জসিম উদ্দীন, কক্সবাজার : স্বেচ্ছায় কেউ টাকা দিলেও নিচ্ছেন না পুলিশ সদস্যরা। উল্টো আগে হাতিয়ে নেয়া ঘুষের টাকা ফিরিয়ে দিচ্ছেন অনেক পুলিশ সদস্য। কেউ আবার টাকা ফিরিয়ে দিতে না পারলেও নিজের অতীতের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে অনুতপ্ত হয়ে মাফ চাইছেন ভুক্তভোগীদের কাছে।
অবিশ্বাস্য হলেও, সাম্প্রতিক সময়ে কক্সবাজারে এ ধরনের কয়েকটি ঘটনার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।
গত ৩১ জুলাই মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান নিহত হওয়ার পর পুলিশের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হওয়ায় অতীত কর্মকাণ্ডের কারণে আতংক বিরাজ করছে জেলা পুলিশের অনেক সদস্যদের মাঝে।
সিনহা হত্যার পর থেকে এখন পর্যন্ত কক্সবাজারের বিভিন্ন থানার ওসিসহ শতাধিক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অন্তত ১৭টি মামলা দায়ের করেছেন ভুক্তভোগীরা।
এসব মামলার এজাহারে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা, মিথ্যা মামলা, চাঁদাবাজিসহ নানান ধরনের হয়রানির অভিযোগ আনা হয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে।
একদিকে মামলা, অন্যদিকে কক্সবাজার জেলা পুলিশের সুনাম ফিরিয়ে আনতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। এর ফলে পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন আসছে।
জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে ভুক্তভোগীরা স্পর্শকাতর ঘটনায় মামলা করতে কক্সবাজারের থানাগুলোতে গেলেই সহজে মামলা রেকর্ড করছে পুলিশ। এ সময় মামলার জন্য কোন টাকা চাওয়া হচ্ছে না। এমনকি স্বেচ্ছায় কেউ পুলিশকে টাকা দিতে চাইলেও পুলিশ তা ফিরিয়ে দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কক্সবাজার সদরের বাসিন্দা আমেনা বেগম জানান, তিনি প্রতিবেশির হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হলেও টাকার জন্য সদর থানা তার অভিযোগ গ্রহণ করেনি। তবে কয়েকদিন আগে টাকা ছাড়াই তার অভিযোগ গ্রহণের পর ঘটনাস্থলে গিয়েছে পুলিশ। এ সময় পুলিশ সদস্যরা তার কাছে কোন টাকা দাবি করেনি। গাড়িভাড়ার কথা বলে কিছু টাকা দিতে চাইলেও পুলিশ তা ফিরিয়ে দেন বলে জানান এই নারী।
টেকনাফের বাসিন্দা আবুল কালাম পেশায় টমটম চালক। তিনি জানান, গত ১৮ জুলাই তাকে ইয়াবা দিয়ে চালান করে দেয়ার ভয় দেখিয়ে জিম্মি করে ৩৫ হাজার টাকা ঘুষ নেয় টেকনাফ থানার কনস্টেবল সাগর। তার সঙ্গে ছিল স্থানীয় এক দালাল।
আবুল কালামের ভাষ্যমতে, সিনহা হত্যার পর পুলিশের বিরুদ্ধে যখন একের পর এক মামলা হচ্ছে তখন ডকুমেন্ট থাকায় তিনিও ওই পুলিশ সদস্যকে মামলা করবেন বলে জানান। এ প্রেক্ষিতে কয়েকদিন আগে তাকে ১৫ হাজার টাকা ফিরিয়ে দিয়ে পায়ে ধরে মাফ চান কনস্টেবল সাগর ও দালালচক্রের সদস্য।
টেকনাফের বাসিন্দা স্থানীয় রহমত উল্লাহ বলেন, সিনহা হত্যা মামলায় কারাগারে থাকা বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপের ছত্রছায়ায় টেকনাফ থানা পুলিশের সদস্যরা যে যার মতই চাঁদাবাজি করেছেন। এখন মামলা ও পত্রিকায় ছবিসহ সংবাদ প্রকাশিত হবে- এই ভয়ে কয়েকজন পুলিশ সদস্য আগে আদায় করা ঘুষের টাকা ফিরিয়ে দিচ্ছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কক্সবাজার জেলার সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান একুশে পত্রিকাকে বলেন, টেকনাফে মাদক নির্মূলের নামে হত্যাকাণ্ড হচ্ছিল। আমরা মনে করি যা হয়েছে তা বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড। এসবের কারণে পুলিশের প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলে। এখন পুলিশ বাহিনীকে নিজেদের উদ্যোগে সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নিতে হবে। সেবা প্রদানের মাধ্যমে মানুষের মন জয় করে পুলিশের যে অতীত গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিল তা ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করতে হবে।
কক্সবাজারের সিনিয়র আইনজীবি আবদুল মান্নান বলেন, পুলিশ সদস্যদের ঘুষ বাণিজ্য ও অপরাধমূলক কাজ থেকে বিরত রাখতে হলে প্রশিক্ষণে নীতি-নৈতিকতার বিষয়ে আরও জোর দিতে হবে। পাশাপাশি বাহিনীর সুনাম ধরে রাখতে যে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তা আমলে নিয়ে তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। সাধারণ মানুষ যাতে পুলিশ কর্তৃক আক্রান্ত হলে নির্ভয়ে অভিযোগ করতে পারেন, সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে পুলিশ বাহিনীকেই।
কক্সবাজার সদর থানার ওসি মাসুম খান একুশে পত্রিকা বলেন, সদর থানায় প্রতিদিন যেসব অভিযোগ নিয়ে ভুক্তভোগীরা আসেন তারা ভোগান্তি ছাড়াই অভিযোগ করতে পারছেন, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে মামলা গ্রহণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত এমন পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করা হচ্ছে।
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন একুশে পত্রিকাকে বলেন, পুলিশ বাহিনীর সুনাম ধরে রাখতে যা করা দরকার সবই করা হচ্ছে। কক্সবাজার পুলিশের ভালো কর্মকাণ্ডগুলো অব্যাহত রাখার পাশাপাশি অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি বলেন, আমি চট্টগ্রাম রেঞ্জে যোগদানের পর কক্সবাজারের বিভিন্ন থানা পরিদর্শন করেছি, কল্যাণ সভা করেছি। সেখানে পুলিশের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক ও হয়রানি ছাড়াই সেবা প্রদানের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
ডিআইজি বলেন, পুলিশ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। কেউ পুলিশ দ্বারা আক্রান্ত হলে নির্ভয়ে অভিযোগ করুন। তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।