্ব করুন। আমি সংগঠিত করে দেব। এক্ষেত্রে নিলুফার কায়সারকে আমি বলেছিলাম; ‘হাজার হলেও মহিউদ্দিন ভাইয়ের বউ। উনি সভাপতিত্ব করুক।’

রেহানা বেগম রানু বলেন, ‘জরুরি অবস্থায় ৫শ’ মহিলা নিয়ে শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে মানববন্ধন করি। জাতীয় শোক দিবসসহ নানা কর্মসূচি পালন করি জরুরি অবস্থার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে। এসময় মহিলা লীগের কাউকেই আমি কাছে পাইনি। বরং জরুরি অবস্থায় কেন কর্মসূচি পালন করেছি তা নিয়ে অনেক কথা শুনতে হয়েছে হাসিনা মহিউদ্দিনের কাছ থেকে। আমি বলেছি, দলের সংকটময় মুহূর্তে একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। এখানে অনুমতি লাগবে কেন?’

হাসিনা মহিউদ্দিনের সাথে মহিলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেত্রীদের টানাপোড়েন সম্পর্কে জানতে চাইলে রানু বলেন, ‘আমরা ওনার বাসায় মিটিংয়ের আয়োজন করে দিতাম। মহিলাদের সংগঠিত করে দিতাম। এরপরও তিনি আমাদের সাথে অসুন্দর আচরণ করায় আমরা চলে আসি। মহিলা লীগের কার্যকরি কমিটির কেউ এখন হাসিনা মহিউদ্দিনের বাসায় যান না।’

চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক তপতী সেনগুপ্ত বলেন, হাসিনা মহিউদ্দিন মহানগর মহিলা লীগের কিছুতেই ছিলেন না। নিলুফার কায়সার অসুস্থ। আমি দেশের বাইরে। এ অবস্থায় কায়সার ভাবি রেহানা বেগম রানুকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেন। রানুই মূলত আমাদের অনুপস্থিতিতে সংগঠনকে এগিয়ে নিয়ে যান।
তপতী সেনগুপ্ত বলেন, ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার প্রত্যয় নিয়ে আমরা হাসিনা মহিউদ্দিনের বাসায় বেশ কয়েকটি মিটিং করেছি। কিন্তু তার মুখ খারাপ। সহকর্মীদের কথায় কথায় গালমন্দ করেন। তিনি যেটা বলেন সেটাই নাকি আইন। এ অবস্থায় তার সঙ্গে আমরা যোগাযোগ বন্ধ করে দিই। তার মুখের অত্যাচারে একে একে সর্বশেষ গঠিত কমিটির সবাই তাকে ছেড়ে যায়। এরপর মহিউদ্দিন ভাইয়ের বউ- শুধু এই যোগ্যতায় কমিটির কাউকে না জানিয়ে তিনি বিভিন্ন ওয়ার্ডে এককভাবে কমিটি করেন। মহিলা লীগের একক নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করেন। পুরোনো ও ত্যাগীদের বাদ দিয়ে নিজের মতো করে মহিলা লীগ চালাচ্ছেন।

সম্মেলন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেত্রী ও সর্বশেষ কমিটির সহ-সভাপতি নমিতা আইচ বলেন, ‘সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি করা দরকার। দায়িত্ব নেওয়ার মতো ত্যাগী ও যোগ্য লোক আছে। নতুন কমিটিতে দুঃসময়ের লোক, যারা রাজপথে ছিলেন তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থাকা উচিত বলে আমি মনে করি। হাসিনা মহিউদ্দিন কখনো দলের কোনো পদে ছিলেন না। হঠাৎ করে নিজেকে সভাপতি দাবি করে হাসিনা মহিউদ্দিন কিছু নতুন লোক নিয়ে কমিটি করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। আমরা এটা কখনো মানতে পারি না।

জানতে চাইলে হাসিনা মহিউদ্দিন বিষয়গুলো এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, আমি যা করেছি সংগঠনের স্বার্থে করেছি। কেউ যদি আমার কর্মকা- নিয়ে প্রশ্ন তুলে তা হবে অবান্তর। কেন্দ্র থেকে অর্ডার এসেছে সম্মেলন করার। সেই অনুযায়ী আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি কিং অব চিটাগাংয়ে সম্মেলন হচ্ছে। এখন কেন্দ্র কাকে সভানেত্রী আর কাকে সাধারণ সম্পাদিকা বানাচ্ছে তা তো জানি না। কোন পদে কে আসবে সেটা ঠিক করার এখতিয়ার আমাদের নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই যারা যোগ্য তারা কমিটিতে আসবে। আর যারা হারিয়ে গেছে তাদের বাদ দেওয়া হবে হয়তো। এখন তো নতুনদের জয়জয়কার। নতুনরাই বেশিরভাগ পদে আসতে পারে।’