জোবায়েদ ইবনে শাহাদত : প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয়ে নগরের ঐতিহ্যবাহী বিপণি বিতানে (নিউ মার্কেট) চট্টগ্রামের প্রথম অটোমেটিক মাল্টিলেভেল ডিজিটাল কার পার্কিং নির্মাণ করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।
চট্টগ্রামের প্রথম হলেও দেশের দ্বিতীয় ও সবচেয়ে বড় অটোমেটিক মাল্টিলেভেল কার পার্কিং এটি। বিপণি বিতানের পার্কিং সমস্যা ও মার্কেট সম্মুখের যানজট নিরসন ও সীমিত জায়গায় বেশি সংখ্যক গাড়ি রাখার জন্য নির্মিত সাত তলা বিশিষ্ট এই অটোমেটেড পার্কিং সিস্টেম চালু হয় ২০১৭ সালের ২২ এপ্রিল।
ইঞ্জিনিয়ারিং সিস্টেম অনুযায়ী, জাপান ও জার্মানীর প্রযুক্তি এবং চীনের কারিগরি সহায়তায় নির্মিত এই কার পার্কিং স্পেসে ৫টি গাড়ি রাখার জায়গায় ২৯টি কার পার্কিংয়ে কার্ড পাঞ্চিং বা কোড ব্যবহার করেই সাত তলা পর্যন্ত অটোমেটিক গাড়ি ওঠা-নামা করা যায়। নিচে থাকে পাঁচটি ট্রে। যে কোনো একটি ট্রেতে কার পার্কিং করা হয়।
এরপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে উপরের যে কোনো তলার খালি স্পেসে গাড়ি পার্ক হয়ে যায়। একইভাবে কার্ড পাঞ্চিংয়ের পর অটোমেটিক গাড়ি নিচে নেমে আসার সুবিধার কথা বলা হলেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কার্ড পাঞ্চিং নয়, মূলত ম্যানুয়েল রেজিস্ট্রার খাতায় গাড়ির নাম্বার নোট করে রাখা হচ্ছে গাড়ি।
অভিযোগ আছে, অনেক ক্ষেত্রে পার্কিং মেশিন অপারেটর না থাকায় গাড়ি রাখার বা নেওয়ার সময় ৩০ মিনিট থেকে ঘণ্টা খানেকও অপেক্ষা করতে হয় গাড়ির ড্রাইভার ও মালিকদের।
শুধু তাই নয়, সিডিএ থেকে অপারেটরের মাধ্যমে তত্ত্বাবধান ও গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে ফি না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও, বিগত দুই বছর ধরে এই অটোমেটেড কার পার্কিংয়ের কোনো রকম তদারকি করছে না সিডিএ এমনটাই অভিযোগ করেছে বিপণী বিতান ব্যবসায়ী কল্যাণ কমিটি।
তাদের অভিযোগ, সিডিএ থেকে দেওয়া অপারেটর বিদায় করা ছাড়াও লোডশেডিং এর সময় মেশিন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি খরচও দিচ্ছে না সংস্থাটি। যার কারণে ডিজিটাল কার পার্কিং সিস্টেম পরিচালনার জন্য বিপণী বিতান ব্যবসায়ী কল্যাণ কমিটি থেকেই রাখা হয়েছে একজন অপারেটর। অপারেটরের বেতন এবং জ্বালানি খরচ দেওয়ার জন্য প্রতি ঘণ্টা গাড়ি পার্কিং এর জন্য ২০ টাকা ফি নেয়া হলেও রয়েছে অতিরিক্ত ফি আদায়ের অভিযোগও।
বৃহস্পতিবার (১ অক্টোবর) বিকেল ৩ টায় সরেজমিনে বিপণী বিতানে (নিউ মার্কেট) অটোমেটিক মাল্টিলেভেল ডিজিটাল কার পার্কিং প্লেসে গিয়ে দেখা যায়, ৩০ মিনিট ধরে গাড়ি নিতে অপেক্ষা করছেন এক ব্যক্তি। পার্কিং অপারেটর না থাকায় গাড়ি নিতে পারছেন না।
কিছুক্ষণ পরেই মো. নাঈম নামের এক ব্যক্তি এসে ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট গাড়ি রাখার ভাড়া হিসেবে ৩৫ টাকা দিতে বলে রেজিস্ট্রার খাতায় গাড়ি মালিকের স্বাক্ষর নেন। দেরির কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, পার্কিং অপারেটর মো. ইমরান খাবার খেতে যাওয়ায় তাকে কিছুক্ষণের জন্য দেখতে বলায় নাঈম দেখাশোনা করছেন।
