চট্টগ্রাম : ১৯৮৩ সালে দেশের প্রথম নারী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন আনোয়ারা বেগম। বিসিএস ষষ্ঠ ব্যাচের এ কর্মকর্তা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। যুগ্ম সচিব পদে থাকা অবস্থায় এক বছর আগে অবসরে গিয়েছেন তিনি।
আনোয়ারা বেগমের বেড়ে ওঠা চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদে। শৈশবের স্মৃতিচারণ করে তিনি লিখেছেন, ‘আগ্রাবাদে আমার ভালোবাসা, প্রেম, আবেগ, শিক্ষা আর সংস্কৃতির ব্যাপক পরিসর ঘটেছে। এখানে হাসপাতাল মাঠে আমার শিশুবেলা, এফ-২, ৩, ৪, ৫, ৬ এর পেছনের মাঠে আমার কৈশোর আর তারুণ্য কেটেছে অনাবিল আনন্দ, উদ্যম আর ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্তে।’
‘বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টিকারী মুহুর্তটি আমি ও আমার সুহৃদগণ তৈরী করেছিলাম ৩ এপ্রিল, ১৯৮৩ সালে এদেশে প্রথম নারী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদান করে। পত্রিকায় ছবি ছাপা হওয়ার পরপরই কলোনির শুভাকাঙ্খীরা আমাকে একনজর দেখতে এসেছিলেন। সেই পুরাতন আমি নতুনভাবে ধরা পড়েছিলাম তাঁদের কাছে।’
ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় অদম্য আগ্রহ ছিল জানিয়ে আনোয়ারা বেগম লিখেন, ‘১৯৬৯ সনে পঞ্চম শ্রেণীতে রেসিডেন্সিয়াল বৃত্তি লাভ করেও সামান্য বেতনভুক দরিদ্র পিতার নয় ভাইবোনের একজন হিসাবে ভালো সরকারি বিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। ৬ষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত প্রথম হয়ে স্কুলের মাসিক বেতন হতে অব্যাহতি পেয়ে স্কুল জীবন সমাপ্ত করে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হই।সেখানেও পিতা ২য় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক ছিলেন বিধায় পড়ার সমস্ত খরচ সেনা কল্যাণ সংস্থা বহন করায় সহজে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই।’
‘তারপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে সম্মানে ভর্তি হয়ে দুবছরে সাবসিডিয়ারি শেষ করে সম্মান পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করি। এর মাঝে পিতা সরকারি চাকুরি হতে অবসরে গেলে বিপর্যয় নেমে আসে। অনার্স পরীক্ষার আশা ত্যাগ করে বিএ পাস কোর্সে পরীক্ষা দিয়ে ভালো রেজাল্ট করে তিনমাসের মধ্যে বিসিএস পরীক্ষায় অবতীর্ণ হই ও উত্তীর্ণ হয়ে চট্টগ্রাম আদালতে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগ দিই।’
এই অভূতপূর্ব ঘটনাটি জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় জানিয়ে আনোয়ারা লিখেছেন, ‘পত্রিকায় আমাদের ছবি ছাপা হওয়ার পর এলাকার অনেকে আমাকে দেখার জন্য আমাদের বাসায় আসেন। যেটা ছিলো গভীর আবেগ, উৎফুল্ল ও ভালোবাসার এক অপূর্ব সংযোজন। আমার হৃদয়-ভূমির মাঝখানে সবুজ পাহাড় সমান সে ছবি আজো জাগ্রত রয়েছে।’
‘মানবজীবনের সবক্ষেত্রে জড়িয়ে রয়েছে প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির হিসাব নিকাশ। আমার জীবনে অপ্রাপ্তির হিসাব ছাড়িয়ে প্রাপ্তির আনন্দ, আবেগ আজ বিশ্ব জয় করেছে। যখনি সুযোগ হয়েছে নিজেকে উজাড় করে দিতে চেয়েছি প্রিয় ও পরিচিতদের কল্যাণের জন্য।’
স্মৃতিচারণ করে আনোয়ারা লিখেছেন, ‘এই আগ্রাবাদ গ্রামে আমার বেড়ে ওঠা, প্রতিদিন বিকেলে মাঠে হাডুডু, ব্যাটমিন্টন, ছিবুডি খেলা, হাসপাতাল মাঠে স্টেজ বানিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিদ্যুৎবিহীন রাতে পাড়াময় ঘুরে বেড়ানো। নির্দ্বিধায় বলবো, ছিলোনা ভয়, ভীতি, আতংক। পাড়ার ছেলেরা ছিলো বন্ধুর মতো, বিপদে রক্ষাকবচ। স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি কলোনিতে। সবাই সবার জন্য ছিলো দরদি, অকুতোভয়। সারাদিন সেনাবাহিনী টহল দিয়েছে, কারো কোনো ক্ষতি হয়নি।’
নতুন প্রজন্মের কাছে, বিশেষ করে মেয়েদের কাছে আনোয়ারা বেগমের সনির্বন্ধ অনুরোধ, ‘জীবনের সব চাওয়া পাওয়াকে একটি কেন্দ্রবিন্দুতে স্থির করো। জ্ঞান ও মেধায় বলিষ্ঠ হও, জীবনকে দেখো একবিংশ শতাব্দীর উন্নত প্রযুক্তিতে।’
‘আমার সারাজীবনের সকল প্রাপ্তি, সকল অনুভুতি, কিছু স্মৃতি, কিছু বোধ, কিছু দ্বিধা, একান্ত আবেগ উজ্জীবিত করেছি, শুধু তোমাদের অনুপ্রাণিত করার জন্য। তোমরা বড়ো হও, মানুষ হও, নিজেকে ছড়িয়ে দাও পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট আকাঙ্খিত ভূমিতে।’ লিখেছেন দেশের প্রথম নারী ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ারা বেগম।