নাঈম জানান, পেশায় একজন কার চালক তিনি। কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত ফি’র চেয়ে বাড়তি টাকা চাওয়ার কারণ জানতে চাইলে নাঈম বলেন, তাকে যে পরিমাণ টাকা নিতে বলা হয়েছে তিনি সেই অনুযায়ী ফি নিচ্ছেন।
অতিরিক্ত ফি দিয়ে গাড়ি প্রস্থানের পরই আসেন পার্কিং অপারেটর মো. ইমরান। একগাদা অভিযোগ নিয়ে তিনি বলেন, এই চাকরিটা করছি কিন্তু স্থায়ী নিয়োগ দিবে বললেও আজ পর্যন্ত তা হলো না। গাড়ি পার্কিংয়ের ফি থেকে যে টাকা উঠে তা থেকে আমাকে বেতন দেয়। করোনার সময় গাড়ি কম তাই বেতনও খুব কম, বলেন ইমরান।
জানা যায়, ২৯ টি গাড়ি পার্কিং এর জন্য ২৯ টি টিনের ট্রে থাকলেও এর মধ্যে অকেজো হয়ে আছে ২ তলার ২টি এবং ১ তলার ১টি ট্রে। যার কারণে উপরে স্পেসে গাড়ি তোলা যাচ্ছে না। তাই নিচের ৫টি ট্রে ছাড়া বাকি ২৪ টি পার্কিং ট্রে থেকেও ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। এসব সমস্যার কারণে অটোমেটিক মাল্টিলেভেল ডিজিটাল কার পার্কিং ব্যবহার না করে মার্কেট প্রবেশের পথে গাড়ি পার্ক করছেন বেশির ভাগ আগমনকারী। ফলে বিপণি বিতানের পার্কিং ও মার্কেট সম্মুখের যানজট সমস্যার সমাধান না হয়ে উল্টো যানজট বাড়ছে।
বিপণী বিতান ব্যবসায়ী কল্যাণ কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ সগির একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘তৎকালীন সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম যখন এই অত্যাধুনিক পার্কিংয়ের স্পেস নির্মাণের কথা বলছিলেন তখন আমি বলেছিলাম পার্কিং স্পেস আছে তবে বিপণী বিতানের তারের ওয়্যারিং কাজ করা প্রয়োজন। তাছাড়া এতো বড় মার্কেটে কোনো কিডস জোন এবং মায়েদের জন্য চাইল্ড ফিডিং জোন নেই তা করতে বলেছিলাম। তিনি তা না করে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগিয়েছেন যা এই মুহূর্তে আমাদের জন্য গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর দেখাশোনা করা এবং জেনারেটর জ্বালানি খরচ সিডিএর বহন করার কথা থাকলেও তা দিতে হচ্ছে আমাদের। ক্ষতির কারণে আমরা এই পার্কিং স্পেস বন্ধ রাখতে চাইলেও তারা তা করতে দিচ্ছে না।’
সগির জানান, ‘এই পার্কিং স্পেস নির্মাণে ইঞ্জিনিয়ার ও কারিগরি সহায়তা নেওয়া হয়েছিল চীনের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে। এখন সিডিএ এই বিষয়টি একেবারেই দেখছে না। কোনো যান্ত্রিক গোলযোগ হলে তখন আমরা কী করবো? সিডিএর কাজের দায়িত্ব কেন ব্যবসায়ী কল্যাণ কমিটির উপর চাপিয়ে দেয়া হবে? কিন্তু বিপণী বিতানের উন্নয়নে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা থাকলেও সিডিএ তা দিচ্ছে না। প্রয়োজনের বিষয়ে জানালে তা কানেও তোলে না কর্তৃপক্ষ।’
বিপনি বিতানের উন্নয়ন ও দাবির বিষয়ে দৃঢ় অবস্থানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সালাম সাহেব বিপনি বিতানের উন্নয়নের কাজের কথা দিলেও তার একটিও বাস্তবায়ন করেন নি, উল্টো ঝামেলা বাড়িয়েছেন। আমরা সিডিএর বর্তমান চেয়ারম্যানকে এসব সামগ্রিক অসুবিধার কথা জানিয়ে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। তিনি আমাদের সাথে বৈঠক করবেন বলে জানিয়েছেন।
এই বিষয়ে সিডিএ’র তদারকির অভাব ও দায়িত্বে অবহেলাকে দোষারোপ করেছেন সিডিএ’র সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম।
একুশে পত্রিকাকে তিনি বলেন, একটা ইঞ্জিনিয়ারিং সিস্টেমের যথাযথ পরিচর্যা না করলে তা এক পর্যায়ে আর ঠিক থাকে না। এই পার্কিং সিস্টেম নির্মাণের পর দীর্ঘ সময় পরও সিডিএ থেকে একজন অপারেটর রাখা হয়েছিল। তারপর কেন এর রক্ষণাবেক্ষণ ঠিক মতো হচ্ছে না তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। সিডিএ’র অবহেলার কারণে এই ইঞ্জিনিয়ারিং বিস্ময় ধীরে ধীরে বিকল হতে চলেছে।
সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এতো বড় বাজেটের একটি নির্মাণ কাজ করার আগে অবশ্যই পরিকল্পনা করে এর ফলাফল কী হবে তা যাচাই করা উচিত ছিল। যেহেতু এতে বিদেশি টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে তাই এর রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য সেরকম একজন অপারেটর রাখার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তা করা হয়নি। সব মিলিয়ে এটা এখন সিডিএ এবং ব্যবসায়ী কল্যাণ কমিটির জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
এই অটোমেটিক মাল্টিলেভেল ডিজিটাল কার পার্কিং সিস্টেমের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন সিডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী আ হ ম মেজবাহ উদ্দিন। দায়িত্বে অবহেলা ও বিশাল বাজেটের অটোমেটেড পর্কিং সিস্টেমের তদারকির না করার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এই পার্কিং স্পেসের দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হলেও নির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। যেহেতু বন্ধ থাকলে এটি বিকল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তাই এটি চালানো হচ্ছে এবং বিপণী বিতান ব্যবসায়ী কল্যাণ কমিটিকে এটি দেখাশোনা করার জন্য বলা হয়েছে। যদি আমাদের চেয়ারম্যান স্যার আমাকে এই বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেন তাহলে আমরা সেই মোতাবেক কাজ করবো।’
এই বিষয়ে জানতে সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম দোভাষকে বেশ কয়েকবার মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
অপরিকল্পিতভাবে প্রকল্প গ্রহণ ও দায়িত্ব পালনে গাফিলতির বিষয়ে সিডিএ’কে দুষছেন নগর পরিকল্পনাবীদ আশিক ইমরান। আশিক ইমরানের মতে, বিশাল বাজেটের এই যন্ত্র বিকল হয়ে পড়ার প্রধান কারণ রক্ষণাবেক্ষণ না করা এবং দায়িত্বে অবহেলা। উন্নয়ন দেখানোর জন্য অপরিকল্পিত নির্মাণ কাজ করার সরকারের টাকা অপচয় বলে মনে করেন তিনি।